নয়ন বন্ড কার লোক?

সাব্বির আহম্মেদ নয়ন
সাব্বির আহম্মেদ নয়ন

বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যার পর প্রশ্ন উঠেছে, এই মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড কার লোক? কার পক্ষে কাজ করতেন। অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের তালিকায় আছে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ ও স্থানীয় পুলিশ।

বরগুনা আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের নেতারা বলেছেন, ‘নয়ন বন্ড আমার নয়, ওদের লোক।’ আসলে নয়ন বন্ড কার লোক, সেটি খুঁজে বের করতে আরেকটু পেছনে তাকাতে হবে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্ক হয়েছিল। একদিকে বর্তমান সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ অন্যদিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দেলোয়ার হোসেন। পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলনে বরগুনা তখন জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি দেলোয়ার হোসেন এখন বলছেন, নয়ন বন্ড সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে ও আওয়ামী লীগের নেতা সুনাম দেবনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এই পরিচয়েই তিনি স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। স্থানীয় লোকজনও বলছেন, নয়ন পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী কীভাবে পুলিশের সোর্স হন, সেটাও প্রশ্ন বটে। শুধু বরগুনা নয়, সারা দেশে যাঁরা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের বড় অংশ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত।

জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ও সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রিফাত হত্যার ঘটনায় রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। নয়ন কখনো আমাদের গ্রুপে ছিল না। রিফাত হত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রতিপক্ষ গ্রুপের লোক। আমার রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করতে তাঁরা অপপ্রচার চালাচ্ছেন।’

উল্লেখ্য, নয়ন বন্ডের সহযোগী রিফাত ফরাজী ও তাঁর ভাই রিশান ফরাজী আওয়ামী লীগের নেতা ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। স্থানীয় লোকজন ও প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের লোকজনের মতে, তাঁরা দেলোয়ারের নিকটাত্মীয় ও রাজনৈতিকভাবেও তাঁর অনুসারী।

তবে তিনি বলেছেন, ‘আমার আত্মীয় হলেও দুই বছর ধরে ওদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। ওরা প্রতিদ্বন্দ্বী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর অনুসারী।’ টেলিভিশনে দেখলাম, শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলছেন, নানা ধরনের কথাবার্তা উঠেছে বলেই তাঁকে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে। তিনিও খুনিদের শাস্তি চান।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, কোনো কমিটিতে না থাকলেও নয়ন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেই ছিলেন। যুবলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাঁকে সক্রিয় দেখা গেছে।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেছেন, নয়ন পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু পুলিশ এ কথা স্বীকার করছে না। তারা বলছে, যখনই নয়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এসব তথ্য ও অভিযোগ থেকে আমরা কী উপসংহার টানতে পারি? সুনাম দেবনাথের বক্তব্য অনুযায়ী, নয়ন বন্ড দেলোয়ারের লোক। দেলোয়ারের কথা অনুযায়ী, তিনি সুনামের লোক। আবার পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে থাকলে পুলিশের লোক।

এই তিন পক্ষের মধ্যে নয়নকে কে কতটা ব্যবহার করেছে, আর নয়ন তাদের কাছ থেকে কী পরিমাণ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন, সেটি বের করতে হলে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে নয়ন যারই লোক হয়ে থাকুন না কেন, সাধারণ ও নিরীহ মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন। পুলিশ এখন বলছে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কয়েক মাস আগে নয়ন বন্ড যখন আয়েশা সিদ্দিকার স্বামী রিফাতকে মাদকের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছিলেন, তখন কিন্তু তারা নয়নের হয়েই কাজ করেছিলেন। একটি নিরীহ ছেলেকে জেলে পাঠিয়েছেন। ওই ঘটনা যে নয়নকে আরও বেপরোয়া করেছে, তাতে সন্দেহ নেই।

রিফাত হত্যার আরেক আসামি কামরুল ইসলাম সাইমুনকে পুলিশ গত শনিবার গ্রেপ্তার করেছে পটুয়াখালী থেকে। তিনি নয়নের বন্ধু ও পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল মান্নানের জামাতা।

দুই.
শনিবার ‘একজন নয়ন বন্ড যেভাবে তৈরি হয়’ শিরোনামে লেখাটি ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত হওয়ার পর যেসব প্রতিক্রিয়া এসেছে, তাতে ক্ষোভ ও বেদনার পাশাপাশি অপরাধীদের প্রতিরোধ করতে না পারার অক্ষমতাও ফুটে উঠেছে। অনেকে ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চাননি। লিখেছেন, ‘নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।’ একাধিক পাঠক নিজ নিজ উপজেলার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাস ও মাদক ভয়াবহ রূপ নিলেও কেউ ভয়ে কথা বলছেন না। কারও কারও লেখায় উঠে এসেছে মাদকের সঙ্গে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও রাজনীতির যোগসাজশের কথা। এখানে কয়েকটি মন্তব্য তুলে দিচ্ছি:

১. এই বন্ডকে রক্ষা করার জন্য .,.,..,. বেচারা মিন্নির অতীত জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। যেন কিছু একটা প্রমাণ করতে পারলে হত্যাকাণ্ড বৈধ।
২. একজন অপরাধীকে রক্ষা করে দেশ ও দলের কখনোই কোনো লাভ হয় না। জনগণ সুযোগ পেলে মোক্ষম জবাব দিয়ে দেয়, ইতিহাস তা-ই বলে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সরকার এবং দলগুলো একই ভুল বারবার করে চলে!
৩. ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে এ রকম হাজারো নয়ন বন্ড আছে সমগ্র বাংলায়...।
৪. আসলেই সবকিছুর পেছনে রয়েছে মাদক ও ক্ষমতার রাজনীতি। আর বর্তমানে দেশে কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে এদের পেছনে কোনো রাজনীতিবিদ নেই, সবকিছুর মূলেই রয়েছে নষ্ট রাজনীতি।
৫. জনগণ যখন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মূল্যহীন ‘জীব’-এ পরিণত হয়, তখন মানুষের বিবেকও হারিয়ে যায়। আমরা ভয়াবহ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি!
৬. এখানে যাঁরা মন্তব্য করছেন তাদের বেশির ভাগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, অনলাইনেই আমরা এখন রুখে দাঁড়াতে ভয় পাই, রাস্তায় দাঁড়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না!
৭.. Everyone know it, why u dont know ?
৮. We are very sad for police performance...
৯.আয়েশা সিদ্দিকার মতো অসহায় মেয়েদের রক্ষার জন্য কী উপায় আছে—লেখক বলবেন কি? রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, কোনটাকে কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, তার জন্য লিখুন সাধারণ মানুষের জন্য।
১০.এই একজন ধরা খেয়েছে বলে সবার সামনে আসল...কিন্তু বাংলাদেশের অলিতে-গলিতে এখন নয়ন বন্ড... আইনশৃঙ্খলা আউট অব কন্ট্রোল...
১১.এই সব ঘটনার জন্য বাংলাদেশের সিস্টেম, প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থাই দায়ী। তাদের ভুলের কারণে সাধারণ জনগণকে মাশুল দিতে হয় তাদের জীবন দিয়ে। সুন্দর ও নির্ভয় জীবনযাপনের জন্য আর কত অপেক্ষা করব আমরা...।
১২. স্যার, এ রকম নয়ন বন্ড প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একজন করে আছে। এদের উত্থান ও টিকে থাকার কাহিনিও অভিন্ন। আমরা যাব কোথায়? কে রক্ষা করবে দেশটাকে?
১৩. এখন নেতাদের চেয়ে, নেতাদের চেলা, চামচাদের দাপটে দেশবাসী অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, আওয়ামী লীগকে এ ব্যাপারে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে।

আরও অনেক মন্তব্য আছে। সব যে সরকার বা সরকারি দলের বিরুদ্ধে, তা-ও নয়। অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন অবিলম্বে আওয়ামী লীগের উচিত এসব সন্ত্রাসী ও মাদকের পৃষ্ঠপোষককে দল থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা। কিন্তু শরীরের সর্বাঙ্গে যখন ব্যথা হয় ওষুধ দিয়ে সেটি নিরাময় করা কঠিনই বৈকি।

রাজনৈতিক দলগুলো মুখে যে স্লোগানই দিক না কেন, রাজনীতি হয়ে উঠেছে নীতি ও আদর্শবর্জিত। এ কারণেই এককালীন জামায়াতের নেতা ও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা আওয়ামী লীগের পেয়ারের মানুষ হয়ে যান। এ কারণেই নয়ন বন্ডের মতো দুর্ধর্ষ অপরাধী ‘কার লোক’ তা নিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা বাহাসে জড়িয়ে পড়েন।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]