দুর্ঘটনামন্ত্রীদের আজব-জবর থিওরি
মাস চারেক আগের কথা। বরমচালের মিয়া বাজারে ফাজু চৌধুরী নামের এক ব্যবসায়ী আছেন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ফেসবুকে ছবিসহ ওই এলাকার রেললাইনের বেহাল দশা কথা লিখেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ক্লিপ ছাড়া কেমনে চলছে রেল? আশঙ্কা করেছিলেন বড় দুর্ঘটনার। স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে দেখা করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কুলাউড়া, মৌলভীবাজার, সিলেটের ফেসবুকের পাতায় পাতায় সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ফাজু চৌধুরীর সেই সচিত্র পোস্ট। নাগরিকের দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও ফাজু চৌধুরী সরকারি সংস্থার দায়িত্বের অনেকটাই পালন করেছিলেন। কিন্তু কী করেছিল রেল কর্তৃপক্ষ?
সামাজিক মাধ্যমে অপছন্দের কোনো খবর মাটিতে পড়ার আগেই খড়ের গাদা থেকে সোনামুখী সুই খুঁজে বের করার স্টাইলে প্রেরককে পাতি পাতি করে খুঁজে বের করে ফেলেন দায়িত্বশীলেরা। তারপর তাঁকে ফাটকে ভরতে যখন সময় লাগে না, তখন বরমচালের ফাজু চৌধুরী কীভাবে ছাড় পেলেন কে জানে? তিনি তো প্রশ্ন তুলছিলেন, রেলপাতে ক্লিপ ছাড়া কেমনে চলছে ট্রেন? আশঙ্কা করেছিলেন বড় দুর্ঘটনার। কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না যে তারা রেললাইন আর রেলসেতুর বেহাল দশা সম্পর্কে জানত না। যদিও দায় এড়ানোর জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন যে ‘রোববারের ঘটনাটি নিছকই একটি দুর্ঘটনা।’ দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কর্তারা নানা থিওরি আওড়ে যাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে তিতাস নদে ওপরে একটি ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় সড়কপথে যাত্রা ব্যাহত হওয়ার কারণে কয়েক দিন ধরে ট্রেনের ওপরে চাপ বেড়ে যায়।’
মানে যাত্রীর চাপে ট্রেন উল্টেছে। সোজা কথায় পাবলিকের দোষ। ট্রেনের মতো ভারী যান যাত্রীর ভারে উল্টে যায়—এটা এক ঐতিহাসিক আবিষ্কার। আমাদের এক রসিক বন্ধু এসব দেখে লিখেছেন, রানা প্লাজা ধসে জন্ম নিয়েছিল ‘থিওরি অব শেকিং’ আর কুলাউড়া ট্রেন দুর্ঘটনায় জন্ম নিল ‘থিওরি অব ওভারলোডেড প্যাসেঞ্জার’।
বিএনপি আমলে এক মন্ত্রী বাবার বুকে থাকা সন্তান গুলিতে নিহত হলে ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন’ থিওরি দিয়েছিলেন। রানা প্লাজা ধস নাকি বিএনপি কর্মীদের ওই ভবনের থাম ঝাঁকানোর ফল। ধান কাটার শ্রমিক না পাওয়া নাকি উন্নত কর্মসংস্থানের ফল। রাস্তায় যানজট নাকি দেশের উন্নতির লক্ষণ। আর এখন যাত্রীর ভারে ট্রেন উল্টানো গল্প! কী বিচিত্র এক দেশ আর সে দেশের মন্ত্রীমহোদয়গণ।
২.
রেললাইন থেকে ছিটকে ঘাস-কাদায় শুয়ে পড়ে কয়েকটি বগি। গত রোববার রাত আড়াইটা পর্যন্ত সাত যাত্রীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছিল, আহত হওয়ার গণনা চলছিল। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে লাশের সংখ্যা কমে যায়। রেল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ ঘটনায় নিহত তিন নারীসহ চারজনের মৃতদেহ কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখা হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্থানীয় কর্মকর্তারা পাঁচজনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছেন। কুলাউড়া সাবস্টেশন থেকে বলা হয়, হাসপাতালে নেওয়ার পর একজন মারা যান। লাশ নিয়ে কর্তৃপক্ষের এই লুকোচুরি ১৯৫২ সাল থেকে চলে আসছে। গত ৬৭ বছরে পোশাক-আশাকের আর পতাকার রং পরিবর্তন হলেও খাসলতের কোনো রকমফের হয়নি। লাশের সংখ্যা কম হওয়ায় কর্তৃপক্ষ এখন বুক ফুলিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বলে বেড়াচ্ছে, যত বড় দুর্ঘটনা, তত বড় ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি মাপার একক যখন লাশ, তখন তাদের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কী আশা করা যায়? কোনো লাশ পাওয়া না গেলে হয়তো বলত, কোনো দুর্ঘটনাই ঘটেনি।
বরমচালে এই দুর্ঘটনার পর থেকেই সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। রাত ১১টায় দুর্ঘটনা ঘটলেও পরদিন সকালের আগে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে যেতে পারেনি। ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষার সময় জনজীবনের দুর্ভোগ, যাত্রীসেবা ও পণ্য পরিবহন বন্ধের আর্থিক ও সামাজিক লোকসানকেও আমলে নিতে হয়। চিন্তা করতে হয় মানুষ কি আর আগের মতো নিরাপদ বোধ করবে, না নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। নিরাপত্তা লাপাত্তা হওয়ারও একটা আর্থিক মূল্য আছে। সড়কে আস্থা হ্রাস পাওয়ায় সময় একটু বেশি লাগলেও মানুষ রেলের প্রতি ঝুঁকছিল, সেটাকে পুঁজি করে রেলের যখন পরিষেবা আরও উন্নত করে মানুষকে রেলের প্রতি আস্থাশীল রাখার চেষ্টা করা উচিত, তখন বাঁশের পট্টি দিয়ে রেললাইনের দায়সারা মেরামতের ছবি দেখি পত্রিকার পাতায় পাতায়।
যেকোনো যানবাহন দুর্ঘটনা, বিশেষ করে রেল দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তির সংখ্যা নির্ধারিত হয় দুর্ঘটনার সময়, প্রকৃতি, স্থান এবং যানবাহনটি কত গতিবেগে ছুটছিল তার ওপর। মূলত, গতিবেগই হতাহত ব্যক্তির সংখ্যা নির্ধারণের প্রধান নিয়ামক। বাংলাদেশে যেসব রেলগাড়ি যাতায়াত করে, সেগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ গতি গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ কিলোমিটার। সড়কের মতো যানজটের বালাই না থাকলেও কেন রেলগাড়ি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই গতিসীমার বাইরে যেতে পারে না, তার কারণ আমাদের সবার জানা। এই গতিসীমা রেলসেতুগুলোর ওপরে চলার সময় বা নাজুক আর ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইনে আরও নিয়ন্ত্রিত থেকে। ঘণ্টায় পাঁচ কি দশ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলে না। হতাহত ব্যক্তির সংখ্যা কম হওয়ার এটাই মূল কারণ।
প্রায় ২৬ হাজারের মতো লোকবল নিয়ে তিন হাজার কিলোমিটারের রেলপথ আছে বাংলাদেশে। রেললাইন নিরাপদ রাখার জন্য ব্রিটিশদের করে দেওয়া রক্ষণাবেক্ষণ ম্যানুয়াল মেনে চললে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। বাংলাদেশের পরিবহন নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি জানান, রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি কমই নজর দেওয়া হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণ করে নিরাপদ আর টেকসই রাখার সংস্কৃতিটা আমাদের গড়ে উঠেছে না। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময় স্থানীয় লোকজন রেলপথের ত্রুটির বিষয়গুলো তুলে ধরে। ফলে, অনেক সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বরমচালের ক্ষেত্রেও স্থানীয় লোকজন বিপদের বাঁশি বাজিয়েছিল অনেক আগেই। কর্তৃপক্ষের কানে সেটা পৌঁছায়নি বা পাত্তা পায়নি। রূপপুরের বালিশের নিচে সেসব চাপা পড়তে পারে বা হারিয়ে যেতে পারে ঈদের চাঁদের বিতর্কে।
কুলাউড়ার দুর্ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি হয়েছে। দুটি কমিটির সবাই রেল কর্মকর্তা। নিজেদের গাফিলতির কী তদন্ত তাঁরা করবেন? কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে কেন তদন্ত কমিটিতে রাখা হলো না?
সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে—সমস্যাটা স্বীকার করা। সেটা না করে অং বং চং দিয়ে সবকিছু বালিশের নিচে চাপা দিলে কে জানে কবে তাদের মোবাইলেও শেষ বার্তা আসবে ‘আম্মা আমি ঢাকায় যাচ্ছি’। অথবা একটি বালিকাকে দুর্ঘটনাস্থলে বলতে শোনা যাবে, ‘আম্মার মাথা পাচ্ছি না।’
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী।