স্যানিটারি ন্যাপকিনেও ভ্যাটের বোঝা বইতে হবে?
পিরিয়ড বা মাসিক নারীদের অন্য সব শারীরবৃত্তীয় কাজের মতোই সাধারণ বিষয়; যদিও সমাজের একটা বড় অংশে এখনো মাসিকসংক্রান্ত কথাবার্তা নিষিদ্ধ গল্পের কাতারেই পড়ে। মাসিক চলাকালে কয়েকটা দিন নারীদের নানা রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বাজারে বিক্রি হওয়া স্যানিটারি প্যাড এই সময়ে নারীদের এক অতিপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।
তবে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার শুধু আর্থিকভাবে সচ্ছল ও সচেতন মেয়েদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার রীতিমতো বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। পুরোনো কাপড়, অস্বাস্থ্যকর তুলা দিয়েই কাজ চালাতে হয়। কাপড় ব্যবহারের সঠিক ব্যবস্থাপনা না মানায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে এতে। মাসিক চলাকালে অব্যবস্থাপনার জন্য প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী জরায়ু, জরায়ুমুখ ও মূত্রনালির সংক্রমণের শিকার হন, যা পরে ক্যানসারে রূপ নিতে পারে।
প্রতিষ্ঠানভেদে বাংলাদেশে স্যানিটারি প্যাডের প্যাকেটের দাম গড়ে ১০০ থেকে ১৬০ টাকা। এই দাম শহুরে সচ্ছল পরিবারের কাছে আহামরি না হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে তা অতিরিক্ত হারে বেশি। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো এমন সংবেদনশীল একটি পণ্যের ওপরও বেশ বড় রকমের ভ্যাট আরোপ করা। মেয়েদের অন্যান্য বিলাসী পণ্যের মতো এই স্যানিটারি প্যাডের জন্যও গুনতে হয় ‘পিংক ট্যাক্সের’ অতিরিক্ত মূল্যমান।
নারীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি বস্তুকেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিলাসিতার কাতারে হিসাব করা হচ্ছে। স্যানিটারি প্যাড উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, প্যাড তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় সব কাঁচামালের ওপর ভ্যাট প্রদান করতে হয় ১৫ শতাংশ হারে। সঙ্গে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি এবং ৪ শতাংশ এডিটি তো রয়েছেই। এই উচ্চ হারের ভ্যাট মওকুফ করা হলে প্রতি প্যাকেট স্যানিটারি প্যাডের দাম ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব।
শহরাঞ্চলে প্যাডের ব্যবহার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হলেও সারা দেশে সেই হার মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। স্যানিটারি প্যাডের কাঁচামালের ওপর থেকে উচ্চ হারের কর তুলে নিলে সরকারের সামগ্রিক আয়ে বড় কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়।
‘লিঙ্গসমতা’ জাতিসংঘঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি। মাসিক চলাকালে অব্যবস্থাপনা মেয়ে ও নারীদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে রাখে, যা ক্ষমতায়নে প্রভাব ফেলছে।
দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলগুলোয় শৌচাগারের অবস্থাও খারাপ। নারীদের শৌচাগারগুলোয় স্যানিটারি প্যাড সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই ন্যাপকিন ফেলা বা কাপড় পরিবর্তনের সুযোগ। নারীরা তাই বাধ্য হয়ে এ সময়ে বন্দী থাকেন বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভের তথ্য বলছে, ৪১ শতাংশ মেয়ে মাসিকের সময় স্কুল-কলেজে অনুপস্থিত থাকেন। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাচ্ছে।
বলিউডের সাড়া জাগানো ‘প্যাডম্যান’ সিনেমার কথা মনে আছে অনেকের। সুলভ মূল্যে স্যানিটারি প্যাড সর্বস্তরের নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো এমন উদ্যোগ আমাদের দেশেও তুমুল সাড়া ফেলতে পারে। আঞ্চলিক ট্যাবু ভেঙে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরের গ্রামের কাহিনি পৌঁছে গেছে পৃথিবীর সবার কাছে। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে স্যানিটারি প্যাড উৎপাদন ও ব্যবহারে সামাজিক আলোড়ন তৈরি করা কাহিনির ওপর ভিত্তি করে বানানো ডকুমেন্টারি ‘পিরিয়ড এন্ড অব সেন্টেন্স’ এ বছর সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার জিতে নিয়েছে অস্কারের মঞ্চে। তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব?
মাসিক এমনিতেই সমাজে ট্যাবু বা নিষিদ্ধ বিষয় বলে বিবেচিত। এ পণ্যের ওপর উচ্চ হারে ভ্যাট আরোপের কারণে প্যাডের মূল্য পৌঁছে গেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রয়সীমার ঊর্ধ্বে। অনেক পরিবারে নারীর জন্য মাসের কয়েকটা দিন অতিরিক্ত খরচ করার মানসিকতা আজও তৈরি হয়নি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়। ভ্যাট মওকুফ করে বরং কিছু ভর্তুকি দেওয়া উচিত সরকারি তহবিল থেকে। মাসিক যদি একটি সাধারণ শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াই হয়, তাহলে নারীকে কেন তাঁর সাধারণ শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য ভ্যাটের বোঝা বইতে হবে? স্যানিটারি প্যাডের ওপর কর মওকুফ করার কাজটি নারীদের প্রতি কোনো করুণা নয়, এটা তাঁদের অধিকার, ন্যায্য দাবি।
‘নো ভ্যাট অন স্যানিটারি ন্যাপকিন’ (স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর ভ্যাট নয়) নামে সবার উচিত একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এটা বাস্তবায়ন করতে সরকারকে দুর্গম গিরিও পদানত করতে হবে না, পাড়ি দিতে হবে না দুস্তর পারাবারও। দরকার শুধুই সদিচ্ছা। নীরবতা ভেঙে আওয়াজ তুলুন একটি নতুন ভোরের জন্য। পরিবর্তন আসবে আপনার হাত ধরেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়