একেই বলে কূটাভাষ। ‘খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল’—অযুতবিশ্রুত এই ঘুমপাড়ানি ছড়ার ভাষ্যমতে, এমন একটা সময় ছিল, যখন খাজনা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় বর্গীর ভয়ে তটস্থ থাকত মানুষ। ব্রিটিশ আমলেও গরিব প্রজাদের কাছ থেকে অত্যাচারী জমিদারেরা নিষ্ঠুরভাবে খাজনা আদায় করতেন। এখন অন্তত টাঙ্গাইলের সখীপুরের ১৪টি মৌজার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র।
এই ১৮টি মৌজার বাসিন্দারা সরকারকে খাজনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সরকার খাজনা নিচ্ছে না। সরকার যাতে খাজনা নেয়, সে জন্য জমির মালিকেরা রীতিমতো আন্দোলন কমিটি গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না। খাজনা দিতে না পারায় নামজারির পথ বন্ধ হয়ে আছে। এ কারণে জমির মালিক হয়েও তাঁরা জমি বেচতে পারছেন না। এই সমস্যার কারণে এক-দুজনকে নয়, উপজেলার কমপক্ষে এক লাখ লোককে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এক-দুই একর জমি নয়, তাঁরা তাঁদের ভোগদখলীয় প্রায় ৩৫ হাজার একর জমির খাজনা দিতে পারছেন না। সমস্যাটা এক-দুই বছরের না, দীর্ঘ ২১ বছর ধরে এ অবস্থা চলছে।
সমস্যার গভীরতা সরকার কতটা উপলব্ধি করতে পারছে, সেটা স্পষ্ট না হলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তি যে কোন পর্যায়ে গেছে, অনেকখানি পরিষ্কার হয়েছে। উত্তরাধিকারসূত্রে জমিজমার মালিক হওয়ার পরও নিজেকে পরিপূর্ণ মালিক মনে করা তাঁদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তীব্র প্রয়োজনের সময় চাইলেও যখন জমি বেচার আইনগত ক্ষমতা থাকে না, তখন নিজেকে সে জায়গার মালিক ভাবা কঠিন হয়ে পড়ে। এই জমি দেখিয়ে ঋণ নেওয়ার পথও বন্ধ হয়ে আছে। ঢাকার কাছের এলাকা হওয়ায় এখানে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু জমি কেনাবেচার সুযোগ বন্ধ থাকার কারণে কোনো কোম্পানি জায়গা কিনে এখানে কারখানা গড়তে পারছে না। আর খাজনা বন্ধ থাকায় প্রতিবছর কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
যে বিষয়টির সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা সরাসরি যুক্ত, তা দুই যুগের বেশি সময় ধরে কীভাবে অচলাবস্থায় থাকে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। খাজনা দেওয়ার দাবিতে ভূমিমালিকদের নিয়ে প্রায় দেড় যুগ আগে গঠিত আন্দোলন কমিটি হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ, অনশনসহ প্রায় সব ধরনের কর্মসূচি ইতিমধ্যে পালন করে সেরেছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে তাদের বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু আদতে কোনো কাজ হয়নি। প্রশাসনের দিক থেকে বলা হচ্ছে, একই জমিতে বন বিভাগ, ভূমি অফিস ও স্থানীয়রা মালিকানা দাবি করায় এবং সীমানা নির্ধারণ (ডিমারকেশন) না থাকায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এখন দরকার বন বিভাগ ও ভূমি কার্যালয়ের যৌথ জরিপ। জরিপ ছাড়া এর সমাধান সম্ভব নয়।
এখন কথা হচ্ছে, যদি যৌথ জরিপই সমাধানের পন্থা হয়ে থাকে, তাহলে তা শুরু করতে বাধা কোথায়? অন্তত লাখ লাখ মানুষের দিক বিবেচনা করে এই সমস্যা সমাধান করা দরকার।