ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী ও জনতুষ্টিবাদী দলগুলো ২০১৪ সালের নির্বাচনের তুলনায় সামান্য ভালো করলেও তারা যতটা ভালো করবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা ঘটেনি। এই ফলাফলে এটা বোঝা যাচ্ছে যে ইউরোপের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার এখনো অভিন্ন ইউরোপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে প্রস্তুত নন। এর আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে এই যে এই নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ ও অভিন্ন ইউরোপের পক্ষের শক্তি গ্রিন পার্টি এবং বামপন্থী দলগুলো আগের তুলনায় অনেক ভালো ফল করেছে। ৭৫১ আসনের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন ভোটারের সংখ্যার বিবেচনায় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম নির্বাচন; ২৮টি দেশের মোট ভোটারের সংখ্যা ৪০ কোটি। চার দিন ধরে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটার ভোট দিয়েছেন।
গত কয়েক বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দলগুলোর প্রধান আদর্শিক অবস্থান হচ্ছে অভিবাসন বিরোধিতা, ইসলামভীতি প্রচার এবং একধরনের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের বিস্তার। তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে তারা এমন এক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, যারা আক্ষরিক অর্থেই সব ধরনের পদক্ষেপকেই বাধাগ্রস্ত করতে পারবে। রোববার রাতে প্রকাশিত ফল থেকে দেখা যাচ্ছে, উগ্র জাতীয়তাবাদীরা সেই শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি।
এই ফলাফলে আরও দুটি বিষয় প্রকাশিত হয়েছে—প্রথমত, ইউরোপ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি পোলারাইজড বা মেরুকরণকৃত; সহজ করে বললে ইউরোপের মানুষ আদর্শিক বিবেচনায় প্রায় সমানভাবে দ্বিধা বিভক্ত। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের এত দিনের প্রচলিত বাম, ডান ও মধ্যপন্থী দলগুলো এখন আর জনগণের মনোযোগ ও আস্থার জায়গায় নেই; এই নির্বাচনে ইউরোপের ভোটাররা তাদের কার্যত প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইউরোপের ভোটাররা পরিবর্তন চান, সেই বার্তা যেমন আছে, তেমনি আছে এই বার্তা যে তাঁরা দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদীদের বিকল্প মনে করেন না। এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত (যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সময় রোববার রাত সাড়ে ১০টা) উগ্র দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীরা পেয়েছে মোট আসনের ২৪ শতাংশ। এটি ২০১৪ সালের নির্বাচনের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ বেশি।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই ফলাফলে যতটা ইতিবাচক ছবি তৈরি হয়, আলাদা আলাদা করে বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে সেই ছবি ততটা ইতিবাচক থাকে না। ইতালি এবং ফ্রান্সে জনতুষ্টিবাদী দল মাতিও সালভিনির নেতৃত্বাধীন লিগ এবং মারি লো পেনের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল র্যালি বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ব্রিটেনে নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টি প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর তুলনায় ভালো করেছে, ফারাজ নিজে পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। গ্রিসে দক্ষিণপন্থী দল নিউ ডেমোক্রেসি ক্ষমতাসীন সিরিজা পার্টির তুলনায় ১০ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছে। হাঙ্গেরিতে ক্ষমতাসীন ফিদেৎস পার্টি ২১টির মধ্যে ১৩টি আসন পেয়েছে, ভোট পেয়েছে ৫২ শতাংশ। এদের বিজয়ের অর্থ বা বার্তা কী, সেটা বোঝা যায় হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের বক্তৃতায়। নির্বাচনের পরে বুদাপেস্টে দলের সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘হাঙ্গেরির জনগণ আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে ইউরোপের সর্বত্র অভিবাসন বন্ধ করার।’ তাঁর ভাষায়, ফিদেৎস–এর দায়িত্ব হচ্ছে ‘ইউরোপে খ্রিষ্টান সংস্কৃতি রক্ষা করা’।
দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যদিও ইউরোপীয় পার্লামেন্টে খুব বেশি শক্তি প্রদর্শন করতে পারবে না, কিন্তু তারা যা করতে চাইবে তা হচ্ছে এই চাপ সৃষ্টি করা, যেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সদস্যদেশগুলোর কাছে আরও ক্ষমতা দেয়। কেননা, সেখানেই তারা আরও বেশি করে তাদের প্রভাব খাটাতে পারবে। দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের যুক্তিতে তারা এই নিয়ে চাপ দেবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই লক্ষ্যেই তারা এখন যতটা সম্ভব সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করবে। তবে এখানে স্মরণ করা দরকার যে ফ্রান্সে মারি লো পেনের দল ২০১৪ সালের তুলনায় কম ভোট পেয়েছে, যে কারণে ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সাংবাদিকেরা প্রশ্ন তুলেছেন যে ফ্রান্সে মারি লো পেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদীরা ইতিমধ্যেই তাদের সর্বোচ্চ জনসমর্থনের মাত্রায় পৌঁছেছে কি না।
নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় রাজনীতির একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। তা হচ্ছে এই সব দক্ষিণপন্থী লোকরঞ্জনবাদী উগ্রপন্থীদের আনুষ্ঠানিক ঐক্য তৈরি হয়েছে। জাতীয়তাবাদী বলে নিজেদের পরিচয় দেওয়া এই সব দল জাতীয় সীমান্তের বাইরের কোনো ধরনের সংযোগ এবং প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করলেও এবং এই ধরনের যোগাযোগকে সার্বভৌমত্বের প্রতি অবজ্ঞা বললেও নির্বাচনের আগে ইতালির ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী মাতিও সালভানির নেতৃত্বে ১৮ মে মিলানে এক সমাবেশে ১১টি দেশের দক্ষিণপন্থী দলের নেতারা সমবেত হয়েছিলেন। এই ধরনের সমাবেশ এবং আঞ্চলিক জোট গঠনের বিষয় যে তাঁদের দ্বিচারিতার প্রমাণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁদের মধ্যকার বিভিন্ন রকমের মতপার্থক্য সত্ত্বেও তাঁরা যে একত্র হয়েছেন, সেটা এক বিচারে নতুন কৌশলের ইঙ্গিত দেয়। নির্বাচনে ভালো ফলাফল না করলেও এই ধরনের সম্মিলিত চেষ্টা যে অব্যাহত থাকবে, তা অনুমান করা যায়।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদীরা ভালো ফল করেনি, এটা একধরনের আশাবাদের তৈরি করে যে এখনো এই শক্তি ইউরোপের প্রধান শক্তি নয়। কিন্তু একে সাময়িক সাফল্য বলে বিবেচনা করাই হবে বিবেচকের কাজ। কেননা, পৃথিবীজুড়ে যে রক্ষণশীলতার বিজয় ধারা চলছে, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটছে, অভিবাসনবিরোধী রাজনীতি মূলধারায় রূপান্তরিত হচ্ছে এবং কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বের উত্থান ঘটছে, তার মোকাবিলার সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা এখনো দৃশ্যমান নয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি অর্জন করা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিপদের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আর এই বিপদ কেবল ইউরোপের বিষয় নয়, ইতিমধ্যেই সংক্রামক ব্যাধির মতো তা ছড়িয়ে পড়েছে অন্যত্র। ভিন্ন ভিন্ন নামে এই ধরনের জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্ববাদ দেশে দেশে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে এবং উঠছে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর