৫ মে রোববার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের জন্য গুরুতর একটি সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। এশিয়া ফাউন্ডেশন ও পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) যৌথভাবে এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশ থেকে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমে যাচ্ছে। ২০১৬–১৭ অর্থবছরে চামড়া খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। পরের বছর তা কমে ১০৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারে নেমে আসে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে মাত্র ৭৭ কোটি ডলার। রপ্তানি এমন ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়া দুশ্চিন্তার বিষয়।
আমরা এত দিন জেনে এসেছি, আমাদের চামড়াশিল্পের সম্ভাবনা উজ্জ্বল, রপ্তানি বাড়ছে এবং সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। চামড়াজাত পণ্যগুলোর মধ্যে, বিশেষত জুতা তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানি আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে, তারা ইউরোপ–আমেরিকার বিভিন্ন দেশে জুতা রপ্তানি করছে। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি জুতার সমাদর বাড়ছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা) হিসাব দিয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়েছিল ৬ কোটি ১৪ লাখ ডলারের জুতা। চার বছরের মাথায় ২০১৮ সালে রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, সে বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ কোটি ৩২ লাখ মার্কিন ডলারের জুতা রপ্তানি করেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতেও বাংলাদেশের জুতা রপ্তানি বাড়ছে বলে গত ২৭ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
কিন্তু জুতা রপ্তানির বিষয়ে এই সুখবর ম্লান হয়ে যাচ্ছে এশিয়া ফাউন্ডেশন ও র্যাপিডের সমীক্ষার পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে। চামড়াশিল্প খাতের মোট রপ্তানি আয় ক্রমবর্ধমান হারে কমে যাওয়ার যে প্রবণতা তিন বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, তা থামিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে এ শিল্প স্থবির হয়ে পড়বে। সে রকম উদ্যোগ নিতে হলে প্রথমেই রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এ শিল্পের মালিকেরাসহ সংশ্লিষ্টরা ইতিমধ্যে প্রধান কারণটি জানেন; সেটা হলো কী প্রক্রিয়ায় ও পরিবেশে আমাদের চামড়াশিল্পের কারখানাগুলো চলছে। চামড়াশিল্পের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ, চামড়াশিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথ না হলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমাদের চামড়াজাত পণ্যের প্রধান আমদানিকারক ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান প্রভৃতি উন্নত দেশ, যারা শিল্পপণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ার কারিগরি ও সামাজিক কমপ্লায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমাদের চামড়াশিল্প খাতের রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ, এই খাত যথেষ্ট কমপ্লায়েন্স অর্জন করতে পারেনি। কমপ্লায়েন্স সমস্যার কারণে আমাদের চামড়াশিল্প লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের বৈশ্বিক সংগঠনের মানসনদ অর্জন করতে পারেনি। কোনো দেশের এই সনদ না থাকলে চামড়াজাত পণ্যের বড় ক্রেতারা সেই দেশ থেকে পণ্য ক্রয়ে উৎসাহ দেখায় না।
চামড়াশিল্পকে কমপ্লায়েন্স হতে হলে সাভারের চামড়াশিল্প নগরের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সেখানে উৎপাদিত শিল্পবর্জ্য পূর্ণ মান অনুযায়ী পরিশোধন করা হচ্ছে না, খোলা আকাশের নিচে কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) কার্যকর নয়; লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের একজন নিরীক্ষক সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে সিইটিপির বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়ে গেছেন। সে দিনের সেমিনারে শিল্পপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী মন্তব্য করেছেন, আমাদের চামড়া খাতের জন্য প্রথম কাজ হওয়া উচিত সিইটিপি কার্যকর করা।
আমরাও এ বিষয়ের ওপরই প্রধান গুরুত্ব দিতে চাই। আর সময়ক্ষেপণ না করে চামড়াশিল্পের বর্জ্য পরিশোধনের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাটি কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক।