ইসলাম সাম্যের ধর্ম। ন্যায় ও ভ্রাতৃত্ব ইসলামের মূল শিক্ষা। ইসলাম সারা দুনিয়ার সব মানুষকে একই বাবা এবং একই মায়ের সন্তান হিসেবে মনে করে এবং জন্ম ও বর্ণ দ্বারা কাউকে কোনোরূপ পার্থক্য করে না। ইসলামি শরিয়তি বিধান সব মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে। ইসলামি দর্শন মানুষের অধিকারকে তিন পর্যায়ভুক্ত করেছে। যথা: শারীরিক, আর্থিক ও সামাজিক; অর্থাৎ জীবন, সম্পদ ও সম্মান। পথশিশুদের আর্থিক অধিকার রক্ষাও সুনিশ্চিত করেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। পবিত্র কোরআনে পথশিশুদের জাকাত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কোরআন মজিদে জাকাত প্রদানের মৌলিক আটটি খাতের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত খাতটি হলো ‘পথশিশু’। আল্লাহ তাআলা বলেন: সদকা জাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তত্সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদ ও পথসন্তান (ইবনে সাবিল) বা বিপদগ্রস্ত মুসাফিরদের জন্য। এ হলো আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৬০)।
ইবন অর্থ সন্তান বা শিশু; সাবিল মানে রাস্তা বা পথ। আরবিতে ‘ইবনু সাবিল’ ফারসি ও উর্দুতে ‘ইবনে সাবিল’ মানে পথের সন্তান বা পথশিশু। সমাজের যেসব শিশু গৃহহীন, ভবঘুরে, সুবিধাবঞ্চিত, আশ্রয়হীন পথের ধারে, রাস্তাঘাটে, রেলস্টেশনে বা রেললাইনের পাশে, বাসস্টেশনে বা রাস্তার পাশে, লঞ্চঘাটে বা ফেরিঘাটে অথবা পরিত্যক্ত কোনো জায়গায় নিরাপত্তাহীন ও অসহায়ভাবে রাত যাপন করে, তারা পথশিশু। এরা আমাদের সমাজেরই অংশ। ধনীদের সম্পদে এদের নির্দিষ্ট অংশ পাওনা রয়েছে। আল–কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তাদের সম্পদে প্রাপ্য নির্ধারিত হক বা অধিকার রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের। (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৯ ও সুরা-৭০ মাআরিজ, আয়াত: ২৫)।
আজ সারা বিশ্বে শিশু ও নারী নির্যাতন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, শিশু ও নারী পাচার, অ্যাসিড নিক্ষেপ, অনৈতিক ও শ্রমসাধ্য কাজে শিশুদের ব্যবহার করে অধিক মুনাফা অর্জন এবং শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। মোমিন বা বিশ্বাসী, তথা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ কখনোই এহেন অনৈতিক কাজ, যেমন শিশুদের সঙ্গে সহিংস আচরণ, তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পাচার, হত্যা, গুম এবং শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে না। পথশিশুদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ সম্পূর্ণ ইসলামি শিক্ষার বিপরীত, অনৈতিক ও হারাম।
পথশিশুদের জন্ম নিয়ে অশোভন কথা বলা যাবে না। শিশুদের পিতা-মাতা নিয়ে আপত্তিকর কথা বলা যাবে না। শিশুদের জন্মস্থান বা এলাকা নিয়ে অসম্মানজনক কথা বলা যাবে না। পথশিশুদের বংশ, জাত, বর্ণ, পদবি নিয়ে উপহাস করা যাবে না। পথশিশুদের শারীরিক গঠন, আকার–আকৃতি ও গায়ের রং নিয়ে ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ করা যাবে না। পথশিশুদের বিশেষ কোনো স্বভাব বা মুদ্রা নিয়ে ঠাট্টা–তামাশা করা যাবে না। পথশিশুর জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো অযাচিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় উল্লেখ করে তাকে বিব্রত করা যাবে না। তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করা যাবে না।
আমরা ইমানি চেতনা, ধর্মীয় কর্তব্য, সামাজিক দায়িত্ব ও মানবিক কারণে পথশিশুদের মৌলিক অধিকার, তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করে তাদের সুনাগরিক হওয়ার পথ সুগম করে দেব। পথশিশুদের মধ্যে মেয়ে বা কন্যাশিশুরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা ও নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করতে হবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন: যার ঘর নাই আমার ঘর তার ঘর, যার বাবা নাই আমি তার পিতা, যার ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা নাই আমি তার অভিভাবক। (বায়হাকি)।
আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) এতিম ছিলেন। এতিম–অসহায় শিশুকে নিরাপত্তা দেওয়া ও সাহায্য করা নবীজিকে মহব্বত ও সম্মান করার শামিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: যে এতিম ও অসহায়কে সম্মান করল, সে আমাকেই সম্মান করল। আল্লাহ তাআলা বলেন: তুমি কি তাদের দেখেছ? যারা বিচার ও কর্মফল অবিশ্বাস করে! তারা ওরা যারা এতিমকে ধাক্কা দেয়, তারা অভাবীদের খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না। দুর্ভোগ ওই সব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজে উদাসীন; যারা লোক দেখানো কাজ করে এবং পরোপকারে বাধা সৃষ্টি করে। (সুরা-১০৭ মাউন, আয়াত: ১-৭)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com