পোশাকশ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণে শ্রম আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়ন
আলোচনায় সুপারিশ
* পোশাকশ্রমিকদের দোরগোড়ায় সহজলভ্যভাবে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে
* পোশাকশ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি নারীদের উচ্চপর্যায়ে নিয়োগ দেওয়া জরুরি
* বিভিন্ন হেল্পলাইন ব্যবহারে পোশাকশ্রমিকদের সচেতন করতে হবে
* মালিকপক্ষের আইন অনুসরণে উদ্যোগী হওয়া দরকার
* সব কারখানায় সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন
* কারখানায় ফিডিং কর্নার, চিকিৎসক ও নার্সের ব্যবস্থা করতে হবে
* পোশাকশ্রমিকদের যৌনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে কার্যকর উদে্যাগ নিতে হবে
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনাটি মূলত পোশাকশ্রমিকদের প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে। পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকেরা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করেন। তাঁদের প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকেরা কতটা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন, শ্রম আইন অনুযায়ী সুযোগ–সুবিধা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, বেতন–ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসবে। এখন এ বিষয়ে আলোচনা করবেন খালেদ আহমেদ।
খালেদ আহমেদ
স্বাধীনতার পর পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে। প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ কাজ করছেন এখানে। তাঁদের বেশির ভাগই নারী। তাঁদের গড় বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর।
এসএনভি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। এর একটি প্রকল্প ‘ওয়ার্কিং উইথ উইমেন’, যা ২০১৪ সাল থেকে কাজ করছে। আমাদের এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে নেদারল্যান্ডস দূতাবাস।
২০১৭ সাল পর্যন্ত ছিল আমাদের প্রারম্ভিক পর্যায়। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পুনরায় প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কীভাবে শ্রমিকদের দোরগোড়ায় সহজলভ্যভাবে সেবা পৌঁছানো যায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৩২ হাজার পোশাকশ্রমিক সুফল ভোগ করেছেন। বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প কার্যক্রমে ১০টি পোশাক কারখানায় ২৫ হাজার পোশাকশ্রমিকের জন্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি ২০০টি পোশাক কারখানায় সচেতনতামূলক কার্যক্রমের বিষয়ে আগ্রহী করে
তোলা হচ্ছে।
২০১৮ সালে একটি জরিপ থেকে জানা গেছে, শ্রম আইন ও নীতিমালার বিষয়ে এখনো সচেতনতার অভাব রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। পোশাকশ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার প্রত্যাশিত উন্নতি ঘটেনি।
পরিবার পরিকল্পনাসেবা, মাতৃত্বকালীন বিশেষ সেবা (আরটিআই-এসটিআই) সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণার অভাব আছে। কোথায় গেলে কী ধরনের সেবা পাওয়া যায়, এ সম্পর্কেও তাঁদের কোনো ধারণা নেই।
বিদ্যমান নীতিমালায় কারখানার অভ্যন্তরে খণ্ডকালীন চিকিৎসাসেবা চালু করা হয়েছে। কিন্তু নারীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য–সংক্রান্ত সচেতনতা এখনো অপ্রতুল।
সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ দিনের বেলায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চালু থাকে। কিন্তু শ্রমিকেরা দিনের বেলায় সেবা নিতে পারছেন না। এর ফলে তাঁরা অদক্ষ সেবাদানকারীর কাছে যেতে বাধ্য হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ চিকিৎসকের কাছে নারীরা তাঁদের সমস্যা খোলাখুলি বলতে পারছেন না।
একটি সুস্থ পোশাককর্মী বাহিনী পারে এই শিল্পের বর্তমান অগ্রযাত্রাকে টেকসই রূপ দিতে। সময় এসেছে নীতিনির্ধারকদের ভাবার।
তাহমিনা রহমান
অনেক মালিক শ্রম আইন সম্পর্কে সচেতন নন।
শ্রমিকেরা জানেন না এই কর্মক্ষেত্রে এসে তাঁদের কী ধরনের রোগ হচ্ছে। বেশির ভাগ শ্রমিক কিডনি আর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন। একটি কারখানা গড়ে তুললে সেখানে শ্রমিকের কী প্রয়োজন, সেটি আগে ভাবতে হবে।
মালিকপক্ষের নিজ উদ্যোগেই শ্রমিককে চিকিৎসকের কাছে পাঠানো উচিত। অসুস্থতার জন্য শ্রমিক কারখানার কাজে যেতে না পারলে তখন অনেক ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত হতে হয়। এটি অতীত থেকে চলমান।
এ ক্ষেত্রে পোশাকশিল্প মালিককে সচেতন হতে হবে। মালিকদের সচেতনতা এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। দিন দিন নারী শ্রমিক ঝরে যাচ্ছেন। নারী শ্রমিকদের ধরে রাখার এখনই সময়। এসএনভিকে ধন্যবাদ এ ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য। তবে এটি পর্যাপ্ত নয়, আরও সচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন।
সরকারকে দুর্বল কারখানাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ভালো কারখানাগুলো থেকে অন্যদের শিক্ষা নিতে হবে। বর্তমানে নারী শ্রমিক কমে যাচ্ছেন। কয়েক দিন আগেও মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়া নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে।
আমাদের দেশে আইন ঠিকই আছে, অনেক ক্ষেত্রে মানুষ আইন মানছে না। এ বিষয়ে আরও লেখালেখি করা প্রয়োজন।
মো. মুস্তাফিজুর রহমান
প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকের ভালো স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাভারের জিরাবোর পিএমকে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার একটি অলাভজনক হাসপাতাল। আমরা এখানে ২৪ ঘণ্টা স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কারখানার বায়ুদূষণসহ অন্যান্য কারণে কিছু রোগ হচ্ছে। এসব রোগের ব্যাপারে কারখানা কর্তৃপক্ষ খুবই উদাসীন।
কোনো গর্ভধারণই ঝুঁকিমুক্ত নয়। প্রসবের আগে ও পরে গর্ভপূর্ব ও গর্ভপরবর্তী সেবার জন্য শ্রমিকেরা আসেন না। গর্ভবতী মায়েদের সেবা প্রদানে কারখানা কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। অধিকাংশ কারখানায় মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট, নার্স, প্যারামেডিকস নেই। ফার্স্টএইড বক্সে থাকে প্যারাসিটামল আর অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট। এ দিয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা সম্ভব নয়।
অনেক ক্ষেত্রে পোশাকশ্রমিকদের যৌনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এর ফলে সিফিলিস, গনোরিয়াসহ বিভিন্ন যৌনসংক্রমণ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আবার অধিকাংশ কারখানায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নেই। এমনকি তাঁরা বাসায়ও পানি ফুটিয়ে খান না।
সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে ছয় মাস মায়ের দুধ খাওয়ানো দরকার। প্রতিটি কারখানায় ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার রাখতে হবে। অনেক সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ব্যবস্থাপত্র নেওয়ার জন্য শ্রমিকেরা রাতের বেলায় আসেন। দিনের বেলায় ছুটি পান না। অসুস্থ শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছুটি দেওয়া উচিত।
অনেক ক্ষেত্রে কারখানা ব্যবস্থাপকেরা চিকিৎসকদের ভেতরে যেতে দেন না। কারখানা পরিদর্শনে মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটদের যুক্ত করা উচিত।
মোছা. কানন খাতুন
আমি ভিনটেজ ডেনিম লিমিটেডে চাকরি করি। আমাদের এখানে যেসব স্বাস্থ্যসুবিধা দেওয়া হয়, অনেক জায়গায় সেগুলো দেওয়া হয় না।
আমাদের কারখানায় হেলথ কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। আমরা বিনা মূল্যে নির্দিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা পাই। আমরা চাই সব কারখানায় সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক।
আমাদের কারখানায় মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাস। নারী শ্রমিকেরা প্রসবকালীন ছুটি নিতে পারেন। ছুটিতে যাওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ দুই মাসের বেতন দেয়। আবার আসার পরে সনদ দেখালে দুই মাসের বেতন দেয়।
মো. আবুল হোসেন
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমাদের ব্যাপক কার্যক্রম রয়েছে। ১০৯ হেল্পলাইনের মতো বিশেষ সুবিধা চালু রয়েছে। বিভিন্ন কারখানায় আমরা এটি দেওয়ার চেষ্টা করি। প্রথমে বিরোধিতার সম্মুখীন হই। পরবর্তী সময়ে বিজিএমইএর সহায়তায় দেওয়া হয়।
কেউ নির্যাতনের শিকার হলে ‘জয়’ মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবে। এই অ্যাপের মাধ্যমে ঘটনার স্থান, কথা, এমনকি আশপাশের ছবিও চলে যাবে স্থানীয় থানা, জেলা এসপি, ডিসি ও আমাদের কাছে।
আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কোনো টেকনিক্যাল সাপোর্ট লাগলে আমরা দিতে পারি। সারা দেশে বিভিন্নভাবে পরামর্শসেবা দেওয়া হচ্ছে।
আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। আমাদের কর্মপরিকল্পনায় পোশাকশ্রমিকদের বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
হাবিবুর রহমান
আমার দেখা অনেক কারখানা আছে, যেখানে শ্রমিকেরা সঠিক চিকিৎসা পান না। অনেক জায়গায় চিকিৎসক নেই, নার্সও নেই। আমাদের কারখানায় ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা আছে। তবে আমি আগে যে কারখানায় চাকরি করতাম, সেখানে ছিল না। সব কারখানা নিজেদের ভালো দেখাতে চায়।
আগের কারখানা আমার ভালো লাগেনি। তাই দুই-তিন মাস চাকরি করে চলে এসেছিলাম। প্রায় অধিকাংশ কারখানায় মেয়েদের প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয় দেখিনি। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা কয়েক মাস বেতন পান না। অনেককে অসুস্থ হয়ে চলে যেতে হয়।
আপনাদের অনুরোধ করব, ভালো কারখানার পাশাপাশি খারাপ কারখানাগুলোর বিষয়ও যেন মানুষ জানতে পারে। অনেক মালিক এখনো সরকারের বাড়ানো বেতন কার্যকার করেননি
আশরাফুর রহমান
পোশাকশিল্পে ভালো ও খারাপ দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানই আছে। আমি ছোট-বড় অনেক কারখানা দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমার কারখানায় মাতৃত্বকালীন বা অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটি দেওয়া হয়। পোশাকশিল্প খাতের সবাইকে দায়ী করা ভুল হবে।
আমাদের প্রতিযোগী আছে ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ। আমি তাদের কিছু কারখানা ঘুরে দেখেছি।
আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা বেশ জরুরি। অধিকাংশ কারখানায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শ্রমিকেরা বাসায় গিয়ে যে পানি পান করেন, সেটা কে দেখবে? আমরা কারখানায় অনেক কিছু শেখাই। অনেক প্রশিক্ষণ হয়।
কারখানাগুলোতে প্রজননস্বাস্থ্য বা এ ধরনের বিষয়গুলো পরিচিত না। তবে আমার জানামতে মাতৃত্বকালীন বিষয়টি এখন ভালোভাবে তদারক করা হয়।
আমাদের পুরো দেশের কথা চিন্তা করা উচিত। প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে সবাইকে সচেতন করতে হবে। এটি সামাজিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। অনেক কারখানায় শুধু নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি পুরুষদেরও সচেতন করা উচিত।
তাহসিনা আহমেদ
ইউসেপ বাংলাদেশ একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর প্রায় ১৬ হাজার ছেলেমেয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাদের প্রায় ৯৮ শতাংশই বিভিন্ন কল-কারখানায় যোগ দিচ্ছে। আমরা এসএনভির একটি প্রকল্পের অংশীদার হিসেবে কাজ করছি।
পোশাকশিল্পে নারীর প্রজননস্বাস্থে্যর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে তাঁরা কারখানায় ভালোভাবে কাজ করতে পারবেন। শ্রম আইনে প্রসূতিকালে সুরক্ষার কথা থাকলেও এর সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শ্রম আইনে পরিপূর্ণ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার কথা সেভাবে বলা হয়নি। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। আইন বাস্তবায়ন কেন হচ্ছে না, কোন অন্তরায় রয়েছে, সেগুলো দেখতে হবে। এ সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি কারখানায় নারী সুপারভাইজার, নার্স ও ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তা নিয়োগ করার প্রয়োজন আছে।
এসএনভির সহযোগিতায় ইউসেপ বাংলাদেশ সালনা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানার ৬৩০ জন ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ করিয়েছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলে সমস্যাটি দূর করা সম্ভব।
শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি নারীদের উচ্চপর্যায়ে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া যায়, সেটা বিবেচনা করতে হবে। প্রচার বাড়াতে হবে এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে।
নারীদের নিজেদের অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। মনোসামাজিক কাউন্সেলিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যসেবার এ জায়গাটিতে একটি জবাবদিহির জায়গা রাখতে হবে।
ফারথিবা রাহাত খান
শ্রম আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে সচেতনতার বিষয়টিই আজ আলোচনায় বেশি এসেছে। অনেক কারখানায় ভালো কাজ হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজকে (বিলস) কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করেছি। তারা আইন সংযুক্ত সব কটি বিষয় পর্যালোচনা করে দেখছে।
আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে কী ধরনের সমাধান পাওয়া যায়, আমরা মূলত সেটা ভাবছি। হেলথ ইনস্যুরেন্সের মাধ্যমে শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে সাজেদা ফাউন্ডেশন কাজ করছে।
কারখানায় ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তা হিসেবে যাঁরা যোগদান করছেন, তাঁদের এ বিষয়ে প্রাথমিক কোনো ধারণা বা প্রশিক্ষণ নেই।
ওয়ার্কার ওয়েলবিয়িং ম্যানেজমেন্ট কোর্স চালু করা হয়েছে। ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তা নিজেদের অর্থ দিয়েও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। একদিক থেকে বলা যায়, তাঁরা সচেতন হচ্ছেন।
পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের উন্নয়নে আরও ব্যক্তি খাতকে কীভাবে সংযুক্ত করা যায়, সেটা নিয়ে এসএনভি তার ওয়ার্কিং উইথ উইমেন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর মূলত গ্রামীণ এলাকায় কাজ করে। আমরা বিজিএমইএর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। গত বছর ও এ বছর ২০০টি কারখানায় পরিবার পরিকল্পনা–সম্পর্কিত সেবা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে গ্রামীণ এলাকায়ও কাজ হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ আমাদের জানালে সেবা প্রদানের জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। আমরা বিনা মূল্যে সেবার পাশাপাশি ওষুধও দিয়ে থাকি। সিলেটে গ্রামীণ এলাকায় স্থানীয় এনজিওর মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিচ্ছি।
বস্তি বা এ ধরনের এলাকায় তারা সন্ধ্যাকালীন সেবা দিচ্ছে। ১৬৭৬৭ হেল্পলাইনের মাধ্যমে প্রজননস্বাস্থ্য, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য বা এ ধরনের প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে আমি মনে করি।
অমর চান বনিক
১৮ বছরের আগে বিয়ে না দেওয়া, মাসিকের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অনিরাপদ গর্ভপাত প্রতিরোধ ও যৌন নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার (জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স প্রজেক্ট) একটি প্রকল্প নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে ৪০ জন শিল্প পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি।
নতুন একটি হেল্পলাইন চালু হয়েছে—১৬৩৫৭। যেখানে পোশাককর্মীদের যেকোনো সমস্যা আমাদের জানালে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সমাধান করব। আমরা জানুয়ারি মাসে মাতৃকল্যাণ সুবিধা দিয়েছি ১ হাজার ৫৯১ জনকে। প্রায় ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা এ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৫৩৭টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। আমরা এভাবে কাজ করছি। ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
ফজলুল হক
শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বললেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কথা বলি না। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিধিমালায় শারীরিক নিরাপত্তা (ফিজিক্যাল সেফটি) নিয়ে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
প্রায় ৭০-৭১ শতাংশ কর্মী মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। কারখানাগুলো অনেক ভালো কাজ করলেও এ বিষয়টি বাদ পড়ে গেছে। এ সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। এই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
এ ছাড়া বিধিমালার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বিষয়টিতে ব্যাখ্যার দরকার আছে। সরকার স্কুলে মনোসামাজিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবছে। একইভাবে কলকারখানাতেও এ বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন।
এ এফ এম মতিউর রহমান
পরিবার পরিকল্পনা সমিতি (এফপিএবি) থেকে কাজ করতে গিয়ে প্রথমে আমরা বেশ কিছু কারখানায় বাধাপ্রাপ্ত হই। এসএনভির সাহায্যে শেষ পর্যন্ত টঙ্গীতে তিনটি কারখানায় ছয় হাজার নারী শ্রমিকের সঙ্গে কাজ করছি।
হেলথ ইনস্যুরেন্স–ব্যবস্থা চালু করছি। বিভিন্ন এনজিওকে যদি এর আওতায় আনা যায়, তবে ভালো হয়। ইনস্যুরেন্সের এই সেবাটি সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন এনজিও, সংস্থা ও আমরা সবাই মিলে যদি করি, তাহলে ভালো হয়।
সব কারখানায় ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা দরকার। কারণ শ্রমিকেরা এ সেবাটি পেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাঁরা নিয়মিত কাজ করতে পারবেন, কর্মদক্ষতা বাড়বে, উপস্থিতির হার বাড়বে। সর্বোপরি কারখানার আয় ভালো হবে। শ্রমিকদেরও লাভ হবে।
মো. কাওছার আলী
আমার জানামতে সাড়ে চার হাজারের বেশি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কারখানা আছে। সারা বিশ্বে ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের লিড সার্টিফিকেটে প্রথম ১০টি কারখানার মধ্যে বাংলাদেশের ৭টি পোশাক কারখানা রয়েছে।
বিজিএমইএর লক্ষ্য হলো স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রাপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা। কিন্তু আমরা এখন ৩০ বিলিয়নের কাছাকাছি আছি।
আমার কারখানাটি ২০০৬ সালে শুরু করি। এটি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের বিপরীতে। যখন শুরু করি, তখন ভালো স্বাস্থ্যসেবা চালু ছিল না। অনেক দূরে টাঙ্গাইল বা মির্জাপুর শহরে কুমুদিনী কেয়ারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রেখেছিলাম।
পরবর্তী সময়ে এসএনভি ২০১৪ সালে যুক্ত হলে তাদের সহযোগিতায় স্যাটেলাইট ক্লিনিক হিসেবে শুরু করি। বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ করছি।
আমাদের কারখানায় নারী শ্রমিকদের মাত্র ১০ টাকা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করা হয়। আমাদের নারী শ্রমিক বর্তমানে সাড়ে ৫ হাজারের মতো। কিন্তু ১ হাজার ৫০০–এর বেশি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহৃত হচ্ছে না। আমরা চাই সব মেয়েই এটা ব্যবহার করুক। এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। এমন বেশ কিছু জায়গায় সচেতনতার অভাব দেখা যাচ্ছে।
আমাদের মতো যারা মালিকপক্ষ আছে, তারা এসব সহযোগিতা করতে চাচ্ছে। কারণ, এটা না করে উপায়ও নেই। আমাদের টেকসই হতে হলে এটা করতে হবে।
এমনকি আমাদের ক্রেতাদেরও চাপ আছে এসব বিষয়ে। এসব ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সবার একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।
মো. মুজিবুল হক
কাউকে দোষারোপ করে লাভ নেই। আমাদের পোশাকশিল্পের যাত্রা অনেক দিনের নয়। মালিক–শ্রমিক সবাই যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করা যায়, তাহলে সফল হব।
মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে প্রথমে একটি প্রশ্ন ছিল। যদি মালিক শ্রমিককে ছুটি দিতে না পারেন, তবে কী হবে? আমরা সেটি দেখার পর জরিমানার একটি ধারা যুক্ত করেছি। সরকার বিষয়গুলো নিয়ে সজাগ আছে।
এখন কারখানার পরিবেশ ভালো হচ্ছে। তবে কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আসলে যেসব কলকারখানা চলে না, শ্রমিককে বেতন দিতে পারে না, সেগুলো বন্ধ হওয়াই উচিত।
কাজ করে বেতন না পাওয়ার চেয়ে কাজ না করাই ভালো। একদিকে কারখানা বন্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন কারখানা গড়ে উঠছে।
একজন পোশাকশ্রমিক ১০ থেকে ১৫ বছর কাজ করেন। তারপর তাঁরা কোথায় যান, সেই চিন্তা আমাদের শ্রমিকনেতারা করেন না। পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হলেও তাঁরা সংগঠিত নন। নারী শ্রমিকদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো নারী শ্রমিক ইউনিয়ন হয়নি। আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে মালিকপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তাদের লেখাপড়ার জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে।
কোনো শ্রমিক কর্মস্থলে বা কারখানায় আসা–যওয়ার পথে মারা গেলে মালিকের ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি কল্যাণ তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা পাবেন। পোশাকশ্রমিকের সন্তান যদি সরকারি মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে পড়েন, তাঁদের তিন লাখ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকদের সন্তান যারা এসএসসিতে জিপিএ–৪.৫–এর ওপরে পেয়েছে, তাদের লেখাপড়ার জন্য ২৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে।
অনেক কারখানায় চিকিৎসকের সুবিধা, ফিডিং কর্নার আমি নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছি। যাদের ব্যবসা ভালো না, অর্ডার পায় না, আবার ফ্যাক্টরি বন্ধও করতে পারে না, তাদের জন্য সমস্যা হচ্ছে।
আজকের আলোচনাটা বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে। মালিকদের কোনো সমস্যা থাকলে সরকারকে বলেন। আমরা সমাধানের চেষ্টা করব।
দেশটা আমাদের। প্রত্যেকে প্রত্যেকের দায়িত্ব পালন করলেই আইন বাস্তবায়িত হবে। অনেক নারী তাঁদের শ্রম দিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিভাগে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছি। তাঁদের জন্য আমরা মাতৃত্বকালীন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক যতটুকু কাজ করা দরকার, সরকার তা করবে।
আব্দুল কাইয়ুম
পোশাকশিল্পে অধিকাংশই নারী শ্রমিক। তাঁদের প্রজননস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে উৎপাদন বাড়বে। এটা মালিকসহ সবার জন্য কল্যাণকর। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
যাঁরা অংশ নিলেন
মো. মুজিবুল হক: সাংসদ, চেয়ারম্যান, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
অমর চান বনিক: অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (যুগ্ম সচিব), কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর
মো. আবুল হোসেন: প্রকল্প পরিচালক (উপসচিব), মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম অন ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ: উপপরিচালক (সার্ভিসেস), এমসিএইচ সার্ভিসেস ইউনিট, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
ফারথিবা রাহাত খান: টিম লিডার, ওয়ার্কিং উইথ উইমেন, এসএনভি
তাহসিনা আহমেদ: নির্বাহী পরিচালক, ইউসেপ বাংলাদেশ
মো. মুস্তাফিজুর রহমান: পরিচালক, পিএমকে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জিরাবো, সাভার
আশরাফুর রহমান: চিফ অপারেটিং অফিসার, মিলেনিয়াম টেক্সটাইল (সাউদার্ন লিমিটেড)
এ এফ এম মতিউর রহমান: নির্বাহী পরিচালক, এফপিএবি
মো. কাওছার আলী: চিফ অপারেটিং অফিসার, কমফিট কম্পোজিট নিট লি., মির্জাপুর, টাঙ্গাইল
তাহমিনা রহমান: জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ অ্যাপারেলস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন
হাবিবুর রহমান: ইনপুটম্যান, ডেনিম ভিনটেজ লিমিটেড
মোছা. কানন খাতুন: শ্রমিক প্রতিনিধি, ডেনিম ভিনটেজ লিমিটেড
ফজলুল হক: ঊর্ধ্বতন পরিচালক, সাজেদা ফাউন্ডেশন
খালেদ আহমেদ: ঊর্ধ্বতন যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য (এসআরএইচআর) বিশেষজ্ঞ, এসএনভি
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো