আরব বসন্তের দ্বিতীয় ঢেউ আসছে?
এক দশক আগে আরব বিশ্বে যে বসন্তের ঢেউ লেগেছিল, তা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন আবার যেন সেই স্লোগান শোনা যাচ্ছে। আরব বসন্তের সেই পরিচিত স্লোগান ‘শাসকের বদল চাই’ শোনা যাচ্ছে কান পাতলেই। আরব বসন্তের দ্বিতীয় ঢেউ যে লেগেছে, আলজেরিয়ার ঘটনায় ইতিমধ্যে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আলজেরিয়ার মানুষ আবদেলআজিজ বুতেফ্লিকার শাসনের অবসান চেয়েছে। তাঁদের চাওয়া পূরণ হয়েছে। আর তাদের এই ‘পরিবর্তন স্পৃহা’ ছড়িয়ে পড়েছে সুদানেও, যেখানে তিন মাস ধরে চলা আন্দোলন কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে দেশটির তিন দশকের শাসক ওমর আল-বশিরের বুকে। সুশাসনের দাবি ক্রমেই কণ্ঠ খুঁজে পাচ্ছে ইরাক, জর্ডান, লেবানন, মরক্কো, তিউনিসিয়া ও ফিলিস্তিনেও। আরব অঞ্চলের কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধের পাঁচ বছরের মাথায় সেখানকার রাস্তা আবারও পরিবর্তনের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠছে, যাকে দেখা হচ্ছে আরব বসন্তের দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে।
তবে ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, আলজেরিয়া ও সুদানের আন্দোলনকে এখনই হয়তো আরব বসন্ত বলা যায় না। কিন্তু এটি আরেকটি আরব বসন্তের সূচনাবিন্দু হতে পারে। কারণ, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অবস্থা আগের চেয়ে ভালো তো হয়ইনি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনমন হয়েছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অবস্থা ২০১১ সালের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এই দেশগুলোর কাঠামো এখনো বিদ্রোহ দানা বাধার জন্য অনুকূল। দুই বছর ধরেই জর্ডান, ইরাক, তিউনিসিয়া ও ইরানে দুর্নীতিবিরোধী ও সরকারবিরোধী একটি জনমত দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে।
প্রায় এক দশক আগে ২০১১ সালে আরবের সড়ক উত্তাল হয়ে উঠেছিল পরিবর্তনের দাবিতে। সে সময় গণমানুষের এই আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। সুনির্দিষ্ট কোনো নেতৃত্বহীন ওই আন্দোলনে ছিল সমাজের প্রায় সব শ্রেণির অংশগ্রহণ। আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিল শাসকগোষ্ঠীর ওপর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। সেই একই ক্ষোভ এবারও আরব অঞ্চলকে অস্থির করে তুলেছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের পরবর্তী ঘটনাক্রম পরিবর্তনকামী ও তাদের সহযোগী গোষ্ঠীকে অনেকটা নির্জীব করে তুলেছিল। যুদ্ধ, লাগাতার অস্থিরতা ও কাঙ্ক্ষিত ফললাভ করতে না পারা তাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। আর এই সুযোগে একনায়কেরা তাদের দমন ও নির্যাতনের উপায়গুলোকে আরও ধারালো ও কার্যকর করেছে। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্ক লিঞ্চের মতে, এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের শাসকেরা পরস্পরের প্রতি বেশ সহযোগিতাপূর্ণ বলা যায়। তাঁরা শুধু নিজ দেশে আন্দোলন থামানোতেই নন, অন্য কোনো দেশে এর ঢেউ যেন না লাগে, সে ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছেন। পুরো অঞ্চলই আরেকটি আরব বসন্ত থেকে রক্ষা পেতে উদ্গ্রীব।
গত কয়েক সপ্তাহে আরব অঞ্চলে আবারও গণ-আন্দোলনের ঢেউ দেখা যাচ্ছে, যা সময়ের সঙ্গে তীব্র হচ্ছে। সুদানে ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে তিন মাস ধরে চলা আন্দোলনের কারণে এক বছরের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এতে আন্দোলন দমেনি। আর আলজেরিয়ায় আন্দোলনের বয়স তিন সপ্তাহ। আন্দোলনের লক্ষ্য—আবদেলআজিজ বুতেফ্লিকার শাসনের অবসান। আন্দোলনের মুখে মঙ্গলবার তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুদানে ওমর আল-বশির জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না। বরং পরিস্থিতি ক্রমেই তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অনেকেই এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর তিন দশকের শাসনের অবসান দেখতে পাচ্ছেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে শক্তি দিয়ে আন্দোলন দমনের যে পথ তিনি নিয়েছেন, তাকেই তাঁর শাসনাবসানের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ, আরব বসন্তের প্রথম ঢেউয়ে শক্তি প্রয়োগে যারাই আন্দোলন দমনের পথ নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় সবারই পতন হয়েছিল। আর আলজেরিয়ার শাসক বুতেফ্লিকা পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় বসার স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থা এতটাই বাজে যে, তা আন্দোলনকারীদের মনোবল জোগায়। ২০১৩ সাল থেকেই তিনি হুইলচেয়ারের চলাফেরা করেন। গত সাত বছরে তিনি জনতার মুখোমুখি হননি। তাঁর শাসন গত কয়েক বছরে পুরোপুরি সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
প্রথমবারের চেয়ে আরব বসন্তের এই দ্বিতীয় ঢেউ এর প্রচারের দিক থেকে আলাদা। আগের মতো গণমাধ্যমের প্রচার পাচ্ছে না এবারের আন্দোলনগুলো। এর কারণও রয়েছে ওই প্রথম আরব বসন্তের ফলের মধ্যে। প্রথম আরব বসন্তে তুলনামূলক নিরাপদ ছিল ইরান, তুরস্ক ও কাতারের শাসকেরা। মনে করা হয়, প্রথম আরব বসন্তের সুফলভোগীদের দলে ছিল তারা। কিন্তু এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। কারণ, তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এরই মধ্যে একটি অভ্যুত্থান–প্রচেষ্টা সামলেছেন। কাতার রয়েছে অবরোধের মধ্যে। দেশটির নিজস্ব নিরাপত্তাঝুঁকিও রয়েছে। ফলে, সুদান ও আলজেরিয়ায় চলমান ঘটনাক্রম নিয়ে কাতার এখনো নিশ্চুপ। ইরান আবারও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে। ফলে, জনরোষ তৈরি হচ্ছে ভেতরে-ভেতরে। বিশেষত, আরব বসন্ত যখন মিত্রদেশ সিরিয়ায় গিয়ে পৌঁছাল, তখন থেকেই ইরান সতর্ক অবস্থানে চলে যায়।
কিন্তু আট বছর আগে অবস্থা এমন ছিল না। আট বছর আগে কাতারভিত্তিক সম্প্রচার চ্যানেল আল-জাজিরা হয়ে উঠেছিল আরব বসন্তের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রচারকেন্দ্র। কিন্তু এবার আরব বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল দুই দেশে চলমান বিক্ষোভ নিয়ে তারা নিশ্চুপ। তারা চলমান এই আন্দোলনকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করছে। এর কারণ আছে। আরব বসন্তের পর প্রতিটি দেশ সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে। কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের ক্ষেত্রে সৌদি নেতৃত্বাধীন চার দেশ যে ১৩টি শর্ত দিয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে আল-জাজিরা বন্ধ করা। আরব অঞ্চলের প্রতিটি দেশে সংবাদপত্র ভীষণভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। দেশগুলোর তথ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দিচ্ছে সংবাদ শিরোনাম। নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বিদেশি সাংবাদিকদের। আর স্থানীয়দের এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ টানা যায়। কতটা মরিয়া হলে এই সাংবাদিককে অন্য একটি দেশের (তুরস্কের) সৌদি কনস্যুলেটে ঢুকে হত্যা করা হয়। আর হত্যার প্রক্রিয়াটি গণমাধ্যমের সুবাদে এখন কমবেশি সবাই জানেন।
তারপরও থেমে থাকেনি আন্দোলন। ইকোনমিস্ট বলছে, আগেরবারের মতো এবারও অন্যতম চালিকা শক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আরব বিশ্বের মধ্যে আলজেরিয়ায় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দেশটির শাসকগোষ্ঠী আবার প্রযুক্তিবান্ধবও কিছুটা। এই দুইয়ের মিলনে সেখানে আন্দোলন দানা বাঁধতে ও তা ছড়িয়ে দিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তবে এবারে আন্দোলনকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলন জনপ্রিয় করতে কিছুটা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। কারণ, এখনো তারা কোনো জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ চালু করতে পারেনি, যা ভাইরাল হবে। বিপরীতে সৌদি আরবের মতো দেশগুলোয় শাসকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই তাদের অস্ত্র বানিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে প্রচুর ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সরকারি বয়ানকেই ভাইরাল করা হচ্ছে। পাশাপাশি চলছে প্রযুক্তির প্রয়োগে গোয়েন্দাগিরি, হ্যাকিং থেকে শুরু করে নানা কার্যক্রম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট শুধু নয়, কমেন্ট বা লাইকের সূত্র ধরেও চলছে গ্রেপ্তার, যা আন্দোলনকারীদের আতঙ্কিত করছে। ফলে, আন্দোলনের গতি ধীর হচ্ছে, যা মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে সময় দিচ্ছে শাসকদের।
শাসকেরা আন্দোলন দমনে প্রযুক্তিকেই কাজে লাগাচ্ছে এমন নয়; পুরোনো দমনমূলক পন্থাও তারা কাজে লাগাচ্ছে। মিডলইস্ট মনিটরের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরেই মিসরে হলুদ জ্যাকেট বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ফ্রান্সে ছড়িয়ে পড়া হলুদ জ্যাকেট আন্দোলনের অনুকরণে যেন মিসরে কোনো আন্দোলন তৈরি না হয়, সে জন্য স্বয়ং দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বিরোধী রাজনীতিকদের কারাগারে পাঠানো থেকে শুরু করে হত্যা পর্যন্ত—নিপীড়নের সব পুরোনো পন্থাই আরব দেশগুলোর শাসকেরা অনুসরণ করছেন। অনেক দেশই বড় জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
প্রথম আরব বসন্তের পর আরব অঞ্চলের প্রতিটি দেশ নতুন নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে, যা অস্পষ্টতায় পরিপূর্ণ। এই আইন প্রয়োগ করে যেকোনো আন্দোলন বা ক্ষোভকে দমনের নীতি নিয়েছে অঞ্চলটির একনায়কেরা। শুধু আরব বিশ্ব কেন, প্রায় এক দশক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শক্তির প্রদর্শনের পর বিশ্বের বহু দেশেই ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে এমন কিছু অস্পষ্ট আইন করা হয়েছে, যা দিয়ে যেকোনো প্রতিবাদের কণ্ঠকে রুদ্ধ করা সম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসকগোষ্ঠী এই আইনগুলোকে তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে ছোট ছোট প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষ নিজের ভেতরে তৈরি হওয়া সরকারবিরোধী যেকোনো মতই গিলে ফেলতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে এক স্বনিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে। কিন্তু তারপরও আন্দোলন থেমে নেই।
আলজেরিয়া ও সুদানের বিক্ষোভকারীরা পারস্পরিক যোগাযোগে পিছিয়ে থাকলেও তারা অনেকটা সুশৃঙ্খল। তারা সচেতনভাবেই সহিংসতার পথ এড়িয়ে চলেছে। তাদের স্পষ্ট কথা, ‘আমরা সিরিয়া বা লিবিয়া নই।’ অর্থাৎ সহিংসতা তাদের পথ নয়। যদিও আলজেরিয়ায় এরই মধ্যে ৫০-এর বেশি আন্দোলনকারীকে হত্যা এবং সুদানে কয়েক হাজার বিরোধীকে অন্তরীণ করা হয়েছে বলে খবর এসেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। শেষ পর্যন্ত আন্দোলন কতটা অহিংস থাকে, তা-ই এখন দেখার বিষয়। মনে থাকার কথা যে প্রথম আরব বসন্তেও আন্দোলন শুরু হয়েছিল অহিংসভাবেই।
ফজলুল কবির: সাংবাদিক