সবার ধারণা, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। সেই লক্ষ্য হলো ‘রাশিয়াকে আবার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী করতে হবে’। ২০১২ সালে ক্রেমলিনে আবার ফিরে আসার পর তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বৈশ্বিক কূটনীতির আসরের সবচেয়ে সম্মানজনক চেয়ারগুলোর একটির দখল নিতে চেয়েছেন। পুতিনের চেষ্টা বৃথা যায়নি। সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে তিনি অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে তিনি রাশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম পাওয়ারব্রোকার হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছেন।
সিরিয়ার উত্তর–পূর্ব অঞ্চল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেনা সরানোর ঘোষণার পর সেখানকার নতুন পরিস্থিতি নিজের কবজায় নিতে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিমত্তা দেখানো ভ্লাদিমির পুতিন এখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। তিনি চাইছেন তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করবেন। আসতানা শান্তি প্রক্রিয়া নামে দুই বছর আগে একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যার মাধ্যমে সিরিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থামানোর একটি কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছিল। আসতানা শান্তি প্রক্রিয়ার দুই বছর পূরণের সময়টাতে এই তিন নেতার সম্মেলন হয়ে গেল। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো এই শান্তি ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। আস্তানা শান্তি প্রক্রিয়ার ধরন দেখে এটি মনে করা অমূলক নয় যে বিশ্ব শক্তির গতিধারায় একটি নতুন বাঁক তৈরি হয়েছে। এটি একটি অ-পশ্চিমা বৃহৎ শক্তি। রাশিয়া, চীন, ভারতের মতো অ-পশ্চিমা দেশগুলোই এর নেতৃত্বে রয়েছে।
কয়েক বছর ধরে পুতিন পশ্চিমাদের সঙ্গে বাদানুবাদ এড়িয়ে চলেছেন, তা মোটেও নয়। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে পশ্চিমাদের পক্ষে থেকেছেন। নাইন–ইলেভেন পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করেছেন, এমনকি ন্যাটোয় রাশিয়ার যোগ দেওয়ার বিষয়ে দালালি পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু ২০০৭ সালে মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে দেওয়া বক্তব্যে পুতিন তাঁর আগের অবস্থান থেকে পুরোপুরি সরে আসেন। ওই ভাষণে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য পশ্চিমা দেশগুলো একজোট হয়ে সমগ্র সাবেক সোভিয়েত ভূমিতে ‘কালার রেভল্যুশন’ উসকে দিয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্ত করেছে।
২০১০-১১ সালের আরব বসন্তের পর পুতিনের আশঙ্কা সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। ওই সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ায় নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করে একটি প্রস্তাব পাস করে এবং এর পরপরই ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের বিমানবাহিনী লিবিয়ায় অভিযান চালানো শুরু করে। পরিণতিতে গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হন। ওই সময় পুতিন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেব নিরাপত্তা পরিষদের ওই প্রস্তাবে ভেটো না দেওয়ায় পুতিন সে সময় প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করেছিলেন। তবে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেওয়ার পর পশ্চিমাদের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক স্থায়ীভাবে তিক্ত হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এর জের ধরে রাশিয়ার ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং পুতিনও তাদের তীব্র নিন্দা জানান। সেই বৈরিতা আজও মেটেনি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়াকে খুব গন্ডগোল করা অংশীদার মনে করলেও একেবারে শত্রুদেশ ভাবেনি। এখন পেন্টাগনের খাতায় রাশিয়াকে চীনের মতোই হুমকি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো সেনা মোতায়েন করেছে, যাতে রাশিয়া তার সীমানার বাইরে অতিরিক্ত আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে।
এর বাইরেও পশ্চিমারা রাশিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখে। তাদের আশঙ্কা, রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে তাদের ব্ল্যাকমেল করতে পারে, তাদের দেশে সাইবার হামলা চালাতে পারে এবং পশ্চিমা দেশের ক্ষমতাসীনদের সরাতে জনতুষ্টিবাদী ও দক্ষিণপন্থীদের হাতে সরকারের জন্য ক্ষতিকর তথ্য-উপাত্ত তুলে দিতে পারে। রাশিয়ার পক্ষে যে সেটি করা অসম্ভব নয়, তা যুক্তরাষ্ট্রের গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রমাণ হয়ে গেছে। ইইউ ইতিমধ্যেই বলা শুরু করেছে তাদের ভূখণ্ডে পূর্ব দেশীয় মদদে সরকারবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠছে। তবে রাশিয়া কিন্তু আদতে যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউর দেশগুলোর মতো আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ নয়। রাশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন ১৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৮ শতাংশের সমান। এই সীমাবদ্ধ সম্পদ নিয়েই রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আর এটি শুধু পুতিনের চৌকস মেধার কারণেই সম্ভব হয়েছে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
দিমিতার বেশেভ: আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো