রাষ্ট্র, হারকিউলিস ও আমাদের মেয়েরা
বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে এক রোমান দেবতা চষে বেড়াচ্ছে ইদানীং। তার নাম হারকিউলিস, পৌরাণিক গ্রিক দেবতা হেরাক্লিস রোমে গিয়ে আত্মীকরণের মাধ্যমে হয়ে ওঠে হারকিউলিস। দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য বিখ্যাত এই মানুষ এবং পরে দেবতার মর্যাদা পাওয়া চরিত্রটি বাংলাদেশে এসে নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে ধর্ষকদের বিচারের দায়িত্ব। বিচার বলতে হত্যা। কথা হচ্ছে এই হারকিউলিসই যে ধর্ষকদের শাস্তি দিচ্ছে, তা কী করে নিশ্চিত হওয়া গেল? তাকে তো কেউ কখনো দেখেনি। হ্যাঁ, তাকে দেখেনি কেউ। কিন্তু শাস্তি দেওয়ার পর এই চরিত্র নিজের নামাঙ্কিত একটি চিরকুট রেখে যাচ্ছে, যেখানে ওই শাস্তির কারণও লেখা থাকছে।
চরিত্রটির নাম হারকিউলিস না হয়ে অন্য কিছুও হতে পারত। ডার্ক জাস্টিস কিংবা এমন যেকোনো কিছু। যেকোনো নামেই এই চরিত্র অপরাধীদের শাস্তির বিধান করতে পারত। কারণ, এই শাস্তির বিধান করাটা জনচাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তাকে আসতেই হতো। অনেকটা চাহিদা ও জোগানের সূত্র মেনেই বাংলাদেশে হারকিউলিস চরিত্রটি আবির্ভূত হয়েছে।
কথা হচ্ছে চাহিদাটি কেন, কীভাবে জন্ম নিল? ঘরে চাল না থাকলেই চালের চাহিদা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক হিসাব। তার মানে বাংলাদেশে বিচারহীনতা আছে এবং এই সূত্রেই চাহিদাটি তৈরি হয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, এই হারকিউলিস চরিত্রটি সব অপরাধের শাস্তি বিধান করছে না। একটি বিশেষ অপরাধের শাস্তিই দিচ্ছে সে। আর সে অপরাধটি হচ্ছে ‘ধর্ষণ’। নারীর বিরুদ্ধে হওয়া এ ভয়াবহ অপরাধের বিচারের কাজ নিজের হাতে তুলে নেওয়ায় বিস্তর বাহবাও কুড়াচ্ছে চরিত্রটি। এর অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের বিচার হচ্ছে না। বিচার যে হচ্ছে না তার প্রমাণও রয়েছে। প্রথম আলোয় গত বছর প্রকাশিত প্রতিবেদনেই এ প্রমাণ হাজির করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে নির্যাতনের দায়ের করা মামলায় শাস্তির হার মাত্র ৩ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি বিচার শেষে নিষ্কৃতি পায়। এই নিষ্কৃতি পাওয়া আসামিদের একটি বড় অংশই পরে অভিযোগকারীর জন্য শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচার না হওয়া তাই নানাভাবেই এ ধরনের অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। ফলে সমাজের সর্বস্তরে এ বিষয়ে একটি ক্ষোভ দানা বেঁধে আছে অনেক দিন হলো। হারকিউলিস চরিত্রটি হাজির হয়েছে এই ক্ষোভ প্রশমনের উপায় হিসেবে। কথা হচ্ছে কার বিরুদ্ধে ক্ষোভ? প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ এককথায় পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর। সে বিবেচনায় এই হারকিউলিস চরিত্রটি আদতে প্রশাসনেরই উপকারেই আসছে। প্রশাসনও এই ‘রহস্যজনক’ চরিত্রটির শুলুক সন্ধানে তৎপর না হয়ে এই উপকার স্বীকার করছে।
ঢাকাই সিনেমার শেষ দৃশ্যে নায়ক খল বাহিনীকে একাই ধসিয়ে দেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রবেশ ঘটে। পুলিশের বড় কর্তা তখন পরিচালকের নির্দেশ মেনে বলেন, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ এই কথা শুনে সেই নায়কও ক্রোধ সংবরণ করে চূড়ান্ত হত্যাটি থেকে বিরত হয়। এই দৃশ্যের বহুল ব্যবহার নিয়ে নানা হাস্যরস ও সমালোচনা থাকলেও দর্শক কিন্তু একটি স্বস্তি নিয়েই হল থেকে বের হয়। বহু ব্যবহারেও এটি ঠিক মলিন হয় না। কারণ—তার মধ্যে থাকা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। সাধারণ দর্শক তার জীবনে ঘটে চলা নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন নায়ককে দাঁড়াতে দেখে হাততালি দেয়। হোক না তা সিনেমার পর্দায়। এই হাততালিই তাকে আরও কিছুদিন শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। সে স্বপ্ন দেখে নায়ক হবে, কিন্তু হতে পারে না। নায়কের ডামি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর এসব আপাত–শুশ্রূষার মাধ্যমে সে একটু একটু করে নত হয় নিজের অজান্তেই। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নামার বদলে সে ব্র্যাকেটবন্দী হয়। এদিকে শেষ দৃশ্যে নায়কের নিবৃত্তির মধ্য দিয়ে বিচার, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের অন্য অপরিহার্য অঙ্গগুলোও একধরনের স্বস্তি পায়। যাক, আইনের শাসনকেও বিজয়ী দেখানো গেল। ঠিক একই পন্থায় আইন নিজের হাতে তুলে নিলেও হারকিউলিসকে এখনো কেউ বলেনি, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ কারণ, আর কিছুই নয়। এই চরিত্র রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোকেই স্বস্তি দিচ্ছে। জনতার ক্ষোভ লাঘব করছে তাকে ব্র্যাকেটবন্দী করে।
আধুনিক পুঁজির রাষ্ট্র তত দিনই ‘হিরো’ দিয়ে কাজ চালায়, যত দিন তার সুপারহিরোর প্রয়োজন না পড়ছে। বিশ্ব চলচ্চিত্রে সুপারহিরোদের আবির্ভাব ১৯৩০-এর দশকে। খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় এটি। মহামন্দা। অর্থনৈতিক এই মহামন্দার সময় বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় থাকা দেশগুলোর মানুষদের হতাশা লাঘব ও আইনের শাসন পাইয়ে দিতে এই সুপারহিরোদের আবির্ভাব অবধারিত ছিল। রাষ্ট্র জনতার ক্ষোভ থেকে নিজেকে বাঁচাতে এই সুপারহিরোদের সামনে নিয়ে আসতে সে সময় পরোক্ষে প্রণোদনা দিয়েছিল। বর্তমান সময়ে এসে এই প্রণোদনা আর পরোক্ষ নেই। এটা এখন সরাসরি। পুঁজি ও এর নির্মিত রাষ্ট্রকাঠামো যে বৈষম্যের সমাজ নির্মাণ করে, তা থেকে সাধারণের চোখ ফেরাতেই সুপারহিরোদের চমৎকারিত্ব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও এরই প্রয়োজন হয়েছে।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে এনেছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ–ও এক সুপারহিরো। সাধারণ পুলিশ বাহিনীর চেয়ে তাদের পোশাক, চলন-বলন, চোখে থাকা কালো চশমা, মাথায় বাঁধা কালো কাপড় একটা নায়কোচিত ইমেজ নিয়ে এল। বলা হলো, এই বিশেষায়িত বাহিনী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নির্মূল করবে। জনগণ দেখল, অভিযান মানেই ক্রসফায়ার, যা এখন বন্দুকযুদ্ধ। এই বন্দুকযুদ্ধের গল্পটি পরে পুলিশ বাহিনীও গ্রহণ করল। নানা বিশেষায়িত বাহিনী দাঁড়াল। বন্দুকযুদ্ধ বিস্তার পেল। শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে, সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক নেতা-পাতি নেতা, মাদক ব্যবসায়ী ইত্যাদি হয়ে সে দারুণ বিস্তার পেল। কিন্তু মানুষ ঠিক স্বস্তি পেল না। শুরুর তালির আওয়াজ মিলিয়ে গেল, আরও হাজার অপরাধের বৃত্তে। যেকোনো কিছুতেই হঠাৎ করে বিচারকের আসনে চেপে বসতে অভ্যস্ত বাংলাদেশের অঢেল বিজ্ঞ ব্যক্তিও একসময় বলতে বাধ্য হলো, ‘না, এ কোনো সমাধান নয়’। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা, কক্সবাজারের একরামুল ইত্যাদি নানা ঘটনায় আমজনতার কাছেও বিষয়টি আবেদন হারাল। তাই নতুন গল্পের প্রয়োজন পড়ল। প্রয়োজন পড়ল নতুন উত্তেজনা ও নায়কের। অনেকটা ব্যাটম্যান থেকে সুপারম্যানের গল্পে সুইচ করার মতো করেই দৃশ্যপটে হাজির হলো হারকিউলিস। হারকিউলিস তাই চাহিদার নির্মাণ।
কার চাহিদা? জনতার? না, ভুল হবে এটা বললে। কারণ, জনতার চাহিদা অপরাধের ন্যায়বিচার। জনগণের চাহিদা হচ্ছে এ দেশের শিশু ও নারীরা যেন নিরাপদে থাকে। কোনো কিছুই যেন তাদের নির্যাতনের অজুহাত হিসেবে দাঁড়াতে না পারে। একটা নিরাপদ সমাজ, যেখানে আমাদের মেয়েরা নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে, যেখানে কোনো তিন বছরের শিশুকে ‘ধর্ষণ’ শেষে বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলা হবে না। উৎসবে গিয়ে কোনো তরুণী লাঞ্ছিত হবে না। ঘর থেকে বাহির—সবটা নিরাপদ থাকবে, সবার জন্য। কোনো অপরাধ হলে, অপরাধী যে-ই হোক তার নামে মামলা নেওয়া হবে। বিচার বিলম্বিত হবে না। ফাস্ট ট্র্যাক ফাস্ট ট্র্যাকের মতোই কাজ করবে। পুলিশ প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ জনগণের হয়ে জনগণের জন্যই কাজ করবে। আর এই চাহিদা পূরণ না হলে জনগণ ক্ষুব্ধ হবে। হচ্ছেও। আর এই ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ থেকেই তৈরি হচ্ছে আরেকটি চাহিদা। সে চাহিদা রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো এই যাবতীয় চাহিদাকে পাশ কাটাতে, সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে পথ খুঁজছে। আর এই পথেই এসে চাহিদামাফিক এসে দাঁড়িয়েছে হারকিউলিস, যে জনতার ক্ষোভ প্রশমনের মাধ্যমে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে। হারকিউলিস মূলত সাধারণ মানুষের ক্ষতের ওপর এক মামুলি পট্টি।
হারকিউলিস যে রাষ্ট্রের চাহিদা থেকেই জন্ম নেওয়া, তা তার রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্রয়ই বলে দেয়। ‘হারকিউলিস যদি কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা তার কোনো প্রকল্প না–ও হয়’, তবু বলা যায়, এটি এমন এক চরিত্র, যাকে রাষ্ট্র চাইছে আরও কিছুকাল খেলে যাক। হারকিউলিস তার কার্যক্রম দিয়ে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে ঢেকে দিক—এটাই তার মূল চাওয়া। আর অগণিত বনে যাওয়া বিচারক হাততালি দিচ্ছে। চমকজাগানো এই ‘ডার্ক জাস্টিস’কে বরণ করে নিচ্ছে। কিন্তু এটা মনে রাখা প্রয়োজন, ‘ডার্ক জাস্টিস’ আসলে ডার্ক জাস্টিসই। এ পন্থায় ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় না। এটা বৃহত্তর অপরাধীকে আড়াল করারও একটি পন্থা। তাই এই হারকিউলিসের পরিচয় উদ্ঘাটন জরুরি। জরুরি তাকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে সমস্যাকে আইন দ্বারাই মোকাবিলা করা। শেষ দৃশ্যে, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’ বলে সিনেমার নায়ককে নিবৃত্ত করা যায়, কৃত্রিমভাবে আইনের শাসনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা যায়, কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। করা যে যায় না তার প্রমাণ প্রতিনিয়ত ঘটে চলা নানা অপরাধ, হত্যা, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, মাদকের প্রসার। প্রায় দুই দশক আগে বন্দুকযুদ্ধের দাওয়াই এনেও এগুলো কমানো যায়নি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিচারবহির্ভূতই। এটি রাষ্ট্রকে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ থেকে সাময়িকভাবে বাঁচাতে পারলেও কখনোই নিরাপদ সমাজ গড়তে পারে না।
ফজলুল কবির: সাংবাদিক
ইমেইল: [email protected]