আওয়ামী লীগের ঘরে দুটো জানালা আছে। একটি হলো ১৪-দলীয় জোট, অন্যটি হলো জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট। প্রায় তিন দশক ধরে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের লড়াই ছিল প্রধানত বিএনপির সঙ্গে। এ লড়াইয়ে ১৪-দলীয় জোট-মহাজোট ছিল আওয়ামী লীগের মিত্র। কৌশলটি ছিল, নিজের বলয় যত দূর সম্ভব বিস্তৃত করা এবং বিএনপিকে সঙ্গীহীন বা কোণঠাসা করা।
বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র হলো জামায়াতে ইসলামী। আওয়ামী লীগ জামায়াতকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করার অনেক চেষ্টা করেছে। ১৯৯৬ সালে সফল হলেও পরে জামায়াত তার পুরোনো মিত্রের কাছেই ফিরে গেছে। আওয়ামী লীগ এখনো জামায়াত কার্ডটি ব্যবহার করে যাচ্ছে। তবে তা নিতান্তই রাজনৈতিক অভ্যাসের কারণে। জামায়াতের মূল ভরসা ছিল বিএনপি। এখন বিএনপির যে দশা, জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগের অতটা না ভাবলেও চলে। তবু এ নিয়ে কথা চালাচালি হচ্ছে এবং হবে। আমাদের অনেক নেতা এখনো মঞ্চে দাঁড়ালে হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো, সালাজার নিয়ে দু-চার কথা বলেন। এটি অভ্যাস। যাঁরা ইসলামপন্থী রাজনীতি করেন, তাঁরা হরহামেশা নমরুদ-শাদ্দাদের উদাহরণ টেনে আনেন। শত্রু না থাকলে রাজনীতির মাঠ গরম হয় না, তা কল্পিত হোক কিংবা প্রাগৈতিহাসিক।
বিএনপি নিয়ে যত দিন আওয়ামী লীগের অস্বস্তি ও ভীতি ছিল, তত দিন জোট-মহাজোটের কদর ছিল অনেক। অর্থনীতির ট্রিকল ডাউন প্রসেসের মতো নৌকায় চড়ে সাংসদ বা মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন কেউ কেউ, যা তাঁরা নিজেদের শক্তিতে পারতেন না। একটা উদাহরণ দিই। ২০০১ সালের নির্বাচনে বরিশালের একটি অঞ্চলে রাশেদ খান মেনন পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিলেন। কুষ্টিয়ার একটি আসনে হাসানুল হক ইনু পেয়েছিলেন তৃতীয় স্থান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁরা দুজনই নৌকায় সওয়ার হয়ে টানা ১০ বছর ভেসে বেড়ালেন। মন্ত্রীও হলেন। এখন চালচিত্র পাল্টে গেছে। বিএনপি এখন এতটাই হীনবল যে মেনন-ইনুদের এখন মন্ত্রিসভায় না রাখলেও চলে। লীগের কাছে তাঁদের চাহিদা এখন তলানিতে ঠেকেছে। লীগ এখন বলছে, তোমরা এবার বিরোধী দলের কাতারে যাও। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের শরিকেরা বেশ মনমরা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দল হয়েছে। ১৪ দলের বাকি শরিকেরা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। এরশাদের নেতৃত্বে বিরোধী দলে যাওয়ার ব্যাপারটি তাদের কাছে অস্বস্তিকর। কেননা এত দিন তারা এরশাদকে ‘স্বৈরাচার’ বলে এসেছে। আলাদা গ্রুপ করেও তারা থাকতে পারে, যেমনটি দেখা গিয়েছিল ১৯৭৯ সালের সংসদে। প্রধান বিরোধী দল ছিল আওয়ামী লীগ। জাসদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল আদায়-কাঁচকলায়। সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন জনাব আসাদুজ্জামান। কিন্তু আটজন সাংসদ নিয়ে জাসদ একটি সংসদীয় গ্রুপ তৈরি করেছিল। শাজাহান সিরাজ ছিলেন এই গ্রুপের নেতা। অর্থাৎ বিরোধী দলের মধ্যেও অনেক কুঠুরি থাকতে পারে।
১৪–দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে কাগজে-কলমে বড় দল হলো ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ। জাসদ ভেঙে আরেকটি দল তৈরি হয়েছে কয়েক বছর আগে। বাংলাদেশ জাসদ নামে তারা নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেও নিবন্ধন পায়নি। এই দলের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। দলের একমাত্র মইন উদ্দীন খান বাদল আওয়ামী লীগের টিকিটে সাংসদ হয়ে দলের বাতি টিমটিম করে জ্বালিয়ে রেখেছেন।
জাসদ এত দিন ‘জাসদীয়’ রাজনীতি করেনি। তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিটাই করেছে। তারা এত দিন বলে এসেছে, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। শেখ হাসিনা নিঃসন্দেহে অনেক শক্তিশালী হয়েছেন। কিন্তু জাসদের কী লাভ হলো?
১ ও ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জাসদের জাতীয় কমিটির দুদিনব্যাপী বৈঠক হয়। তারা নিজেদের অবস্থার একটা চুলচেরা হিসাব করতে বসেছিল। এর মধ্যে ২ তারিখ বিকেলে গণভবনে ‘চা-চক্রে’ও যোগ দিতে ভোলেনি। ওখান থেকে ফিরে এসে আবার বৈঠক করেছে। ২ দিনে ৯ ঘণ্টা বৈঠক করে তারা শেষমেশ সিদ্ধান্তে এল, সংসদ নির্বাচনটি ভালো হয়নি। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং জনগণ উদ্দীপনা ও আশা নিয়ে অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচনের পর বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছে গোটা জাতি। এর মূল কারণ হচ্ছে প্রশাসনের একশ্রেণির অত্যুৎসাহী অংশ ভোটের আগের রাতেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত করেছে।...এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা নজিরবিহীন। জনগণের ভোটের মাধ্যমে ১৪ দল তথা মহাজোটের নিশ্চিত বিজয় জেনেও যে মহলবিশেষ এ অপকর্ম সংঘটিত করেছে, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থেই তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কেননা এ কলঙ্কিত ঘটনার মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে।’ (সূত্র: প্রথম আলো, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)
এখন কী করণীয়, এটা জানার জন্য আমি বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘এখন আর কীই-বা করার আছে! আমরা দলীয় প্রতীক ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছি। এ নিয়ে আমরা একটি মানববন্ধন করার কর্মসূচি নিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম যে নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে দিয়েছে। নেক্সট ইলেকশনটা কীভাবে হবে, এটা ঠিক না করে আগেভাগেই এই তফসিল ঘোষণা করাটা ঠিক হয়নি।’
তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, এখন আপনাদের মূল দাবিটি কী? আম্বিয়া বললেন, ‘জনগণ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। এখন দরকার এই ক্ষমতা রি-এস্টাবলিশ করা।’ আমি আরও জানতে চাইলাম, সব জাসদ এককাট্টা হয়ে কিছু করবে কি না? তিনি বললেন, ‘এমন সম্ভাবনা নেই।’
যতটুকু বুঝতে পারলাম, তাঁরা এখন দুর্নীতি, সুশাসন, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলবেন। তো এসব কথাবার্তা তো আওয়ামী লীগও বলছে। ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’ খবর হচ্ছে ১৪ দলের এক বাম নেতা এখনো মন্ত্রী হওয়ার আশা ছাড়েননি। সবার এক কথা, এত দিন আমরা একসঙ্গে থেকেছি, একসঙ্গে নির্বাচন করেছি, এখন আমাদের সঙ্গে এ কেমন আচরণ?
বাংলাদেশ জাসদ নির্বাচন নিয়ে যে মন্তব্য করেছে, তা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সঙ্গে আর্জেন্টিনার খেলায় ম্যারাডোনার প্রথম গোলটিতে তিনি হাত ছুঁয়ে দিয়েছিলেন বলে কথা উঠেছিল। ম্যারাডোনা অনেক পরে স্বীকার করেছিলেন যে এতে ঈশ্বরের হাত ছিল। এবারের সংসদ নির্বাচনে আগেভাগেই ভোটের বাক্স ভরে ফেলার যে কথা উঠেছে, তা কোন ঈশ্বরের, তা একদিন না একদিন হয়তো জানা যাবে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রবল শক্তি নিয়ে সরকার চালাচ্ছেন, সেখানে অতি উৎসাহী কেউ ব্যালট বাক্স নিয়ে খেলা করার ধৃষ্টতা দেখাবেন, তেমনটা আশা করা যায় না।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভবিষ্যতে আরও অনেক আলোচনা ও বিশ্লেষণ হবে। সরকার সমর্থক অনেককেই বলতে শোনা যায়, এভিডেন্স কই? প্রমাণ দেখান?
আসলেই তো, এভিডেন্স কই, আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে ভোটের বাক্স ভরাট করার ছবি কি কেউ তুলে রেখেছে? কোনো প্রিসাইডিং অফিসার কি অভিযোগ করেছেন? তা না করে থাকলে প্রমাণ হবে কীভাবে? অকাট্য যুক্তি!
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]