২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যেসব কারণে সংসদে যাওয়া উচিত

কার্টুন : তুলি
কার্টুন : তুলি

বাংলাদেশের ডামাডোলপূর্ণ রাজনীতিতে বিরোধী দলের সংসদ বয়কট করা একটি পুরোনো ব্যাধি। নির্বাচনের পর সংসদ বয়কটের পক্ষে প্রথমেই যে যুক্তিটি গুরুত্ব পায় তা হচ্ছে সংসদে যোগ দেওয়া মানেই হলো সরকারি দলের অনিয়মকে মেনে নেওয়া, তাদের সরকার ও সংসদকে বৈধতা দেওয়া। এবারও সেই প্রশ্ন উঠেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একসময় যে ধারাটি ছিল তা এখন একেবারেই বদলে গেছে। একটি নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচনে সরকারি ও বিরোধী দল কাছাকাছিসংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হবে—এটাই ছিল একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। পরস্পরের বিরুদ্ধে একটা শক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদ এবং সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কিন্তু গত এক দশকে সেই ধারার অবসান ঘটেছে। সভা-সমাবেশ না করতে দেওয়া এবং গায়েবি মামলার যে চর্চা শুরু হয়েছে তা সহজে ভাঙবে না। এখন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট যদি মনে করে বিদেশি কূটনীতিকেরা খুব সহায়ক হবে, সেটা ভুল হবে। তারা দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে জনসভায় নয়, কূটনীতিকদের শরণাপন্ন হয়েছে।

অন্যদিকে সরকারি দল আমাদের কল্পনাশক্তিকেও হার মানানো বিজয় পেয়ে সম্ভবত ঈষৎ ম্রিয়মাণ। তাদের এই অনুমেয় দুর্বলতাকে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ হিসেবে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট কাজে লাগাতে পারে। তবে সে জন্য তাদের সংসদে যেতে হবে। যেসব কারণে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের সংসদে যাওয়া উচিত বলে মনে করি তা ধারাবাহিকভাবে এখানে উল্লেখ করছি।

প্রথমত, বিএনপি তার রাজনৈতিক দুরবস্থা থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তারেক রহমান লন্ডনে বসে নেতৃত্বে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেন না। খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত। বড়জোর তিনি কারামুক্তি লাভ করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারেন। মা ও ছেলের অবস্থানের কারণে তাঁদের নেতৃত্বে দলে নতুন কোনো গতিসঞ্চারের সুযোগ নেই।

দ্বিতীয়ত, মনে করা হয়ে থাকে যে খালেদা জিয়ার পরিবারের মধ্য থেকে কেউ একজন এগিয়ে আসবেন। কিন্তু এর মধ্যে যাঁদের নাম শোনা যায় তাঁদের কেউ একান্ত হাল ধরলেই যে অবস্থা আমূল বদলে যাবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কোনো বিশেষজ্ঞের পক্ষেই এটা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয় যে তাঁরা হঠাৎ করেই রাজনীতিতে আসবেন এবং একটা গতিসঞ্চার করবেন। ফলে এমন একটি পরিস্থিতিতে মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে বিএনপি সংসদে গেলে বরং তিনি একটি ভালো ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টা করতে পারেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিজয়ী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আমাকে বলেছেন, তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইবেন। যাঁরা ভাবছেন, মির্জা ফখরুলকে সংসদে পাঠালে জিয়া পরিবারের প্রভাব আরও কমবে, তার চেয়ে বয়কটই ভালো। কিংবা জিয়া পরিবার না থাকলে দল রেখে কী লাভ, তাঁদের যুক্তি কিংবা আবেগকে নাকচ করার সুযোগ নেই। তবে এই প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পাঁচ বছরের বেশি সময় তাঁর পরিবারের কেউ দলটির হাল ধরেননি। কিন্তু অনুকূল পরিবেশ আসামাত্রই শেখ হাসিনা এগিয়ে এসেছেন। সুতরাং মির্জা ফখরুল বা কাউকে না কাউকে এখন জোহরা তাজউদ্দীন বা আসাদুজ্জামান খানের (৩৯ আসন নিয়ে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন) ভূমিকা পালন করতে হবে।

তৃতীয়ত, সংসদ বয়কটের কারণে ক্ষমতাসীন দল চাপের মুখে পড়েছে এমন দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেই। পঞ্চম সংসদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যখন ১৪৭ জন সাংসদ পদত্যাগ করেছিলেন, তখনো কিন্তু সরকারের পতন ঘটেনি। সবচেয়ে বড় কথা বিরোধী দল তখনকার দিনে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারত, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে তা অনুপস্থিত।

চতুর্থত, যদি বিএনপি ক্রমাগতভাবে সংসদের বাইরে পুরো এক দশক পূর্ণ করার পণ করে, তাহলে তারা সংসদীয় বা স্বাভাবিক (যেহেতু বিএনপি বিপ্লবী সংগঠন নয়) রাজনীতির ধারা থেকে নিজেদের আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। যাঁরা এর বিপরীত মনে করেন, তাঁদের যুক্তিগুলো জানা প্রয়োজন। তবে বিষয়টিকে আবেগ দিয়ে না দেখাই ভালো।

পঞ্চমত, গত বছরগুলোতে সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রে বিএনপি যে পরিমাণ দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছে তাকে উপেক্ষা করে দলটি এখন রাজপথের আন্দোলনকে বেগবান করতে পারবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বিএনপি নেতাদের বাক্স্বাধীনতা দরকার। গত ১০ বছরে তারা কতটি সভা ও সংবাদ সম্মেলন করেছে, আর তার খবর কীভাবে সংবাদমাধ্যমে কভারেজ পেয়েছে, তা তাদের হিসাবে নিতে হবে। সংসদে যোগ দিলে অন্তত প্রতিটি বৈঠকে তাঁরা মুখের ওপরে কথা বলতে এবং না বলতে দিলে প্রতিবাদ করতে পারবেন।

ষষ্ঠত, বিএনপি সংসদে ফিরলে যে বিষয়টি খুব পরিষ্কার হয়ে উঠবে, সেটা হলো জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছদ্মবেশী বিরোধীদলীয় নেতার আসনটি অধিকতর ভুয়া বলে প্রমাণিত হবে। সম্প্রতি আমি রাশেদ খান মেননকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি কীভাবে মনে করেন যে জাতীয় পার্টির বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসা উচিত, যেখানে তাদের ন্যূনতম ২৫ সদস্যের সংখ্যার ঠিক নেই। তখন তিনি এ ব্যাপারে একমত হন যে জাতীয় পার্টি ও বিএনপি উভয়েরই শুধু সংসদীয় গ্রুপের মর্যাদা পাওয়া উচিত। বিএনপি সংসদে গেলে জাতীয় পার্টির যে নেতাই বিরোধী দলের নেতার আসনে বসুক না কেন, তাদের অবস্থানের বৈপরীত্য জনগণের সামনে স্পষ্ট হবে। কিন্তু বিএনপি যদি সংসদে না যায়, তবে তা হবে না।

সপ্তমত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ নানা ক্ষেত্রে যে সাফল্য এনেছে এবং অর্থনীতিতে সামনে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা তাকে ধরে রাখতে হলে যত দূর সম্ভব একটি ‘বহুদলীয়’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা দরকার। আর এতে বিএনপির অংশীদারত্ব প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। নির্বাচনে যোগ দেওয়া মানে তাকে সংসদেও যেতে হবে। ভোটের দিন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তারা যখন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়নি, তখন সংসদ বয়কট করে কোনো শোধ নেওয়া কি সম্ভব? তবে দলের বড় বড় ও ডাকসাইটে প্রার্থীরা যেহেতু হেরেছেন তাই তাঁরা সংসদে না যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেবেন সেটাই স্বাভাবিক।

অষ্টমত, সংসদে গেলে বৈধতা দেওয়া হবে—এই ভাবনা থেকে যাঁরা উদ্বিগ্ন, তাঁরা সবাই কিন্তু এই ভূখণ্ডেই বসবাস করবেন। এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় তাঁদের আত্মীয়স্বজন, যে যেখানে চাকরিরত রয়েছেন, সবাই কর্মরতই থাকবেন, কেউ কোথাও থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন না। কারণ, তাঁরা এটা ভালো করেই জানেন যে বৈধতার প্রশ্ন তুলে বাড়িতে বসে থাকা অপ্রয়োজনীয় ও আত্মঘাতী। সংসদও কোনো দলের নয়, এটি রাষ্ট্রের।

নির্বাচনের কয়েক দিন আগে আমরা এমন একটি ধারণা পেয়েছিলাম যে বিরোধী দল ন্যূনতম কিছু আসন পেলে সংসদে যাবে। এই সংখ্যাটি ৫০ থেকে ৭০ টির মধ্যে হবে—এ রকম একটি কথা অনেকেরই মুখে মুখে ছিল। এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ৫০টির কম পেলে তাদের পক্ষে সংসদে বসা সম্ভব হবে না। ভোটের দুই দিন আগে ঐক্যফ্রন্টের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার কাছে আমি যখন প্রশ্ন রাখি যে তাঁরা বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন, তখন তিনি আমাকে নির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন, ১০ জন থাকলেই সংসদ কাঁপিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু এখন শুনছি, সংসদ বয়কটের নেতৃত্বে তিনিই পুরোভাগে এসেছেন। বোঝা যায় এটি একটি আবেগনির্ভর অবস্থান। বিএনপি সংসদে গেলে যিনি সংসদীয় দলের নেতা হবেন, তাঁর হাতেই বিএনপির মূল নেতৃত্বের জায়গা ছেড়ে দেওয়া উচিত। বিএনপিকে এই বাস্তবতা মানতে হবে যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন বিলাত থেকে দিলে হবে না।

সংসদ নির্বাচনের গেজেট ফলাফল প্রকাশের পর নির্বাচিত সদস্যরা শপথ নেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় পান। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের হাতে বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য এখনো যথেষ্ট সময় রয়েছে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]