>প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বিষয়ে ১৮ ডিসেম্বর মতামত চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম গতকাল তাঁর অভিমত দেন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি পড়লাম। বিষয়টি আমাকে মনে করিয়ে দিল, ২০০১ সালের নির্বাচন-পূর্ব ও নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোটের অত্যাচার ও তাণ্ডব এবং সেই সময়ে নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার কথা।
এখন ২০১৮ সালে যেন দেখছি তারই একটি পুনঃসংস্করণ। এটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না। এটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা আইন–বহির্ভূত আচরণ বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়।
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সংবাদমাধ্যমের সদস্যসহ ছাত্র-যুবক, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর নেতাদের প্রায় কেউই আইনবহির্ভূত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাত থেকে রেহাই পাননি।
হয়রানি ও গ্রেপ্তার রোধে তখন আমার চেম্বার থেকেই শত শত মামলা পরিচালনা করা হয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা যাতে হয়রানি ও পাইকারি গ্রেপ্তারের শিকার না হন, সে জন্য আমরা উচ্চ আদালত থেকে তাৎক্ষণিকভাবে একটা আদেশ পেতাম। সেই আদেশটি আমাদের বিচার বিভাগীয় সংস্কৃতিতে একটি নতুন উপাদান যুক্ত করেছিল।
বিচার বিভাগীয় প্রতিকার লাভে তখন যে নতুন পরিভাষাটির সংযোজন ঘটেছিল, তার নির্দেশনায় বলা হতো, ‘পেন্ডিং হিয়ারিং অব দ্য রুল, নট টু অ্যারেস্ট, নট টু হ্যারাস’। এর অর্থ হলো, মামলার চূড়ান্ত শুনানি না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কোনোভাবেই গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা যাবে না। এই সৃজনশীল উদ্ভাবনের কারণ ছিল: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা মামলা না থাকলেও তিনি বা তাঁদের গ্রেপ্তার বা হয়রানির আতঙ্কে থাকতে হতো। উচ্চ আদালতের প্রদত্ত ওই ধরনের আদেশে কিন্তু কাউকে জামিন দানের কথা উল্লেখ করার উপায় ছিল না এবং থাকতও না।
সেই সময়ে যাঁরা গ্রেপ্তার আতঙ্কের শিকার হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন, আমি তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী ছাড়াও বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান, ড. মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষক, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, বাহাউদ্দিন নাছিমসহ অনেককেই স্মরণ করতে পারি। ওই সময়ের পরিস্থিতি এমনই শোচনীয় ছিল যে গ্রেপ্তার ও হয়রানি থেকে বাঁচতে তাঁদের অনেকেই বাসাবাড়ির বাইরে বেরোনোর আগে আদালতের অনুরূপ আদেশ পকেটে আছে কি না, তা পরখ করে নিতেন। এমনকি বিদেশ থেকে বিমানবন্দরে নামলেই গ্রেপ্তার হবেন, এমন যুক্তি নিবেদন করেও আদালত থেকে উল্লিখিত রক্ষাকবচ নিয়েছি। ভুক্তভোগীরা সেই ধরনের কোর্ট অর্ডার হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হতেন।
সেই সময়ে আমি ভুক্তভোগীদের পক্ষে আইনি লড়াই চালাতে গিয়ে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১,৩২ ও ৩৩ অনুচ্ছেদের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলাম। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ ৩২ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’
আর ৩৩ অনুচ্ছেদ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির মৌলিক অধিকার সুরক্ষার রক্ষাকবচ দিয়েছে। ৩৩ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।’
এটা আমাদের কখনোই ভুলে গেলে চলবে না যে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ২৭ অনুচ্ছেদে সংবিধানের নির্দেশ রয়েছে যে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।’
দল এবং রাজনীতি নিজ নিজ বলয়ে তার রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে আইনানুগ অধিকার রাখে এবং দলগুলো যদি পারস্পরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তাহলে এ ধরনের বিপত্তি ও বৈপরীত্য ঘটার আশঙ্কা থাকে না। আর তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও এ রকম আইনবহির্ভূত কর্মে লিপ্ত হবে না।
এই প্রজাতন্ত্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আমরা সেই পর্যায়ে দেখতে চাই, যেখানে তারা নিশ্চিত করবে, আইনের চোখে সবাই সমান।
আমীর-উল ইসলাম: সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী