বিশ্বে ‘অতি ধনী’ মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে বাংলাদেশে—এই খবর আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। লন্ডনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ অতি ধনী বা ‘আলট্রা হাই নেট ওয়ার্থ’-সম্পর্কিত (ইউএইচএনডব্লিউ) একটি প্রতিবেদনে এই তথ্য পরিবেশন করেছে। অতি ধনী বলে তাঁদেরই বিবেচনা করা হয়, যাঁদের সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি ডলার বা তার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় যাঁদের সম্পদ ২৫০ কোটি টাকার বেশি, তাঁরাই অতি ধনী বলে বিবেচিত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে অতি সম্পদশালীর বৃদ্ধির হার ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশের কিছু কিছু গণমাধ্যমে এই খবরটি প্রকাশিত হলেও এর কারণ এবং এর রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে এখনো আলোচনার সূত্রপাত হয়নি। এই নিয়ে আলোচনা না হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে এটা কোনো নতুন খবর নয় যে দেশে একটি নব্য ধনিকশ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে। এই খবরকে অবশ্য কেউ কেউ এই বলেও বিবেচনা করতে পারেন যে যেহেতু বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তার ফলেই এই নতুন শ্রেণির উদ্ভব সম্ভব; সেহেতু একে দেশের উন্নয়নের লক্ষণ বলেই তাঁদের ধারণা হতে পারে।
বাংলাদেশে যে একটি ধনিকশ্রেণির বিকাশ ঘটছে এবং তাদের সম্পদ থেকে চুইয়ে পড়া সম্পদের মধ্য থেকে গড়ে উঠছে একটি ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি’—সেটা আমরা দেখতে পাই। এই অতি ধনিকশ্রেণি এবং কথিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিষয় নয়, বর্তমানে যে ধরনের অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে এটা তার ফল। এর প্রভাব অর্থনীতি ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই পড়ছে এবং ভবিষ্যতেও পড়বে।
বাংলাদেশের এই অতি ধনিকশ্রেণির বিকাশের আর কিছু লক্ষণ আমাদের সবার জানা। বাংলাদেশ এই ধরনের আরও কিছু সূচকেও শীর্ষ স্থান অধিকারের কৃতিত্বের দাবিদার। যেমন, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রেও স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল বাংলাদেশ। এই তথ্য ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি’র (জিএফআই) ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে ছিল। মে ২০১৭-তে প্রকাশিত
প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। গত ১০ বছরে তার পরিমাণ ছিল সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা ৷
২০১৭ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। ২০১৬ সাল শেষে এর পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ৬১ হাজার সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। এক বছরে সামান্য হ্রাস সত্ত্বেও এর পরিমাণ যে কত বড়, তা ভারতীয়দের সঞ্চিত অর্থের সঙ্গে তুলনা করলেই খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে। ২০১৬ সালে ভারতীয়দের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ৪৮ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা প্রায় বাংলাদেশিদের সঞ্চিত অর্থের সমান।
মালয়েশিয়া সরকারের ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচির আওতায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশি সে দেশে তাঁদের আবাস কেনার অনুমতি পেয়েছেন। তাঁদের সূত্রে, জনপ্রতি খরচ ১২ কোটি টাকা হিসাবে প্রায় ৪২ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় চলে গেছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়—চীন ও জাপানের পরে।
অতি ধনী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বিবিসিকে বলেন, ‘এই তথ্য থেকে আমি মোটেও অবাক হইনি। কারণ, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে যে একটা গোষ্ঠীর হাতে এ ধরনের সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা আসলে দেখাই যাচ্ছে। এই সম্পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া তো এক দিনে তৈরি হয়নি। এটা কয়েক দশক ধরেই হয়েছে। এখন এটি আরও দ্রুততর হচ্ছে।’
এই ধরনের অস্বাভাবিক হারে সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে দুর্নীতির কোনো ভূমিকা আছে কি না—সেই প্রশ্নের উত্তরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এশিয়া বা আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেটা হয়, যাঁদের হাতে সম্পদ আসে, সেটার পেছনে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের একটা বড় ভূমিকা থাকে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য যাঁরা পান, বা যাঁদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার যোগাযোগ থাকে, প্রাথমিকভাবে তাঁরাই সম্পদের মালিক হন।’ (বিবিসি বাংলা, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮)। ফাহমিদা খাতুনের এই বক্তব্যের পক্ষে যথেষ্ট উপাত্ত হাজির করা যায়।
সেই সূত্র ধরেই আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকাতে পারি। বাংলাদেশে যেটা সহজেই দৃশ্যমান তা হচ্ছে সেসব খাত থেকেই এই ধরনের অর্থের সঞ্চয় ঘটানো সক্ষম হচ্ছে, যেখানে একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের সুবিধা নিতে পারছে। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে অবকাঠামো খাত। গত বছরগুলোতে সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান, যদিও কাজের অগ্রগতির হার সীমিত। সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে দেখা যায় যে একটি প্রকল্পে ছয় বছরে কাজ হয়েছে ২০ শতাংশ, কিন্তু প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে (ডেইলি স্টার, ২৬ আগস্ট ২০১৮)।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা-মাওয়া চার লেনে কিলোমিটারপ্রতি ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। অন্যদিকে ভারতে চার লেনের এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে (জমি অধিগ্রহণসহ) খরচ হয় ১১ লাখ থেকে ১৩ লাখ ডলার এবং চীনে ১৩ লাখ থেকে ১৬ লাখ ডলার। ইউরোপের দেশগুলোতে খরচ হয় ৩৫ লাখ ডলার। ইউরোপে দুই থেকে চার লেনে উন্নীত করতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ২৫ লাখ ডলার।
আমরা ব্যাংকিং খাতের অবস্থা জানি, একইভাবে বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি বিষয়েও অবহিত। এই যে ধনিকশ্রেণি তৈরি হচ্ছে, তার কি প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাই? বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে এবং দরিদ্রতম মানুষের আয় কমছে। বৈষম্য মাপার সর্বজন গৃহীত পরিমাপক হচ্ছে জিনি সহগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্য অনুযায়ী এই সহগের মান ২০১৬ সালে শূন্য দশমিক ৪৮৩, যা ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৬৫। অর্থাৎ আয়ের বৈষম্য বাড়ছে, জিনি সহগ শূন্য দশমিক ৫ পেরিয়ে গেলে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, বাংলাদেশের অবস্থান তা থেকে খুব দূরে নয়।
এই ঘটনাগুলো অর্থাৎ একদিকে অতি ধনী তৈরি হওয়া এবং অন্যদিকে দরিদ্রদের আরও দরিদ্র হওয়া—কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, এগুলো দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ফসল। আর সেই পরিকল্পনার নির্দেশক হচ্ছে রাজনীতি। অতি ধনী বৃদ্ধির হারের তালিকা থেকেও এটা বোঝা যায়। বিশ্বে অতি ধনী মানুষের বৃদ্ধির তালিকা অনুযায়ী, শীর্ষে বাংলাদেশসহ যে পাঁচটি দেশ আছে সেগুলো হচ্ছে চীন (১৩ দশমিক ৪ শতাংশ), ভিয়েতনাম (১২ দশমিক ৭ শতাংশ), কেনিয়া (১১ দশমিক ৭ শতাংশ) ও হংকং (৯ দশমিক ৩ শতাংশ)।
এই দেশগুলোর এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির অনুপস্থিতি। অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির অনুপস্থিতি সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং তার পরিপোষিত গোষ্ঠীর সদস্যদেরই সুবিধা প্রদান করে। এই সুবিধা যাঁরা লাভ করেন, তাঁরা নিশ্চয় চান না যে এই ব্যবস্থাটা বদলে যাক।
শুধু তা-ই নয়, যাঁরাই এই সুবিধা পাচ্ছেন তাঁরাই যত দ্রুত সম্ভব আরও ধনী হতে চাইবেন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অনুপস্থিতি এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। রাজনীতিতে ও প্রশাসনে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা দরিদ্রদের আরও দরিদ্র হওয়া এবং এই অতি ধনিকশ্রেণির বিকাশ বন্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর