গত শতকের ষাটের দশকের শেষ ভাগ। সদ্য কলেজে প্রবেশ করা অন্য দশটি যুবকের মতো আমি মিছিলে মিটিংয়ে সদাব্যস্ত। ১৯৬৭ সালের শেষ দিকে এক বিশাল মিছিল ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবিতে ঢাকার প্রেসক্লাব ও বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনের সড়কের মাঝে সড়কদ্বীপ অতিক্রম করে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছে। আমরা নানা রকম প্যারোডিতে গলা মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছি। হঠাৎই তখন স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা এক সুদর্শন মানুষ সড়কদ্বীপের ওপর দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণকণ্ঠে স্লোগান ধরলেন, ‘আইয়ুব শাহি আইয়ুব শাহি নিপাত যাক’! আমরা হাজারো কণ্ঠে তার সঙ্গে গগনবিদারী স্লোগান ধরলাম। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে ততক্ষণে জেনে গেছি, চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা আজানু লম্বা সফেদ পাঞ্জাবি পরিহিত উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুদর্শন মানুষটি কামাল লোহানী। আরও জানলাম, তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক এবং ন্যাপের (ভাসানী) সঙ্গে জড়িত একজন রাজনৈতিক কর্মীও বটে। ক্রমে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন বেগ পেতে থাকে। আমরা কামাল লোহানীর ঘনিষ্ঠ হতে থাকি।
ইতিমধ্যে আমরা জেনে যাই, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে পাবনা জেলা স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রাবস্থায় কামাল লোহানীর রাজনীতিতে
হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমনের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলায় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষসহ কামাল লোহানী ও অন্যান্য সহযোদ্ধা গ্রেপ্তার হন। ১৯ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কারাবাস। মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন। এই কারাবাসকালীন তিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন এবং আজীবন সেই আদর্শে অবিচল রয়েছেন। ১৯৫৫ সালে গ্রেপ্তার হলে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সঙ্গে একই জেলকক্ষে বন্দিজীবন কাটান। সেই বন্দী দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর সন্নিকটে আসেন এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন।
১৯৫৮ সালে কামাল লোহানী জড়িত হয়ে পড়লেন নৃত্যশিল্পের সঙ্গে। তাঁকে আমরা দেখি ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’-এ একজন কৃতী নৃত্যশিল্পী হিসেবে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আমরা দেখি, ১৯৬২ সালে কামাল লোহানীকে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে। পরে ১৯৬৭ সালে রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’ গড়ে তোলেন। ক্রান্তি ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাংগঠনিক তৎপরতায় সহসাই আমরা সংগীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, সুখেন্দু দাশ, আবদুল লতিফসহ অনেক শিল্পীকে দেখতে পাই স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে গণমানুষের কাতারে দঁাড়িয়ে সংগীত পরিবেশন করতে।
’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার সঙ্গেও কামাল লোহানী সর্বতোভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী একজন শিল্পী, একজন সাংবাদিক ও একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কালক্ষেপণ না করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। আমার সঙ্গে লোহানী ভাইয়ের দেখা হয় আগরতলায়। জানালেন, তিনি কলকাতা যাচ্ছেন। জুন মাসে দেখা হয় কলকাতায়। তিনি তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান। হাসান ইমামের সঙ্গেও দেখা। দুজন আমার একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ ধারণ করলেন এক দিনের মধ্যে। অতি যত্নে আমার পাঠ ও প্রক্ষেপণে প্রয়োজনীয় সংশোধন করলেন। পরে আমাদের পেট ভরে খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু আমরা দিনাজপুরে বিস্ফোরক প্রশিক্ষণের জন্য রওনা দিলাম পরদিন। ওই অনিশ্চিত সময়ে দুদিন তাঁদের স্নেহ-মমতা আমাদের চোখ আর্দ্র করেছিল।
এরপর তাঁর সঙ্গে দেখা বিজয়ের পর। লোহানী ভাই নতুন দেশের নতুন বেতার কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে রাতদিন ব্যস্ত। কিছু সময় পর তিনি প্রিয় বেতার ছেড়ে দিলেন! তারপর ১৯৭৫–এর আগস্টে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর বিপর্যস্ত বাংলাদেশের অনিশ্চিত যাত্রা। এই অনিশ্চিত সময়ে ধীরে গড়ে ওঠা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে লোহানী ভাই নিজেকে যুক্ত করে নেন। যদিও তিনি সরকারি পত্রিকা দৈনিক বার্তার সম্পাদক কিন্তু তাঁর যোগাযোগ অব্যাহত ছিল ঢাকার সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে। ১৯৮১ সালে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নব উদ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভিন্ন পদে থেকে এবং শেষাবধি সভাপতি হিসেবে সাংবাদিকদের পেশাগত মানোন্নয়ন ও জনগণের মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিরলস কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পিছপা হননি।
কামাল লোহানী এক চিরবিদ্রোহীর নাম। আজ তঁার ৮৫তম জন্মদিন। এ আমাদের জন্য পরম আনন্দ ও গৌরবের দিন। প্রিয় লোহানী ভাই, আপনি বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে অনাদিকাল।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ নাট্য সংগঠক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা