ফলে রাসায়নিক বিতর্ক, ভোক্তা কী করবে?
ঘটনার সূত্রপাত ইথোফেন ও কারবাইড দিয়ে ফল পাকানো এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কর্তৃক সেই ফল ধ্বংস করা নিয়ে। এ নিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) অনুমোদনও দেখতে পাওয়া গেল। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দুটি সংস্থার মধ্যে পাল্টাপাল্টি ভাষ্য ভোক্তাদের মনে সংশয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করবে বলে আমরা মনে করি। প্রথম আলোয় প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক, বাজারে অভিযান চালিয়ে র্যাব আড়াই হাজার মণ এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ৪০০ মণ আম ধ্বংস করেছে। তাদের অভিযোগ, আমগুলো কারবাইড ও ইথোফেন দিয়ে পাকানো হয়েছে। র্যাব ও ডিএমপির এই অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএফএসএ। তারা মনে করছে, জানা-বোঝার ঘাটতির কারণে এভাবে আম নষ্ট করা হচ্ছে।
এটা সত্য যে সাম্প্রতিক নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি উঠে এসেছে যে ইথোফেন দিয়ে ফল পাকালে স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। নির্ধারিত মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার করা কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে না। এ বিষয়ে বিএফএসএর বক্তব্যকে অসম্মান করার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু যদি আমরা ধরেই নিই যে নির্দিষ্ট পরিমাণ ইথোফেনের ব্যবহার মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক নয়—এই ‘নির্ধারিত পরিমাণ’ বিষয়টি কে এবং কীভাবে নির্ধারণ করবে? বা আদৌ এটা নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব কি? আমাদের দেশের ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবসায় সাধারণ মানুষ এমনভাবে যুক্ত যে রাসায়নিক ব্যবহার করার সামাজিক বৈধতা একবার পেলেই এর ব্যবহার মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাবে বলে আমরা মনে করি। পরিশেষে যখন বাংলাদেশের মানুষ খাদ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে এক বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন তৈরি করছে, ঠিক সেই সময়েই এমন বিভ্রান্তি আমাদের আরও পিছিয়ে দিতে পারে। যেহেতু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি এসব রাসায়নিক ক্ষতিকারক কি না, তাই একটি বিশ্বাসযোগ্য গবেষণার মাধ্যমে এই বিতর্কের অবসান ঘটানো উচিত। কিন্তু গাছপাকা ফলের যে স্বাদ, তা কি ইথোফেনের ফলে পাওয়া যায়? অথবা ফল পাকার আগে তা ভোক্তাদের পাতে তুলে দেওয়াটা কি বৈশ্বিকভাবে ব্যাপক হারে চর্চিত হয়? আর একজন ভোক্তা যখন একটি পণ্য পয়সা দিয়ে কেনেন, তখন তিনি প্রত্যাশিত স্বাদ পাওয়ার আশা তো রাখবেনই। তা ছাড়া যেখানে সমগ্র পৃথিবীই অর্গানিক এবং প্রাকৃতিকভাবে ফলানো খাদ্যের দিকে ঝুঁকছে, ঠিক সে রকম একটা সময়ে আমরা এভাবে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহারকে উৎসাহিত করছি কোন যুক্তিতে? আমাদের কাছে বিষয়টিকে স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটা বলে মনে হচ্ছে।
আমাদের দেশের মৌসুমি ফলের মধ্যে বিভিন্ন রকম রাসায়নিক অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে নজরদারি করার মতো লোকবলও সরকারের হাতে নেই। তার ওপর যদি এভাবে ফল পাকানো বা সংরক্ষণের কথা বলে নতুন করে রাসায়নিক ব্যবহার করাকে উৎসাহিত করা হয়, তাহলে ফলের প্রাকৃতিক স্বাদ ও গুণাগুণ আমরা কতটা আস্বাদন করতে পারব? উপরন্তু, এটি রাসায়নিক ব্যবহারের প্রচলিত অস্বাস্থ্যকর সংস্কৃতিকেই আরও উৎসাহিত করতে পারে। কোনো ফল যদি সারা বছরই আমরা পেতে চাই, তাহলে বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত জাতের ফলের প্রজাতি তৈরি করা সম্ভব। আর এর উদাহরণ অনেক দেশেই এখন বিদ্যমান। তাই অপরিপক্ব ফলকে ভোক্তার হাতে তুলে দিতে এমন প্রয়াস কতটুকু যৌক্তিক? তা ছাড়া বিএফএসএ যদি ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে এসব রাসায়নিক দিয়ে পাকানো ফলের বৈধতা দিতে চায়, তাহলে আমরা ভোক্তা হিসেবে কার কাছে বিচার চাইব?
এবার আসা যাক রাসায়নিক দিয়ে পাকানো ফল বিষয়ে প্রচলিত আইন কী বলে? বিভিন্ন বিষয়ের গবেষকেরা বারবার বলে আসছেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য যে আইনগুলো বর্তমানে আছে, তা অনেকটাই যথেষ্ট। যেটা প্রকৃতপক্ষে দরকার, তা হলো খাদ্য বিষয়ে যেসব সংস্থা কাজ করছে, তাদের মধ্যে সঠিক সমন্বয়। এমনকি বর্তমানে প্রচলিত নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩-এর আগে যে পিওর ফুড অ্যাক্ট ১৯৫৯ ছিল, সেখানেও অনেক কঠোর বিধান ছিল। কিন্তু সেই আইনও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় শুধু নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে নানা সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে। তাই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সমন্বয় রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার বলে আমরা মনে করি। নিরাপদ খাদ্য আইনের ২৩ ধারায় বলা আছে, ‘কোন ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোন ব্যক্তি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা উহার উপাদান বা বস্তু (যেমন-ক্যালসিয়াম কারবাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট), কীটনাশক বা বালাইনাশক (যেমন-ডি. ডি. টি. , পি. সি. বি. তৈল, ইত্যাদি), খাদ্যের রঞ্জক বা সুগন্ধি, আকর্ষণ সৃষ্টি করুক বা না করুক, বা অন্য কোন বিষাক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়া সহায়ক কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্ত করিতে পারিবেন না অথবা উপরুক্ত দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ মজুদ, বিপণন বা বিক্রয় করিতে পারিবেন না।’
এটি ধরে নেওয়া অন্যায় হবে না যে একজন আইন প্রয়োগকারী হিসেবে র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেটের জানা প্রয়োজনীয় নয় যে ওই আইন ভুল কি সঠিক। তাঁর পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে, আইনের অনুশাসন সঠিকভাবে পালন করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট আমগুলো ধ্বংস করে অন্যায় করে ফেলেছেন, এটা বলা কতটা যুক্তিসংগত? বরং যে আইনের শাসন নিয়ে দেশে সবচেয়ে বেশি কথা হয়, সেটিই তিনি পালন করেছেন বলে আমরা মনে করি। যদি এই ২৩ ধারা নিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কোনো আপত্তি থাকে, তাহলে তাদের উচিত হবে সঠিক পন্থা অবলম্বন করে এই আইন সংশোধনের ব্যবস্থা করা। তবে আমরা এটাও মনে করি, ফলের মজুত ধ্বংস করার আগে ম্যাজিস্ট্রেটদের উচিত হবে সেই ফলে রাসায়নিক আছে কি না, তা সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হওয়া। এমনটি যেন না হয় যে চাপে পড়ে বা পুলিশের ভয়ে ব্যবসায়ীরা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এমনিতেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের এখতিয়ার ও কার্যক্রম নিয়ে বিচার বিভাগে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেটদের উচিত হবে রাসায়নিকের ক্ষতিকারক মাত্রার উপস্থিতি বিষয়ে সঠিক প্রমাণ পাওয়ার পর ফল ধ্বংস বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলোকে আধুনিক ও সময়-উপযোগী সরঞ্জাম সরবরাহ করা, যাতে তারা এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এই বিষয়কে ভোক্তার স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে এর আশু সমাধান জরুরি।
সর্বোপরি নিরপরাধ ব্যবসায়ীরা যেন কোনো ধরনের অবিচারের শিকার না হয়, সেটিও আমাদের খেয়াল রাখা দরকার।
লেখকেরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক এবং নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক গবেষক।