ইংরেজিতে বলা হয় ‘র ডেটা’ বা শুদ্ধ অঙ্কের হিসাব। এই অঙ্কের হিসাবে বাংলাদেশ সব দিক থেকেই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে এমন একটি তথ্য আমাদের আপ্লুত করেছে। তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে একটি কার্যকারণ ছিল দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে আমরা কেবল সে বৈষম্য কাটিয়ে উঠেছি তা-ই নয়, পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এসেছি।
আমাদের এই অগ্রগতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা পুরোপুরি বোঝার জন্য আমাদের নজর দেওয়া উচিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রতিবেদনের দিকে। প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে চলেছে, কিন্তু শুধু প্রবৃদ্ধি দিয়ে একটি দেশের ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন বোঝা সম্ভব নয়। এই ফোরাম মোট ১২টি সূচকের ভিত্তিতে যে মডেলটি নির্মাণ করেছে, তাতে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্র্যবিমোচন, আন্তপ্রজন্ম ব্যবধান ও টেকসই উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের আদলে নির্মিত এই ইনডেক্সে বাংলাদেশের স্থান ৩৬। অন্যদিকে পাকিস্তানের স্থান হলো ৫২।
কোন দেশ কতটা এগিয়েছে, তা বোঝার আরেক সহজ উপায় হলো মাথাপিছু আয় গোনা। এ বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইকোনমিস্ট পত্রিকা জানিয়েছে, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন পাকিস্তানের চেয়ে বেশি ১ হাজার ৫৩৮ ডলার বনাম ১ হাজার ৪৭০ ডলার। এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ১৯৭১-এ যে পূর্ব পাকিস্তান সব দিক থেকেই পিছিয়ে ছিল, তা এখন সব দিক থেকেই পাকিস্তানকে টপকে চলেছে। ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, ১৯৭১-এ (পশ্চিম) পাকিস্তানের মোট জাতীয় উৎপাদনের ২০ শতাংশ ছিল শিল্প খাত, আর বাংলাদেশের মাত্র ৬-৭ শতাংশ। এখন সেখানে বাংলাদেশের শিল্প খাত তার অর্থনীতির ২৯ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তান তার থেকে সামান্য পিছিয়ে ২৭ শতাংশে।
অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু এই পাকিস্তানের কথা বলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গায়ে-গতরে লম্বা ও চওড়া এই পাকিস্তানিরা বরাবর বাঙালিদের অনগ্রসর দাবি করে এসেছে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান বাঙালিদের শুধু অনগ্রসর নয়, তাদের কোনো ভাষা ও সংস্কৃতি নেই বলেও দাবি করেছিলেন। সেই বাঙালিরাই এখন গায়ে-গতরে লম্বা কিন্তু মস্তিষ্কে ফাঁকা পাকিস্তানিদের পেছনে ফেলে এসেছে, এই বিষয়টা আমাদের জন্য অবশ্যই শ্লাঘার।
এমন অনেক পাকিস্তানি রয়েছে, যাদের ধারণা ছিল যে স্বাধীনতা দাবি করে বাঙালিরা ভুল করেছে। আগে হোক বা পরে, বাঙালিরা তাদের সেই ভুল বুঝতে পারবে। এসব মহা পণ্ডিতের একজন হলেন ওয়াশিংটনের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও সাবেক পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আকবর এস আহমেদ। তাঁর জিন্নাহ, পাকিস্তান অ্যান্ড ইসলামিক আইডেন্টিটি গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন তা প্রমাণের জন্য পত্রপত্রিকা খুঁজে দু-চারটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, যার মোদ্দা কথা, স্বাধীনতা পাওয়ার পর দেশটা গোল্লায় গেছে। এর মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে বাংলাদেশ এক মহা সংকটে পড়ে গেছে। মিল-কারখানা সব বন্ধ হয়েছে। অবস্থা এত খারাপ যে ভারত থেকে আমদানি করা জিনিসপত্র না এসে পৌঁছালে লোকজনের বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেউ কেউ এমন কথাও বলা শুরু করেছে যে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে স্বাধীনতার সুখকল্পনা বাদ দিয়ে ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়া।
আকবর আহমেদের বইটি কিছুটা পুরোনো, ১৯৯৭ সালের। বাংলাদেশ যে ইতিমধ্যে তাঁর পাকিস্তানকে ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে, এই তথ্য আশা করি তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। এই আকবর আহমেদ ও তাঁর মতো অন্যদের জন্য পাকিস্তানি পত্রিকা ডন থেকে একটি উদ্ধৃতি দিতে চাই। কয়েক বছর আগের সংখ্যা, কিন্তু তথ্যগত কারণে এটি এখনো প্রাসঙ্গিক।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক অনুসারে, বিগত ২৫ বছরে বাংলাদেশ ক্ষুধা ও অপুষ্টি নির্মূলকরণে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। পাকিস্তানে এখনো বাঙালি বলার সময় আগে-পিছে ভুখা, নাঙ্গা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ১৯৭১-এর দেশ বিভক্তির পর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন উচ্চ ধারণা পোষণ করত না। ১৯৭১-এ ভুট্টো বাঙালিদের ‘শুয়োর’ বলতেও দ্বিধা করেননি। এবার ক্যালেন্ডারের পাতা এগিয়ে ২০১৩ সালে আসুন, দেখুন এরই মধ্যে ছবিটা কেমন পুরোপুরি বদলে গেছে। পাকিস্তান তার নাগরিকদের পেটে খাদ্য জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, আর সেই একই সময়ে বাংলাদেশ মানব উন্নয়নে ধেই ধেই করে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা এখন একটা ধাঁধার বিষয়, একসময় যে পাকিস্তানকে নিয়ে এত উচ্চাশা ছিল, সে কী করে দক্ষিণ এশিয়ার অসুস্থ ও ক্ষুধার্ত মানুষের বাসস্থান হয়ে উঠল (ডন, ২৩ অক্টোবর ২০১৩)।
ভুট্টো এখন বেঁচে নেই, থাকলে জিজ্ঞেস করতাম, এখন শুয়োর কে?
এই উদ্ধৃতি দিয়ে আমি এই কথা বোঝাচ্ছি না যে বাংলাদেশে সবকিছুই উজ্জ্বল, সবকিছুই আশাবাদে পূর্ণ। মোটেই না,
নানা ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অপূর্ণতা রয়েছে, বিশেষত সুশাসন প্রতিষ্ঠায়। সেটি বাংলাদেশের নিজস্ব সংগ্রামের অংশ, নানা চড়াই-উতরাই ডিঙিয়ে সে এগোচ্ছে। কিন্তু এ কথায় কোনো ভুল নেই যে আজ বাংলাদেশে এমন একজন লোকও নেই, যে বলবে স্বাধীনতা ভুল ছিল।
বাংলাদেশের কথা উঠলে তার খামতির বিষয়ে অন্য সবার চেয়ে বাংলাদেশিরাই অধিক সোচ্চার। কিন্তু এই সমালোচনার অর্থ এই নয় যে তাদের নিজ দেশের প্রতি আনুগত্য অথবা গৌরববোধে কোনো খামতি আছে। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো স্ববিরোধিতা নেই। আমি প্রবাসী, প্রতিদিন এই সত্যটির মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। গত সপ্তাহে একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে একটি সাবওয়ে টানেলে বোমা বিস্ফোরণের অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে। তার নামের সঙ্গে বাংলাদেশ শব্দটি যুক্ত আছে, সে জন্য প্রতিটি প্রবাসী বাংলাদেশির মাথা লজ্জায় নত হয়েছে। একাধিক প্রতিবাদ সভা হয়েছে, যেখানে অনেক বক্তা দাবি করেছেন, এই লোকের ব্যাপারে আমাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। সে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে, এই দেশের সে নাগরিক। অতএব, তার সব অপরাধের দায়দায়িত্ব এই দেশের।
আমি সে কথার সঙ্গে একমত নই। আমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক, লোকটির নামের সঙ্গে হাইফেন-যুক্ত বাংলাদেশ শব্দটি আমরা চাইলেও বাদ দিতে পারব না। এ কথাও আমরা অস্বীকার করতে পারব না, এই যুবক এত দিন আমাদের মধ্যেই বাস করেছে, সে আমাদেরই কারও ভাই অথবা চাচা। সে যে আমাদের সবার চোখ এড়িয়ে নিজ ঘরে বসে বোমা বানাচ্ছিল, তা ধরতে না পারার ব্যর্থতার অংশবিশেষ আমাদের ঘাড়েও এসে পড়ে।
লক্ষণীয়, আকায়েদ উল্লাহকে নিজের বলে অস্বীকার করলেও এই সন্ত্রাসী ঘটনার প্রতিবাদ করতে আমরা কিন্তু ঠিকই রাস্তায় নেমে এসেছি। সে যদি আমাদের না-ই হবে, তাহলে এ বিষয়ে অধোবদন হওয়ার মতো কোনো কারণ ঘটত না।
এক অর্থে এই আকায়েদ উল্লাহ আজকের বাংলাদেশের জন্য একটি ‘মেটাফোর’। একটা দেশ এগোয় শুধু তার অর্জনের শক্তিতে নয়, কোথায় তার অপূর্ণতা সে কথা অনুধাবনের ভেতর দিয়ে। সুশাসন অর্জনে আমাদের মন্থর অগ্রগতি যেমন একটি খামতি, আকায়েদ উল্লাহর মতো সন্ত্রাসীর জন্ম ঠেকাতে আমাদের ব্যর্থতাও সে রকম আরেকটি খামতি। এ দুই বিপরীতমুখী প্রবণতা এবং তার মধ্যে লড়াই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি পরিচিত বৈশিষ্ট্য। যে দেশ যত সচেতনভাবে এই লড়াইয়ে অংশ নেয়, রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্গত বৈপরীত্য তত দ্রুত সে কাটিয়ে ওঠে।
এ দুই লড়াইয়ের একটিতে বাংলাদেশ জিতে চলেছে। এবার তাকে মনোযোগ দিতে হবে অন্য লড়াইয়ে জেতার।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।