মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্য দেখলে গর্বে বুকের ছাতি তিন–চার ইঞ্চি ফুলে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। এই যেমন মাস দেড়েক আগের কথাই ধরা যাক। বনানীতে কাকলী বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৈত্রী বাসটি বীর বিক্রমে যে দিক দিয়ে যাওয়ার কথা, ঠিক তার উল্টো দিক দিয়ে যাচ্ছে। কিছু ‘বীর’ ছাত্র বাস থেকে নেমে উল্টো দিক থেকে আসা, মানে যেই গাড়িগুলো সোজা পথে আসছিল, সেগুলোকে হ্যাট হ্যাট করে সামনে থেকে সরাচ্ছে।
এই কর্মযজ্ঞের উদ্দেশ্য অতি মহৎ। ঢাকার উৎকট ট্রাফিক জ্যাম এড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের যথাসময়ে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এই মহতী উদ্যোগ। এই যে বিশাল বাসটির রাস্তার পুরো উল্টো দিকে নিয়ে মাইলের পর মাইল যাওয়া, এটা কিন্তু কম গর্বের কথা নয়। আমি অবাক হয়ে যাই, কীভাবে দিনের পর দিন এই অসম্ভব ও চরম দৃষ্টিকটু কাজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা করে আসছে? নাহ্, এই কৃতিত্বের প্রশংসা না করে কোনো উপায় নেই।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের উল্টোযাত্রা নিয়ে কিন্তু কম বিতর্ক হয়নি। কয়েক বছর আগে ধানমন্ডির কাছে এ রকম উল্টো দিক থেকে আসা বাসের মাঝখানে একটা বেয়াদব প্রাইভেট কার এসে পড়েছিল। গাড়ির মধ্যে ছিলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ও তাঁর ছেলে। বাস থেকে নেমে বীর ছাত্ররা যথারীতি ধমক লাগালেন, কেন এই প্রাইভেট কার বাসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদ করলেন প্রাইভেট কারের যাত্রীরা। আর যায় কোথায়! শুরু হয়ে গেল ধুমধাড়াক্কা পেটানো আর কাকে বলে! ছেলে তো মার খেলই, তার বয়স্ক বাবাও বাদ গেলেন না।
যাই হোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলোর এই নিয়মিত উল্টোযাত্রা সম্বন্ধে কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানে না? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মঙ্গল গ্রহে বসবাস না করলে এ সম্বন্ধে না জানার কোনো কারণ নেই। জানা সত্ত্বেও এ রকম একটি বিশ্রী দৃষ্টিকটু এবং আইন অমান্যকারী কাজ বছরের পর বছর ঘটতে দেওয়ার কারণে আমার মনে হয় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টাই আসলে চলছে উল্টো দিকে। সেখানে এই সামান্য বাস তো কোন ছার! আর বছর দুয়েক আগে ঘটে যাওয়া পয়লা বৈশাখে নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রশাসনের চরম দায়িত্বহীন আচরণ ও বক্তব্যে এই ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ও সার্বিক কল্যাণে তাঁদের আন্তরিকতার ছাপ পাওয়া গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে যেকোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করতে উঠেই কাঁপা কাঁপা গলায় আমাদের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম, স্বৈরাচার দমন আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকার কথা বলতে শুরু করেন। এগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলো মূলত সামাজিক আর রাজনৈতিক অবদান। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল অবদান যেখানে রাখার কথা জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান বিতরণ এবং সামগ্রিকভাবে জ্ঞানচর্চা, সেই জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় আছে?
কোথায় আছে বলতে গেলেই চলে আসে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ের প্রসঙ্গ। দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ের কোনোটাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ৫০০-এর মধ্যে নেই। এর একটি র্যাঙ্কিংয়ে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থান ৭০১। আর অধঃপতনের নমুনা হিসেবে আরও তথ্য হলো, ২০০৭–এ অবস্থান ছিল ৫২৭, ২০১২তে নেমে এসেছিল ৬০১–এ। দেখা যাচ্ছে, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উল্টো দিকে যাত্রা করেছে, সামান্য বাস তাহলে আর কী দোষ করল?
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড করতে করতে আমাদের গর্বের সীমা–পরিসীমা থাকে না, কিন্তু র্যাঙ্কিংয়ে আসল অক্সফোর্ডের অবস্থান বিশ্বের প্রথম পাঁচটির মধ্যে আর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ৫০০–এর মধ্যেও নেই, এই লজ্জাজনক পরিস্থিতির কারণ কী? মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে, তাই যেকোনো প্রতিষ্ঠানের অধঃপতনের কারণ খুঁজতে গেলে দেখতে হয় এর দায়িত্বে বা নেতৃত্বে কে রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিটি সব সময়েই থাকেন একটি বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। আর সেই অ্যাসাইনমেন্টের সঙ্গে শিক্ষা বা গবেষণার বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দেশের জন্মলগ্ন থেকে কখনোই শিক্ষা বা গবেষণার পীঠস্থান হিসেবে দেখেনি। তারা এটিকে দেখেছে রাজনৈতিক পেশিশক্তি প্রদর্শনের অন্যতম জায়গা হিসেবে। তাদের কাছে হিসাব অত্যন্ত সোজা। যেকোনো আন্দোলন, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক হোক, সেটি গড়ে ওঠে এবং বেগবান হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠান্ডা রাখতে পারলে অনেকখানি নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো যায়।
এই রাজনৈতিক পেশিশক্তির আধারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে প্রথমে যেটি দরকার, সেটি হলো ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক শক্তির একান্ত অনুগত একজন ব্যক্তি। বেশির ভাগ সময়ে তাঁকে আনুগত্যের পরীক্ষা দিতে হয় দলীয় শিক্ষকদের নেতৃত্ব দিয়ে এবং তাঁর নেতা হওয়ার যে ক্ষমতা আছে, সেটির প্রমাণ দিয়ে। সে ক্ষেত্রে তাঁকে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে পাস করে এসে যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয়। এরপর বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে ন্যায় হোক আর অন্যায় হোক, দলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন বজায় রাখতে হয়। এসব পরীক্ষায় পাস করে ওনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। এখানে এসব ব্যক্তির শিক্ষকতার যোগ্যতা, গবেষণার অভিজ্ঞতা কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধুই বিবেচ্য নিঃশর্ত আনুগত্য। এর পরিণতিতে বছরের পর বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আস্তে আস্তে তলানির দিকে যেতে থাকবে, এটাই তো হওয়ার কথা।
পয়লা জুলাই হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আর চার বছর পরেই সেঞ্চুরি হাঁকাবে আমাদের সবার প্রিয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই দিনে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোকসজ্জা হয়, শোভাযাত্রা, বক্তৃতা, বিবৃতি ইত্যাদি চলে। আর প্রতিবছরই সেটি দেখে মনে হয়, এ সবই হচ্ছে মৃত্যুশয্যায় শায়িত একজন ব্যক্তির রোগযন্ত্রণা সব অগ্রাহ্য করে তাঁকে নিয়ে আনন্দ–উৎসবের এক প্রহসন। এগুলো বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্রুত একাডেমিক শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। ডিন, উপাচার্য, সহ-উপাচার্য—এসব পদে নিয়োগ দিতে হবে সত্যিকারের মেধাবী ও যোগ্য অধ্যাপকদের। নয়তো আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মানের এই তলানির দিকে যাত্রা দিনে দিনে আরও ত্বরান্বিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটি দিয়েই শেষ করি। যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মানুষ তৈরি হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের বাসটি যখন উল্টো পথে চলে, তখন সেটি কিসের ইঙ্গিত বহন করে? আর ছাত্রছাত্রীরা জীবনের শুরুতেই নিয়ম ভাঙার অতি ক্ষতিকর একটা শিক্ষা পেয়ে গেলে পরবর্তী জীবনে সেটা ধারণ করবে না, তার গ্যারান্টি কী? আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেরা হয়তো শিক্ষা বা গবেষণার আদর্শ জায়গা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। তাই বলে আগামী প্রজন্মকে গোড়াতেই এভাবে ভুল পথে পরিচালিত হতে দেওয়ার অধিকার কি আমাদের আছে?
রুশাদ ফরিদী: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।