প্রশাসনের অতীতের ব্যর্থতা থেকে কী শিক্ষা নেব

বাংলাদেশে সংস্কারের প্রস্তাব বাস্তবায়নের হার বরাবরই কম। বাস্তবায়নযোগ্য এবং টেকসই রূপরেখা প্রণয়ন না করলে এবারও যে একই পরিণতি হতে পারে, তা নিয়ে লিখেছেন সৈয়দা লাসনা কবীরমোহাম্মাদ ঈসা ইবনে বেলাল 

প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের আগামী ডিসেম্বর–জানুয়ারির মধ্যে তাদের প্রস্তাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। বর্তমানে কমিশনগুলো তাদের প্রস্তাব তৈরির প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রস্তাব কতটা স্বচ্ছ, বাস্তবসম্মত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, তার ওপরই প্রস্তাবগুলোর কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে চার ধরনের সরকারব্যবস্থা দেখা গেছে। নির্বাচিত সরকার, সামরিক সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং যুদ্ধ/অভ্যুত্থান–পরবর্তী সরকার। প্রতিটি সরকারই বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করেছে। তবে এসব কমিশনের প্রস্তাবের পরিণতি সাধারণত দুই রকম হয়েছে। প্রথমত, যে সরকারের অধীনে এসব কমিশন গঠন করা হয়েছে, তারা কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করলেও অধিকাংশই উপেক্ষিত থেকেছে। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রণীত সংস্কার প্রস্তাবগুলো নির্বাচিত সরকারগুলোর আমলে কোনো মনোযোগ পায়নি। ফলে সেগুলো কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। 

প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন, প্রস্তাব জমা দেওয়া এবং এসবের ভিত্তিতে ‘নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্ন দেখা দেশের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে যেটি সত্যিকার অর্থে নতুন হতে পারে, তা হলো এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি কার্যকর রূপরেখা তৈরি করা এবং সেই রূপরেখাকে কার্যকর করার জন্য জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন নিশ্চিত করা। তবে বাস্তবতা হলো, যদি প্রস্তাবগুলোয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো সেগুলোকে নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে না করে, তাহলে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এরশাদের পতনের পর গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ‘যুগান্তকারী’ পদক্ষেপ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের মার্চ পর্যন্ত এই সরকার দায়িত্ব পালন করে। এ সময় অর্থনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের লক্ষ্যে ২৯টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এসব টাস্কফোর্সে দেশের ২৫৫ জন শীর্ষ বিশেষজ্ঞ এবং প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের বর্তমান প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। এই টাস্কফোর্সগুলো রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতের সংস্কার নিয়ে সুপারিশমালা প্রণয়ন করে, যা নির্বাচিত সরকার এবং বিরোধী দলের জন্যও গ্রহণযোগ্য হওয়ার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছিল।

দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব সুপারিশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে তৎকালীন নির্বাচিত বিএনপি সরকার বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রথম আলোয় এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনগুলো এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল, যেন ১৯৯১ সালের মার্চের নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার এবং সংসদে বিরোধী দল উভয়কেই পেশ করা যায়। দুঃখজনকভাবে, নির্বাচিত বিএনপি সরকার প্রতিবেদনগুলো সামান্যই কাজে লাগিয়েছিল।’ এর ফলে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শুরু হওয়া সংস্কার প্রচেষ্টা কেবল খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়।

■ যারা এত দিন একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা বজায় রাখতে সহযোগিতা করেছে, তারা কি সত্যিই এই সংস্কারের প্রতি সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসবে? ■ প্রশাসনের মধ্যে যারা সংস্কারের পক্ষে কাজ করতে আগ্রহী এবং যারা গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাদের নিয়ে একটি নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন।

২০০৬-০৭ সালের সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের ৫৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে গঠিত হলেও তাদের কার্যক্রম সেই সীমানার বাইরেও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। তারা নির্বাচন আয়োজনের রুটিন দায়িত্ব ছাড়িয়ে সংস্কার কার্যক্রমকে তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর উদ্যোগ নেয়। নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমকে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার উপযোগী করার লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

১৯৭২ সালের নির্বাচন আইন সংশোধন করা হয়, যা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে তোলে। নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে দলগুলোর বিদেশি শাখা বন্ধ করা, প্রার্থীর মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ইউনিটের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নিয়মিত দলীয় নির্বাচন আয়োজন এবং দলের বিভিন্ন স্তরে এক-তৃতীয়াংশ পদে নারীদের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়।

সংশোধিত আইন প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফৌজদারি রেকর্ড, আয়ের উৎস এবং নির্বাচনী তহবিলের তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করে। ‘না’ ভোটের বিধান চালু করা হয়, যাতে ভোটাররা অনাস্থা প্রকাশ করতে পারেন। নির্বাচনী নিয়ম লঙ্ঘন করলে নির্বাচন কমিশনকে সংসদ সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। ঋণ ও বিলখেলাপিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং রাজনৈতিক দলের আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংসদ সদস্যদের কিছু বিশেষ সুবিধা, যেমন শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির অধিকার এবং বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার অধিকার, বাতিল করে। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হওয়ার আইনও বিলুপ্ত করা হয়। একই সঙ্গে যেসব ব্যক্তি অন্তত দুই বছরের কারাদণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, তাঁদের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

পরিতাপের বিষয় হলো, এ সংস্কারের বেশির ভাগই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ফখরুদ্দীন সরকারের আমলেই কিছু সংস্কার কার্যক্রম লঙ্ঘিত হতে শুরু করে। ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার অধিকাংশ সংস্কার বাতিল করে এবং আগের আইন ও চর্চাগুলো পুনঃপ্রবর্তন করে। এরপর অতিরিক্ত সংস্কারের অজুহাত দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। 

বর্তমান প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির জন্য ফখরুদ্দীন সরকারের অভিজ্ঞতা একটি শিক্ষণীয় বিষয়। তাদের ব্যর্থতার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। প্রথমত, সংস্কার প্রস্তাবের প্রণয়নে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা ও প্রয়োজন বিবেচনায় না নিয়ে একতরফাভাবে প্রস্তাব তৈরি করা হয়। এর ফলে তা জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করায় তারা সংস্কারের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ ধরনের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং প্রস্তাব বাস্তবায়নে বাধা দেয়। 

তৃতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অতিরিক্তসংখ্যক এবং বহুমুখী সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে, যা বাস্তবায়ন করা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে, তারা মনে করেছিল যে নির্দিষ্ট কিছু শক্তিশালী গোষ্ঠী বা ‘কিংস পার্টি’ এসব সংস্কার বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এটি একটি অবাস্তব চিন্তা ছিল এবং সংস্কারের কার্যকারিতা ব্যাহত করেছিল। চতুর্থত, তারা সেনাবাহিনীর ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করেছিল, যা জনগণের মধ্যে ভীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে তোলে। পঞ্চমত, শেষ মুহূর্তে তারা নিরাপদ প্রস্থান খোঁজার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আপস করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলে তাদের নেওয়া উদ্যোগগুলো কেবল খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।

বর্তমান প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাব কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা বহুলাংশে নির্ভর করছে তারা কতটা কার্যকরভাবে পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারছে সেটার ওপর। ফখরুদ্দীন সরকারের ব্যর্থতার যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর আলোকে বর্তমান কমিশনগুলোর কার্যক্রম বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, জনগণকে সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, তা কতটা সঠিক পথে এগোচ্ছে, সেটা পরীক্ষা করা জরুরি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমান কমিশনও বেশ কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে।

বর্তমান কমিশন জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য যে সার্ভে চালু করেছে, তা মূলত লোকদেখানো প্রচেষ্টা হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গঠনমূলক মতামত নেওয়ার বদলে সার্ভেতে করা প্রশ্নগুলো অগভীর ও বিভ্রান্তিকর। যেমন একটি প্রশ্ন ছিল, ‘জনপ্রশাসনকে আপনি কেমন দেখছেন? ... ক. জনবান্ধব, খ. চলতি মানের জনবান্ধব, গ. জনবান্ধব নয়।’ এমন প্রশ্ন দেখে বোঝা কঠিন, এটি গবেষণার অংশ, নাকি জনগণের মতামত নিয়ে প্রকৃত সংস্কার প্রস্তাব তৈরির চেষ্টা। আরেকটি প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার মতে, জনপ্রশাসন দলনিরপেক্ষ কি না?’ এই প্রশ্নও সংকটের গভীরতা বুঝতে ব্যর্থ এবং জনসম্পৃক্ততার অভাব স্পষ্ট করে।

সার্ভেতে যে ১৪টি প্রশ্ন করা হয়েছে, তার কোনোটিই জনগণকে প্রকৃতপক্ষে সম্পৃক্ত করার জন্য যথাযথ নয়। বরং এসব প্রশ্ন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা জনগণের কাছ থেকে প্রকৃত সমাধান খোঁজার পরিবর্তে সমস্যার তীব্রতা পরিমাপের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু যে দেশে লাখো লাখো মানুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছে, শহীদেরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই দেশে সংস্কার যে কতটা প্রয়োজন, তা প্রমাণ করার জন্য সার্ভে করার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। 

সংস্কার কার্যক্রমে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা নিশ্চিত না করা ফখরুদ্দীন সরকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কারের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি সমঝোতার সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হলেও সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণের কোনো দৃষ্টান্ত এখনো দেখা যাচ্ছে না। কমিশনগুলোর কার্যক্রমে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গ্রহণ বা সরাসরি সংলাপের কোনো প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এটা ভবিষ্যৎ সংস্কার প্রস্তাবগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

কমিশন প্রণীত প্রস্তাবগুলো যদি রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হয়, তবে তারা তা বাস্তবায়ন প্রতিরোধে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এতে যে সংস্কারপ্রক্রিয়া দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারত, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া সংস্কারের কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।

বর্তমান প্রশাসনিক সংস্কার উদ্যোগটি এমন এক পরিস্থিতিতে গৃহীত হয়েছে, যখন একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। এই স্বৈরাচারী সরকার দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার জন্য যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করেছিল, তারা ছিল প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা, বিশেষত সচিবেরা। প্রশাসনের এই স্তর স্বৈরাচারী শাসনকে টিকিয়ে রাখতে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু এখন সেই একই প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যেই সংস্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে। 

প্রশ্ন হলো, যারা এত দিন একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা বজায় রাখতে সহযোগিতা করেছে, তারা কি সত্যিই এই সংস্কারের প্রতি সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসবে? এ আশা কেবল কল্পনায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে, বাস্তবে তা কখনোই সম্ভব নয়।

প্রশাসনিক সংস্কার বাস্তবায়নের আগে সরকারের উচিত প্রশাসনকে সংস্কার উপযোগী করে তোলা। প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের যদি এখনো সচিবালয়ে তাদের পুরোনো অবস্থানে বহাল রাখা হয়, তবে তারাই প্রথমে এই সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তারা কেবল এই উদ্যোগকে ব্যর্থ করতেই সচেষ্ট থাকবে না, বরং নীতিগতভাবে এর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করবে।

যে প্রশাসনিক কাঠামো এত দিন একটি স্বৈরাচারী সরকারের আদর্শে পরিচালিত হয়েছে, সেই কাঠামো হঠাৎ করে গণতান্ত্রিক এবং জনবান্ধব সংস্কারের সমর্থক হয়ে উঠবে, এমনটি আশা করা অবাস্তব। আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটি স্থায়ী মনোভাব তৈরি হয়েছে, যেখানে ক্ষমতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা এবং কোনো বড় ধরনের পরিবর্তনের বিরোধিতা করাই তাদের প্রবণতা। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক সংস্কার কার্যক্রমকে টেকসই করতে হলে প্রথমেই প্রশাসনকে সংস্কারমুখী করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে সচিবালয়ের ভেতরে যেসব কর্মকর্তা অতীতে স্বৈরাচারী সরকারের নীতিগুলো বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা এবং দোষী সাব্যস্ত হলে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। প্রশাসনের মধ্যে যাঁরা সংস্কারের পক্ষে কাজ করতে আগ্রহী এবং যাঁরা গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাঁদের নিয়ে একটি নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন।

এর পাশাপাশি বর্তমান সংস্কার কমিশনগুলোর কার্যক্রম যেন শুধু তাত্ত্বিক বা কাগজে–কলমের বিষয় না হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। জনগণ তাদের কাছে নিখুঁত বা তাত্ত্বিক কোনো প্রস্তাব আশা করছে না। জনগণ এমন একটি কার্যকর সংস্কার চায়, যা শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করতে সক্ষম এবং দেশের ভবিষ্যৎকে চিরস্থায়ীভাবে নিরাপদ করে তুলবে। এ জন্য এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে কখনোই আর কোনো স্বৈরাচারী সরকার জন্ম নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।

 বর্তমান কমিশনগুলো যদি এই লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে এটি শুধু তাদের ব্যর্থতা নয়, বরং পুরো জাতির ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হবে। শহীদদের আত্মত্যাগ এবং লাখো মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানাতে হলে সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে বাস্তবমুখী এবং কার্যকর করতে হবে। এটাই একমাত্র উপায়, যা দেশের ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করবে।

ড. সৈয়দা লাসনা কবীর অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • মোহাম্মাদ ঈসা ইবনে বেলাল গবেষক