রমজানে সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন
মানবজীবনে তাকওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ইখলাস ও তাকওয়া সফলতার অবলম্বন। তাকওয়া হলো আল্লাহর ভালোবাসা হারানোর ভয়, আল্লাহর অসন্তোষের ভয়। প্রকৃত মুমিন তাকওয়া দ্বারাই পরিচালিত হন। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সৎকাজে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা যারা ইমান এনেছ, তারা তাকওয়া অর্জন করো।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৭০)। কোরআন করিমে বলা হয়েছে, ‘যারা ইমান আনল এবং তাকওয়া অর্জন করল, তারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের কোনো ভয় নেই, তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ৬২)।
মুত্তাকি অর্থ পরহেজগার, সতর্ক, সচেতন বা তাকওয়াবান ব্যক্তি, যার বহুবচন হলো মুত্তাকুন ও মুত্তাকিন। তাকওয়া শব্দের একটি প্রতিশব্দ হলো ‘খওফ’। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা তার রবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে দুটি করে জান্নাত।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ৪৬)।
তাকওয়া শব্দের আরেকটি প্রতিশব্দ হলো ‘খাশিয়াত’। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন, ‘তুমি শুধু তাকেই সতর্ক করতে পারো, যে উপদেশ (কোরআন) মেনে চলে এবং না দেখেও দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে। তুমি তাকেÿক্ষমা ও সম্মানজনক পুরস্কারের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা-৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ১১)।
হিদায়াত মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান নিয়ামত। তাই আল্লাহ তাআলা সুরা ফাতিহায় মানুষকে হিদায়াতের প্রার্থনা শিখিয়েছেন, ‘আমাদের সঠিক সরল পথ দেখান।’ (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ৪)। হিদায়াত প্রাপ্তির পূর্বশর্ত তাকওয়া। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বললেন, ‘এই কোরআন মুত্তাকিদের জন্য হিদায়াত।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২)।
মানব প্রবৃত্তির যেসব নেতিবাচক গুণ বা বৈশিষ্ট্য মানুষের জ্ঞানকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের বলা হয় রিপু বা শত্রু। এরা মূলত জ্ঞানের শত্রু। ষড়্রিপু বা ছয় শত্রু হলো—কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য। এগুলো মানুষের মানবীয় ইতিবাচক গুণাবলির শত্রু। এসবের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সুসভ্য ও উন্নততর করে। এগুলোর যথেচ্ছ, অনিয়ন্ত্রিত ও অপব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়। অধঃপতনের অতলে নিমজ্জিত করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি বহু জিন ও ইনসানকে (তাদের কর্মদোষে) জাহান্নামের জন্য নির্ধারণ করেছি—তাদের অন্তর আছে কিন্তু অনুধাবন করে না, চক্ষু আছে কিন্তু দেখে না, কর্ণ রয়েছে কিন্তু শ্রবণ করে না; তারা চতুষ্পদ জন্তু বা পশুতুল্য বরং তারা তার চেয়েও নিকৃষ্ট; তারা উদাসীন।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ১৭৯)।
তাকওয়া তথা রমজানের উদ্দেশ্য হলো ষড়্রিপুর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের নৈতিক শক্তি অর্জন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা এভাবে আল্লাহর ইবাদত করো, যেন তোমরা তাকে দেখছ; যদি তোমরা তাঁকে দেখতে না পাও, তবে নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) তোমাদের দেখছেন।’ (বুখারি: ৪৮)। পঞ্চেন্দ্রিয়—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক এবং দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক সংযত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করাই হলো রোজা। দেহ ও মনকে অন্যায় ও নিষিদ্ধ কাজ ও বস্তু হতে বিরত রাখাই রোজার উদ্দেশ্য। সারা জীবন এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতা অর্জন করাই হলো রোজার সফলতা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানবদেহে এমন একটি গোশতের টুকরা আছে, যা পরিশুদ্ধ হলে তার পুরো দেহ পরিশুদ্ধ হয়, সঠিকভাবে কাজ করে; আর তা বিনষ্ট হলে তার সমস্ত দেহই বিনষ্ট হয়, সঠিকভাবে কাজ করে না; জেনে রেখো, তা হলো কলব।’ (বুখারি: ৫০)।
তাকওয়া হলো প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রোজা-মুখের বা জবানের রোজা হলো-কুবাক্য ও কুকথা পরিহার করা, পরচর্চা, গিবত শেকায়াত ও পরনিন্দা থেকে বিরত থাকা। চোখের রোজা হলো হারাম দৃশ্য দেখা বর্জন করা। কানের রোজা হলো হারাম শোনা হতে বেঁচে থাকা। হাতের রোজা হলো হারাম ধারণ ও হারাম স্পর্শ থেকে দূরে থাকা। পায়ের রোজা হলো অন্যায় পথে গমন বা পদচারণ না করা।
মন, মস্তিষ্ক ও অন্তরের রোজা হলো পাপ ও অন্যায় চিন্তা, কল্পনা ও পরিকল্পনা হতে মুক্ত থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রবণ, দর্শন ও চিন্তন—এসব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ৩৬)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]