উচ্চ গুণমানসম্পন্ন বিজ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে চীন এখন বিশ্বে শীর্ষ স্থান দখল করে নিয়েছে। আমি আমার গবেষণায় খুঁজে পেয়েছি, চীনের বিজ্ঞানীরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে সেরা বিজ্ঞান সাময়িকীগুলোতে অন্য যেকোনো দেশের গবেষকদের তুলনায় বেশি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন শুধু নিজেদের বিজ্ঞান সক্ষমতা অনেক গুণ বাড়ায়ইনি, এ ক্ষেত্রে দেশটির নাটকীয় উত্থানও ঘটেছে। বিজ্ঞানে চীনের এই আধিপত্য বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করে ফেলে কি না, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে চীন সরকার বিগত বছরগুলোতে যেসব নীতি নিয়েছে, তারই ফল চীনের আজকের এই সাফল্য। এই অবস্থানে আসতে চীন সুস্পষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলেই যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চীনকে প্রতিযোগী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে।
১৯৭৭ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী দেং শিয়াওপিং দেশটির আধুনিকায়নের জন্য চারটি পথের সূচনা করেন। এর একটি ছিল চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের বিকাশ শক্তিশালী করা। ২০০০ সালের দিকেও চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা অনেক গুণ বেশি বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করতেন। যাহোক, গত তিন দশক চীন সরকার দেশটির গবেষণা সক্ষমতা বাড়াতে অনেক গুণ বিনিয়োগ বাড়ায়। এ সময়ে চীন শিক্ষার্থী ও গবেষকদের পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে পাঠায়। ব্যবসায়ীদেরও হাই-টেক পণ্য উৎপাদনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত চীন ৫২ লাখ শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞকে পড়াশোনার জন্য বাইরে পাঠিয়েছে। এর বেশির ভাগই বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের বিভিন্ন বিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন। তাঁদের অনেকে বিদেশে থেকে গেলেও বেশির ভাগই দেশে ফিরে বিজ্ঞান গবেষণাগার ও হাই-টেক কোম্পানিগুলোতে কাজ করছেন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক বিজ্ঞানের বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। আধুনিক বিশ্বে গবেষকেরা পারস্পরিক জ্ঞান ও ধ্যানধারণার বিনিময়ের ওপর নির্ভরশীল। গবেষণা ফলাফল এমন সব সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় যে কেউ যাতে সেখান থেকে পড়তে পারেন। বিজ্ঞান এখন তাই যেকোনো সময়ের তুলনায় আন্তর্জাতিক ও সহযোগিতামূলক রূপ গ্রহণ করেছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় অবস্থানে এখন চীন। দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় এখন বেশিসংখ্যক পিএইচডি ডিগ্রিধারী বের হন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানে নাটকীয় উন্নয়ন হয়েছে।
২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো চীনের বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের ছাড়িয়ে যায়। একসময় চীনের গবেষণা ছিল নিম্নমানের এবং সেগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনুকরণ করা হতো। ২০০০-এর দশকেও চীনের বিজ্ঞানীদের বেশির ভাগ গবেষণাকর্ম বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারত না। কিন্তু চীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানোয় শুধু সংখ্যা নয়, গবেষণাপত্রের গুণমানেও বিস্ফোরণ ঘটেছে।
আমি ও আমার সহকর্মীরা মিলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রকাশিত শীর্ষ ১ শতাংশ গবেষণাকর্মের একটি তালিকা করেছি। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বছর ধরে ধরে আমরা তুলনা করেছি, কোন দেশের কতটা গবেষণাপত্র সেখানে স্থান পেয়েছে। ২০১৯ সালে, প্রভাবশালী গবেষণাকর্মের বেশিসংখ্যক লেখক ছিলেন চীনের। শীর্ষ ক্যাটাগরিতে চীনের বিজ্ঞানীদের ৮ হাজার ৪২২টি নিবন্ধ যেখানে স্থান করে নেয়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ৭ হাজার ৯৫৯টি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬ হাজার ৭৪টি নিবন্ধ স্থান পায়। ২০২২ সালের কিছু তুলনার দিকেও নজর দেওয়া যাক। এ বছর চীনের বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের চেয়ে তিন গুণ বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ন্যানোসায়েন্স, রসায়ন ও পরিবহনবিদ্যার ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়।
সামরিক ও অর্থনৈতিক—দুই ক্ষমতার সঙ্গে বিজ্ঞানে সক্ষমতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এ সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিজ্ঞানে চীনের উত্থান নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এ জন্য চীনের বিকাশ শ্লথ করে দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
সম্প্রতি পাস হওয়া চিপস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্ট-২০২২-এ স্পষ্টভাবে গবেষণা ও উৎপাদনের কিছু ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে সহযোগিতা সীমিত করে ফেলা হয়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে বাইডেন প্রশাসন সামরিক ক্ষেত্রে চীনের প্রযুক্তির ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক বিজ্ঞানের বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। আধুনিক বিশ্বে গবেষকেরা পারস্পরিক জ্ঞান ও ধ্যানধারণার বিনিময়ের ওপর নির্ভরশীল। গবেষণা ফলাফল এমন সব সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় যে কেউ যাতে সেখান থেকে পড়তে পারেন। বিজ্ঞান এখন তাই যেকোনো সময়ের তুলনায় আন্তর্জাতিক ও সহযোগিতামূলক রূপ গ্রহণ করেছে। ক্যানসার, কোভিড-১৯ মহামারি, কৃষিসহ নানা খাতে যৌথ গবেষণার দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। আমার নিজের করা গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, যখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা একসঙ্গে কোনো গবেষণা করেন, সেটির গুণগত মান অনেক ভালো হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চীন শীর্ষ দেশে পরিণত হওয়ায় অনেকে বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য বদলের যে শঙ্কা করছেন, তার পেছনে যৌক্তিক কারণ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিজ্ঞানে চীনের এই উত্থানে যুক্তরাষ্ট্রও লাভবান হচ্ছে।
● ক্যারোলিন ওয়াগনার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মিল্টন অ্যান্ড রসলিন উলফ চেয়ার, দ্য ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি