গত ৭ জানুয়ারি বহুল আলোচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর চার মাস পর গতকাল ৮ মে থেকে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট হয়ে গেল। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দলটির স্থানীয় কিছু নেতা নির্বাচনে অংশ নিলেও অনুমিতভাবেই তাঁরা খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি। এর ফলে প্রায় ‘একতরফা’ (আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ) এ নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বা উৎসাহ-উদ্দীপনা খুব একটা চোখে পড়েনি। নির্বাচনে ভোট প্রদানের হারও ছিল খুব কম এবং প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারা ও জাল ভোট দেওয়াসহ নানা রকম অনিয়ম-অসংগতির ঘটনা ঘটে। (উপজেলা নির্বাচনে কম ভোটের রেকর্ড, সমকাল, ৯ মে ২০২৪)
একটি ‘একতরফা’ এবং উৎসাহ-উদ্দীপনাহীন উপজেলা নির্বাচন নিয়েও বেশ কিছুদিন ধরে নির্বাচন কমিশনকে বেশ তৎপর দেখা গিয়েছিল। স্বয়ং নির্বাচন কমিশনাররা বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্যে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’—এ রকম কথাও ছিল। ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ ও ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ নিয়ে তাঁরা যা বলেছিলেন এবং যেসব উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন, সেটা থেকেই উপজেলা নির্বাচন কেমন হবে তার একটি ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে গত ২৫ এপ্রিল সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে সব জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সেই বৈঠক শুরুর আগে তিনি বলেন, ‘এবারের উপজেলা নির্বাচন ব্যর্থ হলে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা ক্ষুণ্ন হবে।’ (উপজেলা নির্বাচন ব্যর্থ হলে ৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র ক্ষুণ্ন হবে: সিইসি, বণিক বার্তা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪)
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে মাঠের ও ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক বিরোধী দল অনুপস্থিত ছিল। যখন একটি নির্বাচনে দেশের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের একটি দল অনুপস্থিত থাকে এবং ‘একতরফা’ নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে কি আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব? তাহলে সিইসি কোন যুক্তিতে এমন কথা বললেন?
কথা এখানেই শেষ নয়। ওই বৈঠকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও কিছু ঘটনা ঘটে, যা ছিল বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এ নিয়ে সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বৈঠক সূত্র জানায়, সভার বড় অংশজুড়েই ছিল ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ। দেশ-বিদেশে এ নির্বাচন নিয়ে নানা সমালোচনা থাকলেও গতকালের বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। কমিশনের তরফ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে যেমন সাধুবাদ দেওয়া হয়, তেমনি ডিসি-এসপিরাও কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের প্রশংসা করেন।’ (মন্ত্রী-এমপির ‘তৎপরতা’ নিয়ে শঙ্কা, সমকাল, ২৬ এপ্রিল ২০২৪)
৭ জানুয়ারির নির্বাচন শুধু ‘একতরফা’ ছিল না, এ নির্বাচনে আরও কিছু গুরুতর অসংগতি লক্ষ করা গেছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ৪১ দশমিক ৮০ ভাগ বলা হলেও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। (ভোটের হার নিয়ে সন্দেহ, প্রশ্ন, প্রথম আলো, ৯ জানুয়ারি ২০২৪)।
৭ জানুয়ারির যে নির্বাচন নিয়ে এত সব প্রশ্ন ও অভিযোগ উঠেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা সেই নির্বাচনেরই প্রশংসা করেছেন! তাঁদের এই ‘প্রশংসা’ কতটা যুক্তিসংগত ছিল? তাঁরা কি ওই নির্বাচন নিয়ে অন্যদের অভিজ্ঞতা একটুও আমলে নেননি?
শুধু বিরোধী দলগুলো নয়, গত সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া বেশ কিছু দল ও প্রার্থীর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি গবেষকেরাও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ও নানা রকম অভিযোগ তুলেছেন। নির্বাচনে ভোটের হার নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে স্বয়ং সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদেরও আছেন। বেশ কিছুদিন আগে তিনি লিখেছেন, ‘ফলে ৪২ শতাংশ ভোট পড়ার দাবি বাস্তবসম্মত নয় মনে করি। বরং ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছেন। কিছু কিছু এলাকায় ২০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণা।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, কীভাবে গড়ে ৪২ শতাংশ ভোট হিসেবে গণনায় এল? এটা সম্ভব শুধু যদি বেশ কিছু ব্যালট পেপারে অবৈধভাবে সিল মেরে প্রার্থীদের পক্ষে দেখানো হয়। অথবা ব্যালট গণনা ছাড়াই নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের পছন্দমতো ফলাফল তৈরি ও ঘোষণা করেন।
যুক্তিসংগতভাবে আশঙ্কা করার কারণ আছে যে প্রচুর অতিরিক্ত ভোট, যা ভোটাররা দেননি, সেগুলো যেকোনো প্রকারে ফলাফলে দেখানো হয়েছে। যাঁর পক্ষে দেখানো হয়েছে, তিনি জয়ী হয়েছেন। ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বাস্তবতার আলোকে অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলা যায় না।’ (দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আসলে কেমন হলো, প্রথম আলো, ২৭ মার্চ ২০২৪)
শুধু বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতার কাছ থেকেও একই রকম কথা শোনা গেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে সব চেষ্টা যে বৈধ ছিল, তা নয়। অনেক অপকর্মও করেছি। এখন যেকোনো নির্বাচনে ১০-১৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে না।’ (‘৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের প্রার্থী রুহেলকে জেতাতে আমরা অনেক অপকর্ম করেছি’, প্রথম আলো অনলাইন, ৩০ এপ্রিল ২০২৪)
৭ জানুয়ারির যে নির্বাচন নিয়ে এত সব প্রশ্ন ও অভিযোগ উঠেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা সেই নির্বাচনেরই প্রশংসা করেছেন! তাঁদের এই ‘প্রশংসা’ কতটা যুক্তিসংগত ছিল? তাঁরা কি ওই নির্বাচন নিয়ে অন্যদের অভিজ্ঞতা একটুও আমলে নেননি?
শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার নন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে একই রকম কথা বলেছিলেন আরেক নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা। গত ২৮ এপ্রিল দুপুরে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে তিনি রংপুর বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা, গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। মতবিনিময় শেষে রাশেদা সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিগত যে জাতীয় নির্বাচনটি করেছি, সে নির্বাচন নিয়ে প্রত্যেকে একবাক্যে বলেছেন, নির্বাচন অভূতপূর্ব সুষ্ঠু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও অবাধ করতে চাই।’ (সবাই একবাক্যে বলেছেন, বিগত নির্বাচন অভূতপূর্ব সুষ্ঠু হয়েছে: ইসি রাশেদা সুলতানা, প্রথম আলো অনলাইন, ২৮ এপ্রিল ২০২৪)
নির্বাচন কমিশনারদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, সব অভিযোগ ও ভিন্নমতকে উড়িয়ে দিয়ে তাঁরা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘অভূতপূর্ব সুষ্ঠু’ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো আত্ম-অনুশোচনা তো নেই-ই; বরং প্রবল আত্মসন্তুষ্টি লক্ষ করা গেছে। এ কারণে উপজেলা নির্বাচনেও তাঁরা একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কথা বলেছিলেন। তাঁদের এসব কথা ও কর্মকাণ্ড কি নির্বাচন নিয়ে কোন আশা-ভরসা তৈরি করতে পেরেছে, নাকি মানুষকে আরো বেশি হতাশ করেছে?
৮ মে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৩০-৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে। কমিশনের এই দাবি সত্যি হলেও এটা কম ভোটের রেকর্ড। কম ভোট পড়া নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ভোটাররা ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় কেন্দ্রে যাননি। (উপজেলা নির্বাচনে কম ভোটের রেকর্ড, সমকাল, ৯ মে ২০২৪)।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য? ভোটারদের ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য তিনি যে কারণের কথা বলেছেন, সেটা কি কোন গবেষণালব্ধ তথ্য? তাহলে তাঁর এই বক্তব্যের ভিত্তি কী? নির্বাচন নিয়ে এসব ‘মনগড়া’ কথা আর কত দিন চলবে?
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক