সকালটা শুরু হলো একটা নেতিবাচক খবর দিয়ে। আমরা জানতে পারলাম, সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে ২৯ মার্চ ভোর চারটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের আমবাগান এলাকার বাড়ি থেকে সাদাপোশাকের লোকেরা তুলে নিয়ে যান। তাঁরা নিজেদের সিআইডির লোক বলে পরিচয় দেন। আমরা সিআইডি অফিসে যাই, কর্মকর্তাদের কারও কারও সঙ্গে দেখা করি, কেউই কিছু জানেন বলে স্বীকার করেননি।
দুপুর নাগাদ জানতে পরলাম, রাত ২টা ১৫-এর দিকে তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছেন একজন ব্যক্তি, তাঁর নাম সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া (৩৬)।
মামলার বিষয়টা নিশ্চয়ই প্রথম আলো আইনের পথেই মোকাবিলা করবে।
তবে কোনো কোনো মাধ্যমে প্রথম আলোর অনলাইন খবর ও ফেসবুক পোস্ট নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেও বোঝা যাচ্ছে, বহু মানুষ আসল খবর ও পোস্ট না পড়ে শুধু স্ক্রিনশটের ভিত্তিতে ভুল বা খণ্ডিত ধারণা পাচ্ছেন। তাই এ ব্যাপারে প্রথম আলোর অবস্থান ও বক্তব্য আগে জেনে নেওয়া দরকার।
২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সবুজ মিয়া নামে সাভার স্মৃতিসৌধে ফুলবিক্রেতা এক শিশুর বক্তব্য দেওয়া হয়। প্রতিবেদনের তথ্য নেওয়া হয়েছিল ২৫ মার্চ, এটি প্রকাশের আগের দিন। স্মৃতিসৌধ বন্ধ ছিল। সবুজ মিয়ার উল্লেখ করে প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘স্বাধীনতা দিবসে তার অপেক্ষা প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশি ফুল বিক্রির। সবুজ বলে, “এখন স্মৃতিসৌধের ভেতরে ঢুকতে দেয় না। কাল (আজ) ঢুকতে দিব। তখন অনেক ফুল বিক্রি হইব।”’ প্রতিবেদনে সবুজ মিয়ার ছবিও প্রকাশিত হয়েছিল। একই প্রতিবেদনে জাকির হোসেন নামে সাভার স্মৃতিসৌধ এলাকার এক দিনমজুরের বক্তব্যও উদ্ধৃত হয়। তিনি বলেন, ‘বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’
এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। সেখানে উদ্ধৃতিটি ছিল দিনমজুর জাকির হোসেনের। আর ছবি ছিল ফুল বিক্রেতা শিশু সবুজ মিয়ার। ফেসবুক পোস্টে ছবি আর উদ্ধৃতির অমিল নজরে পড়ার পর দ্রুতই প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেওয়া হয়।
পাঠকদের মধ্যে যাতে ভুল-বোঝাবুঝি না হয়, সে উদ্দেশ্যে প্রথম আলো অনলাইনের শিরোনাম সংশোধন করা হয় এবং সবুজ মিয়ার ছবিটি প্রতিবেদন থেকে তুলে দেওয়া হয়।
সাংবাদিকতায় পালনীয় রীতি অনুযায়ী সেই প্রতিবেদনের নিচে প্রথম আলো ডট কম একটি সংশোধনী যুক্ত করে জানায়, ‘প্রথমে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের শিরোনাম এবং ব্যবহার করা ছবিটি তুলে নেওয়া হয়েছে এবং শিরোনাম সংশোধন করা হয়েছে। শিরোনামে উদ্ধৃত বক্তব্য ছবিতে থাকা সবুজ মিয়ার ছিল না, ছিল দিনমজুর জাকির হোসেনের। একই কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্টও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।’
এ থেকে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটে যেতে পারত। তা হয়নি। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে কেউ কেউ প্রচারণার অভিযানে অবতীর্ণ হন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতন নাগরিকদের অনেকেই প্রথম আলোর পক্ষাবলম্বন করে মত, মন্তব্য, পোস্ট দিতে থাকেন।
সাংবাদিকতা ও লেখালেখির দীর্ঘ ৩৬ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, প্রথম আলোর খবরে কোনো ভুল ছিল না। ফেসবুকের পোস্টটিও ভুল নয়, তবে তাতে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ রয়ে যায়। বক্তব্য দিনমজুর জাকিরের, কিন্তু ছবি ফুল বিক্রেতা শিশুর; পাঠকেরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, এই শিশু কি এমন কথা বলতে পারে। আমি তা-ই পাঠককে দোষ দেব না। প্রথম আলো এই ভুল বোঝার অবকাশ না দিলে সবচেয়ে ভালো করত।
এখন আসি, ক্ষুধা এবং স্বাধীনতা বিষয়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো নিজে বলে গেছেন, ‘এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়।...এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসেই রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু এ কথা বলেন।
স্বাধীনতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির ভাষণ থেকেই আরেকটা উদ্ধৃতি দিই: ‘ইনশা আল্লাহ, স্বাধীন যখন হয়েছি, স্বাধীন থাকব—একজন মানুষ এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকতে এই সংগ্রাম চলবে।’ স্বাধীনতা মানে তো কেবল উৎসব নয়, উৎসবও মূল্যবান, কিন্তু স্বাধীনতা মানে প্রত্যেকটা নাগরিকের ভাতের অধিকার, ভোটের অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
শামসুজ্জামানকে নিঃশর্ত মুক্তি দিন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে নিন। শামসুজ্জামানের বিধবা এবং সন্তানহারা মাকে একটু শান্তি দিন। ২০১৬ সালে গুলশানের হোলি আর্টিজানে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন শামসুজ্জামানের ভাই পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম। বড় ছেলেকে হারানোর পর এখন একমাত্র সন্তান শামসুজ্জামানকে ঘিরেই যে মা করিমন নেসার জগৎ।
আমরা আমাদের পাঠকদের আশ্বস্ত করতে চাই যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আমাদের সাংবাদিকতার মূল প্রেরণা এবং অভীষ্ট। প্রথম আলো বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য লেখা, বিশেষ সংখ্যা, ক্রোড়পত্র ও অনেক বই প্রকাশ করেছে আমাদের অগ্রগতি আর অর্জন নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমরা ধারণ করি, রক্ষা করি চোখের মণির মতো। আমাদের কোনো শব্দচয়নে বা ছবি নির্বাচনে ভুল হতে পারে, তা আমরা বিশ্বজুড়ে চর্চিত রীতি মেনে সংশোধন করি এবং মুক্তিযুদ্ধের কম্পাস দিয়ে আমরা আমাদের চলার পথটাকে নির্ধারণ করে নিই। এখানে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই, আপসও নেই। আমরা বিশ্বাস করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ সব বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিজয়ী হবেই।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক