ঈদুল আজহার আনন্দে ডেঙ্গু যেন বিষাদের কারণ না হয়

কি গ্রাম, কি শহর—সব স্থানেই বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।ফাইল ছবি

মশার অত্যাচার আর চোখরাঙানিতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। এ বছরের ১২ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩৯ জন। ৩ হাজার ১৫০ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গুতে।যেকোনো ধরনের উৎসবের আমেজে আমাদের সবকিছুরই দাম যেমন বাড়ে, বাড়ে ভোগান্তিও। এই যেমন বছরের দুই ঈদে মানুষের প্রয়োজনীয় ভ্রমণে অসম্ভব কষ্ট পোহাতে হয় রাস্তাঘাটে, একইভাবে যাতায়াতের পরিবহনটি পাওয়াও হয়ে ওঠে সোনার হরিণ। কি বাস, কি ট্রেন, কি লঞ্চ, কি বিমান—সব পথেই অসম্ভব ভিড় ও ভোগান্তি। এর ওপর রয়েছে জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি।

পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে যেমন প্রয়োজনীয় উপকরণের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, ঈদুল আজহার আগে কোরবানির পশুর মূল্যবৃদ্ধি পায়, তেমনি বৃদ্ধি পায় জনস্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ সংক্রামক রোগের প্রবণতা। ডেঙ্গু একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রমান্বয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠা মারাত্মক রোগ। একদিকে বর্ষাকাল শুরু হয়েছে, অন্যদিকে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল বৃদ্ধির সময় শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে আমাদের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল আজহার পুরাদস্তুর প্রস্তুতি। এই ধর্মীয় উৎসবের সবচেয়ে বড় দিক হলো পশু কোরবানি করা। আমাদের দেশের খামারিরা সারা বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁদের প্রাণপ্রিয় গরু-ছাগলকে বাজারজাত করেন কিছু লাভের আশায়।

দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই গরুর হাট বসেছে। এই হাটের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে মশা প্রজননের স্থান। গরুকে পানি পান করানোর ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে পানির উৎস ও সরবরাহের ব্যবস্থাপনা যদি সঠিক নিয়ম মেনে না হয়, তবে শুধু এডিস মশাই নয়, সবচেয়ে বিরক্তির কিউলেক্স মশার ঘনত্ব অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গরুর বাজারের পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্যস্ততা আর লাভের আশায় অনেক সময় খামারিরা নিজেই খাবার খেতে ভুলে যান, তাঁদের চারপাশে কোথায় পানি জমে থাকল আর কোথায় ময়লা–আবর্জনা জমে পরিবেশের প্রভূত ক্ষতি সাধন করল, তা তাঁদের মাথায় থাকার কথা নয়। তাই গরুর হাটের ইজারাদার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অবশ্যই বিষয়গুলো অতি গুরুত্বসহকারে নেবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবেন।

প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খামারিরা ঢাকা শহরে যেমন বিভিন্ন আবাসিক এলাকার গরুর হাটে আসেন, আবার হাট শেষে এলাকায় ফিরে যান। এভাবে শহর থেকে একেবারে প্রত্যন্ত এলাকার সংক্রমিত মশা অথবা মশার ডিম অতি সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে। সংক্রমিত মশা একবার যখন কোনো এলাকার ঢুকে পড়বে এবং ওই এলাকার অসংক্রমিত মশাকে সংক্রমণের আওতায় নিয়ে আসবে, তখন পরিস্থিত আরও যে কত বেশি ভয়ংকর হবে, তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে যেসব পরিবার শহর ছেড়ে নাড়ির টানে গ্রামে যাচ্ছে ঈদ করতে, তাদের সামান্য অসাবধানতা জন্য নিজের তালাবদ্ধ বাড়িটি হয়ে উঠতে পারে এডিস মশার কারখানা।

কারণ, এবার ঈদে একটি লম্বা ছুটি রয়েছে। যাঁরা ১৯ ও ২০ জুন ছুটি নেবেন, তাঁরা তো এক সপ্তাহের বেশি সময় পাবেন, যে সময় এডিস মশার ডিম ফুটে লার্ভা, পিউপাল, স্টেজ পার করে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তরিত হওয়া অতি সহজ। তাই বাড়ি তালাবদ্ধ করার আগে সঠিকভাবে নিশ্চিত হবেন সব পানির উৎস বন্ধ আছে কি না এবং পানির পাত্রগুলো শুকনা রাখার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি না। যদি ছাদে কোনো পানির উৎস থাকে, তাহলে অবশ্যই তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বা প্রয়োজনীয় লোক নিয়োগ করতে হবে।

নির্মাণাধীন বাড়ির কর্মীদের ছুটিতে যাওয়ার আগে অবশ্যই বাড়িতে পানি জমা হওয়ার সব উৎস নির্মূল করতে হবে অথবা একজন দক্ষ মানুষকে দায়িত্ব যথার্থভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।  বাথরুমের কমোডের ঢাকনা বন্ধ করে রেখে যেতে হবে। সব পাত্র উল্টো করে রাখতে হবে। গ্যারেজে গাড়ি ধোয়ার পর তা অবশ্যই শুষ্ক করে তারপর গ্যারেজ ত্যাগ করতে হবে। গ্যারেজে যাঁরা গরু বা ছাগল রাখছেন কোরবানির জন্য, তাঁদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, কোনোভাবেই যেন পানি পরিত্যক্ত অবস্থায় না থাকে। এবার আসি কোরবানির পশু জবাই দেওয়ার পরবর্তী অবস্থার কথা।

কোরবানির মহত্ত্ব তখনই প্রকৃতভাবে ফুটে উঠবে, যখন কোরবানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকাণ্ডই মানুষ তথা কোনো জীবের জন্যই কষ্ট বা ভোগান্তির কোনো কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। তাই কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হাসিল যেমন আল্লাহর তুষ্টি, তেমন সব জীবের প্রতি সুবিচার করাও আল্লাহর আদেশ। তাই এই বর্জ্য থেকে কোনোভাবেই যেন কোনো ধরনের রোগজীবাণু ছড়াতে না পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

কোরবানির ক্ষতিকারক বর্জ্য হতে পারে জমির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রধান উপাদান। তবে তার জন্য চাই সঠিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা। কি গ্রাম, কি শহর—সব স্থানেই বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এটাকে জীবাণু বা তার বাহকের উৎসে পরিণত করা যাবে না। মশা ও মাছি উভয়েই এ বর্জ্য দ্বারা দূষিত স্থানে প্রজনন ঘটাবে।

  • মো. গোলাম ছারোয়ার, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)