ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত গণ–অভ্যুত্থানের ফলে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কগুলো পুনর্নির্মাণের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হাজির হয়েছে। ছাত্রদের বর্তমান চাহিদা ‘রাষ্ট্র সংস্কার’।
এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় দাবি। কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের তার চেয়েও বেশি কিছু দাবি করা উচিত। রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উচিত রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্ক সংস্কারের দাবি জানানো।
রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যকার সম্পর্কগুলো পরিচালনা ও মধ্যস্থতা করার জন্য আমরা যদি বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার এবং নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি না করতে পারি, তবে ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা অধরাই রয়ে যাবে।
আগের আমলের ফাঁপা, পদ্ধতিগত প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের বদলে আমাদের দরকার প্রকৃত, প্রত্যক্ষ ও আলোচনাপ্রসূত গণতন্ত্র।
উদারনৈতিক, প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের জন্য যে ধরনের জবাবদিহি এবং নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের ব্যবস্থা প্রয়োজন, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আগের শাসনামলগুলোয় সেগুলোকে চরমভাবে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকেই প্রত্যক্ষ জবাবদিহি নিশ্চিতের পদ্ধতি হিসেবে নির্বাচনী ব্যবস্থার কার্যকারিতা হারিয়েছে।
এর পাশাপাশি রাষ্ট্রকে পরোক্ষভাবে জবাবদিহির সামনে আনার জন্য সংসদীয় কমিটি, বিচার বিভাগ বা গণমাধ্যমের মতো মধ্যবর্তী যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, গত ১৫ বছরের প্রায়-সর্বাত্মকবাদী শাসন সেগুলোকে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ করেছে। কীভাবে আমরা রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্কগুলোকে পুনর্গঠন করতে পারি?
কীভাবে এই মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক অভিজাতদের গ্রাসমুক্ত থাকবে? কীভাবে আমরা নিশ্চিত করব যে ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের ব্যবস্থাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে না?
কী ধরনের পদ্ধতি ও ব্যবস্থা আমরা তৈরি করতে পারি, যেগুলো নিশ্চিত করবে, জবাবদিহি ও নাগরিক নজরদারির প্রক্রিয়াগুলো প্রতিদিন প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে?
আমাদের দেশে স্বৈরাচারী ও অনুদার শাসনের দীর্ঘ ইতিহাসের পাশাপাশি কার্যত একটি কর্তৃত্ববাদী আধিপত্যকারী দল-রাষ্ট্রভিত্তিক কাঠামোর প্রতি রাজনৈতিক এলিটদের প্রবল আগ্রহ এবং নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের অনিশ্চয়তার প্রতি তাদের বিতৃষ্ণা আমরা লক্ষ করেছি।
মূল দুশ্চিন্তার বিষয় হলো সংস্কারসাধনের পর তা টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হওয়া সংস্কারগুলোর করুণ পরিণতিই মূলত এ দুশ্চিন্তার কারণ।
সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১০০টিরও বেশি আইন ও অধ্যাদেশের পাশাপাশি তৈরি করেছিল নতুন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর অধিকাংশই ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গায়েব হয়ে যায়।
যেগুলো বজায় ছিল, সেগুলোও দলের কর্মীদের দ্বারা কুক্ষিগত বা সরকারের ভেতর থেকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলা হয়েছিল। আমরা কীভাবে আশ্বস্ত হব যে ভবিষ্যৎ শাসক দল একই কাজ করবে না?
কীভাবে আমরা একটি সুসংহত পাল্টা শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যা এ ধরনের প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেবে? এই দুর্ভাবনাগুলো নিরসনের জন্য, আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্কগুলোর দুটি জায়গায় পুনরায় ভাবতে হবে এবং পুনর্গঠন করতে হবে—১. প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র, এবং ২. রাষ্ট্র-সমাজের জবাবদিহির সম্পর্ক।
প্রথমেই গণতন্ত্রের ধারণা নিয়ে পুনরায় চিন্তা করতে হবে এবং এর সংজ্ঞাকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলতে এযাবৎ প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রকেই বোঝানো হয়েছে, যেখানে মূলত এর পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এটি গণতন্ত্রের পদ্ধতিগত রূপ। গণতন্ত্রের প্রকৃত ধর্মগুলো উপেক্ষা করে শুধু তার পদ্ধতিগত বিষয়াবলিতে আটকে যাওয়ার বিপদ এ ধরনের গণতন্ত্রে রয়েছে।
আগের আমলের কারচুপির নির্বাচনগুলো যার উদাহরণ। একটি অন্তঃসারশূন্য পদ্ধতিগত গণতন্ত্রের বদলে আমাদের প্রয়োজন একটি প্রকৃত গণতন্ত্র, যেখানে গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে এবং যার মাধ্যমে সংবিধানের প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সত্যিকার মালিক হিসেবে জনগণ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমাদের দরকার রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ত হওয়ার আরও প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা—যেমন পর্যায়ক্রমিক গণভোট ও আলোচনা সভা। এগুলো হবে সংলাপনির্ভর এবং প্রাধান্য দেবে সর্বসম্মতিকে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে নয়।
গণতন্ত্রের এ ধরনের প্রত্যক্ষ, আলোচনাপ্রসূত ও প্রকৃত রূপ আমাদের বেশ কিছু বিষয় থেকে রক্ষা করবে। যেমন একচেটিয়া দলতন্ত্র, ‘বিজয়ীরাই সব পাবে’ ব্যবস্থা এবং আধিপত্যকারী দল-রাষ্ট্রের (যেখানে একটি দলই সব সিদ্ধান্ত নেয়) পুনরুত্থান।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হচ্ছে, যেমন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, ভোটের হার অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিলোপ। উল্লেখ্য, এই ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না।
এই প্রস্তাবগুলোর পাশাপাশি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের আরেকটি হাতিয়ার যুক্ত করা যায়—সংসদ সদস্যদের কাজ সন্তোষজনক না হলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ভোটারদের হাতে থাকা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অভিভাবকদের পাহারা দেওয়া। অর্থাৎ শাসনকারী রাজনৈতিক অভিজাতদের পাহারা দেওয়া হবে। কীভাবে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক দলের অভিজাতদের মুঠো থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব হবে?
আমাদের আগের অভিজ্ঞতা বলে, বিচার, নির্বাহী ও আইন বিভাগের বিভাজনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য রক্ষার সনাতন ব্যবস্থাকে শাসনকারী রাজনৈতিক অভিজাতেরা কুক্ষিগত করে ফেলতে পারে।
ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে রাখার আরেক চোখ গণমাধ্যমকেও আত্মসাৎ বা দমন করতে আমরা দেখেছি। এই আত্মসাৎ ঠেকাতে আমাদের প্রয়োজন নানান অংশীজনের সমন্বয়ে একটি বহুস্তরীয় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের ব্যবস্থা। মৌলিক প্রতিষ্ঠান ও নীতিগুলো সংরক্ষিত রাখতে হবে একটি জটিল নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের ব্যবস্থা দিয়ে, যার বিভিন্ন পর্যায়ে নাগরিকেরা ভেটো দিতে পারবেন।
এ ধরনের ব্যবস্থার উদাহরণ হিসেবে এই মুহূর্তে পুলিশ, ব্যাংকিং ও শিক্ষা কমিশনের কথা আলোচনা হচ্ছে, যেগুলো নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হবে।
এ ধরনের কমিশনের বাইরেও আমাদের একদম সমাজভিত্তিক কিছু নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের ব্যবস্থা দরকার, যেগুলো শুধু নাগরিক দ্বারা পরিচালিত হবে। বাংলাদেশে কখনো আমরা এ রকম কিছু না দেখলেও ছাত্র-জনতার অর্জনকে হাতছাড়া না করতে চাইলে ও সংস্কারগুলোকে ভবিষ্যতে অপরিবর্তনীয় করতে চাইলে আমাদের এই ব্যবস্থাগুলো লাগবে।
এগুলো একটি দ্বৈত ক্ষমতার বন্দোবস্ত এবং স্থায়ী বিপ্লবের ভিত্তি তৈরি করবে, যাতে নাগরিকেরা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে পারেন। আমাদের দ্বৈত ক্ষমতার বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট যেহেতু একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সৃষ্টি, তাই একটি উদারনৈতিক সাংবিধানিক কাঠামোর ভিত্তিতেই এটি তৈরি হওয়া উচিত।
একটি নতুন বা বহুলাংশে পরিবর্তিত সংবিধানের মাধ্যমেই নানান অংশীজনের সমাজভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য ব্যবস্থাগুলো এবং ভেটোর ক্ষমতা অনুমোদিত হবে।
সংবিধান–বিশেষজ্ঞরা এগুলোর পরিকল্পনায় সহায়তা করবেন। এ ব্যবস্থাগুলোকে আমরা ‘নাগরিক কমিটি’ বলতে পারি। এগুলো প্রশাসনিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে (জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ) এবং নির্দিষ্ট খাতের জন্য (যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশ প্রশাসন) গঠিত হতে পারে। আমাদের বুঝতে হবে, সম্ভাব্য প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে রাস্তায় থাকা শক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
যেমনটি মাওবাদী সাংস্কৃতিক বিপ্লবে উপস্থিত ছিল। আমরা দেখেছি, কীভাবে এমন একটি শক্তি সাম্প্রতিক সময়ে একটি সম্ভাব্য ‘বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থান’ প্রতিহত করেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাপ প্রয়োগের এ ধরনের কৌশলগুলো জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি করবে এবং হয়তো বিপ্লবী ছাত্রনেতারা তাঁদের বর্তমান জনপ্রিয় বৈধতাকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করার বিপদে পড়বেন।
বহুস্তরভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের ব্যবস্থাগুলো হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিনির্ধারণে জট পাকানোর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, তবে আমার বিশ্বাস, আমরা পরীক্ষামূলকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং সেখান থেকে ভুলগুলো শুধরে এসব সমস্যার সুরাহা করতে পারব।
আমাদের দেশে স্বৈরাচারী ও অনুদার শাসনের দীর্ঘ ইতিহাসের পাশাপাশি কার্যত একটি কর্তৃত্ববাদী আধিপত্যকারী দল-রাষ্ট্রভিত্তিক কাঠামোর প্রতি রাজনৈতিক এলিটদের প্রবল আগ্রহ এবং নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের অনিশ্চয়তার প্রতি তাদের বিতৃষ্ণা আমরা লক্ষ করেছি।
সে কারণে রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষমতার একটি ভারসাম্যের মাধ্যমে তাদের একটি গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমাদের হাতে সময় খুবই কম।
এই লেখার শিরোনাম—‘উত্তাল মাঝসমুদ্রে একটি জাহাজের পুনর্নির্মাণ’—আভাস দিচ্ছে রাষ্ট্র-সমাজের সংস্কার কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। এ সংস্কার যাদের জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে, তারা ওত পেতে আছে এটিকে নস্যাৎ করার জন্য। জাহাজ তাই কোনোভাবেই যেন তলিয়ে না যায়।
নির্বাচনী গণতন্ত্রকে নতুনভাবে ভাবা ও পুনর্গঠন করা এবং দ্বৈত ক্ষমতার বন্দোবস্তকে প্রতিষ্ঠা করা ও টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে রাজনৈতিক এলিটদের একটি সীমারেখা ঠিক করে দেওয়া এখন সর্বোচ্চ মনোযোগ দাবি করে।
এ জন্য গভীর সংস্কার ও প্রতিষ্ঠান নির্মাণে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হবে। এ সরকারকে সে সময় দেওয়া দরকার। গণতান্ত্রিক বিপ্লব যে সুযোগ আমাদের সামনে হাজির করেছে, সেটি যেন আমরা কোনোক্রমেই হাতছাড়া না করি।
মির্জা হাসান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে কর্মরত।
ই–মেইল: [email protected]