ব্যাংক কেলেঙ্কারি বলতে একসময় প্রধানত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাৎকেই বোঝানো হতো। এ ক্ষেত্রে কখনো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণপত্র (এলসি) খুলে, কখনো ভুয়া আমদানি-রপ্তানির হিসাব দেখিয়ে, ব্যাংকের পরিচালক বা ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এসব জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের সহায়ক ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ অনিয়ম ইত্যাদি সাম্প্রতিক কালের উল্লেখযোগ্য কতগুলো ব্যাংক কেলেঙ্কারি, যেগুলো ঘটেছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংককে কেন্দ্র করে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ছাড়াও গত এক দশকে বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বহু ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে, যেগুলো ব্যাংক কেলেঙ্কারির ভিন্ন একটা ধরনকে নির্দেশ করে। আর তা হলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে এরপর নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা জনগণের আমানত লোপাট করা।
ব্যাংক আর দশটা প্রাইভেট বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মতো নয়। একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে মোটামুটি ৪০০ কোটি টাকা পেইড-আপ ক্যাপিটাল লাগে। যাঁরা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁরা এই টাকা বিনিয়োগ করেন। এরপর এই ব্যাংকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ আমানত রাখেন। ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাংকের পরিচালকেরা এই হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত নিয়ন্ত্রণ করেন, কোথায় বিনিয়োগ করবেন, কাকে ঋণ দেবেন তার সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগে ব্যাংক উদ্যোক্তা হয়ে হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের জন্য প্রথমে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পৃষ্ঠপোষকতা কাজে লাগিয়ে ব্যাংকের লাইসেন্স নেওয়া হয়, তারপর ব্যাংকে জমা পড়া জনগণের আমানত ঋণের নামে লুটপাট করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক পরিচালক তাঁর মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিজ ব্যাংক থেকে নিতে পারেন না। স্বনামে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার এই ‘অসুবিধা’ দূর করতে তাঁরা একদিকে বেনামে আত্মীয়-পরিজনের মাধ্যমে কিংবা কাগুজে কোম্পানি খুলে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, অন্যদিকে পারস্পরিক যোগসাজশে ও সমঝোতার মাধ্যমে অন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ লুণ্ঠন করেন।
সংবাদমাধ্যমে আসা এ রকম কিছু ঘটনার উদাহরণ দেখা যাক। মোট ৩৯ জন ব্যক্তি উদ্যোক্তা ও ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে ২০১৩ সালে যাত্রা করে ফারমার্স ব্যাংক। খোদ মালিকপক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে কার্যক্রমে আসা ব্যাংকটি খুব দ্রুতই ২৮৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়ে। আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি হওয়ায় ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত প্রদান বন্ধ হয়ে যায় এবং অন্যদিকে নানা অনিয়ম করে দেওয়া ঋণও আদায় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তনের পরপর ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) কর্তৃত্ব চলে যায় সিকদার গ্রুপের হাতে। ওই সময় থেকে সিকদার পরিবারের সম্পদ বাড়তে থাকে আর খারাপ হতে থাকে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা। ব্যাংকের কার্যক্রমে পরিচালনা পরিষদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও বেনামি ঋণের কারণে ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।
২০০৯ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮৮ কোটি টাকা, মার্চ ২০২০ নাগাদ যা বেড়ে হয় ২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। আবার যথাযথভাবে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত না করার কারণে খেলাপি ঋণের এই চিত্রও প্রকৃত চিত্র নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের অনেকগুলোই নামে-বেনামে সিকদার পরিবার ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে।
ব্যাংকের মালিকানা দখলের মাধ্যমে কীভাবে ঋণের নামে জনগণের আমানতের অর্থ লুণ্ঠন করা হয়, তার একটি বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এস আলম গ্রুপের হাতে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা আসার মাত্র ১৫ মাসের মাথায়ই তীব্র আর্থিক সংকটে পড়ে যায় ব্যাংকটি। সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে কোম্পানি ব্যবহারসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক থেকে চলতি বছরেই প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটের সূত্র ধরে নিউএজ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে এভাবে নানা উপায়ে বিভিন্ন কোম্পানির নামে মোট ৩০ হাজার কোটি ঋণ হিসেবে বের করে নিয়েছে।
বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকে একের পর এক জালিয়াতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটার পরও নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি প্রতিষ্ঠার বদলে উল্টো ব্যাংকমালিকদের হাতে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ অবারিত করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের আইনি ও নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে।
শুধু ব্যাংক নয়, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা দখল করেও বিপুল ঋণ নিয়ে আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময় সবচেয়ে আলোচিত হলো পি কে হালদার কর্তৃক চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান—ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে বিপুল অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়ে আত্মসাৎ করা।
২২ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, দেশের ৫৫টি ব্যাংকের পরিচালকেরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা সেসময় ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। লক্ষণীয় হলো, পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬১৪ কোটি ৭৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। কিন্তু মুশকিল হলো, ঋণ অনুমোদন থেকে শুরু করে ঋণ পুনর্গঠন বা অবলোপনের কর্তৃত্ব ব্যাংক পরিচালকদের হাতে থাকার কারণে এই বিপুল পরিমাণ ঋণের ঠিক কত অংশ আসলে খেলাপি, কত অঙ্কের ঋণ পুনর্গঠন করা হয় কিংবা অবলোপন করা হয়, তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকে একের পর এক জালিয়াতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটার পরও নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি প্রতিষ্ঠার বদলে উল্টো ব্যাংকমালিকদের হাতে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ অবারিত করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের আইনি ও নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে। ২০১৮ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে একই পরিবার থেকে চারজনকে টানা ৯ বছর বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এর আগে কোনো বেসরকারি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন পরিচালক হতে পারতেন। আর তিন বছর করে দুই মেয়াদে ছয় বছর পরিচালক থাকার পর তিন বছর বিরতি দিয়ে আবারও পরিচালক হওয়ার সুযোগ ছিল।
মালিকপক্ষের লুটপাটে বিপর্যস্ত বেসরকারি ফারমার্স (বর্তমানে পদ্মা) ব্যাংককে ২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেওয়া হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কর্তৃক বিশেষ আদেশ জারি করে—এক ব্যাংকের কাছে অন্য কোনো ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশি মালিকানা না থাকা কিংবা একই সঙ্গে একাধিক ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে না থাকার যে বাধ্যবাধকতা ছিল ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে, তা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে লোকসানের তথ্য গোপন রাখার মতো ব্যতিক্রমী সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ছাড়া লুটপাটের শিকার বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট করতে সরকার জনগণের অর্থ আরও বেশি পরিমাণে বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে সরকারি সংস্থাগুলোর তহবিলের ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে রাখার যে বিধান ছিল, সেটা পরিবর্তন করে ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়, যার ফলে বেসরকারি ব্যাংকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর তহবিলের ২৫ শতাংশের বদলে ৫০ শতাংশ রাখার সুযোগ তৈরি হয়। শুধু তা-ই নয়, সব ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) রাখতে হয়, তা-ও ৬.৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ কমিয়ে ৫.৫ শতাংশ করা হয়, যার ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা অবমুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সিআরআর-এর মতো মুদ্রানীতির গুরুত্বপূর্ণ এই হাতিয়ারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় একটি হোটেলে ব্যাংকমালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে তাদের দাবির মুখে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিপুল খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান হিসেবে অনেক সময় এগুলোকে বেসরকারীকরণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, এখন বেসরকারি ব্যাংকের খোদ মালিকপক্ষ যে জনগণের আমানত খেয়ানত করছেন, তার নিদান কী হবে! আসলে যদি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকির কাজ যথাযথভাবে পালন করতে না পারে, যদি নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ব্যবসায়ীরাই ঠিক করেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পদে কারা আসবেন, যদি ক্ষমতা-ঘনিষ্ঠ বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের লাগামহীন খেলাপি ঋণ ও ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা বহাল থাকে, যদি লুটপাটের শিকার সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট করতে সরকার জনগণের অর্থ ঢালতে থাকে, ব্যাংক কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের কারও বিচার ও শাস্তি না হয় তাহলে সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংকেই গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না।
কল্লোল মোস্তফা লেখক ও প্রকৌশলী, সর্বজনকথা সাময়িকীর নির্বাহী সম্পাদক, প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০২১)’
ই-মেইল: [email protected]