অভিমত
টাইমস স্কয়ারে বাংলাদেশ, বাঙালির নববর্ষ
নিউইয়র্কের প্রাণকেন্দ্র টাইমস স্কয়ার, সেখানে কয়েক হাজার বাঙালি, সঙ্গে আরও কত শত ভিন্নভাষী মানুষ, সমবেত হয়েছিলেন বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বরণ করে নিতে। এটি কেবলই একটি উদ্যাপন নয়। বস্তুত এই সাড়ম্বর উদ্যাপনের ভেতর দিয়ে বাঙালিরা জানান দিল, তারাও এখানে আছে। টাইমস স্কয়ারে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন নিয়ে লিখেছেন হাসান ফেরদৌস।
‘নিউইয়র্ক ইজ জাস্ট আ ককটেল পার্টি অন দ্য স্ট্রিট।’
কথাটা মিক জ্যাগারের। দিন-তারিখ সঠিক বলা কঠিন, সম্ভবত ১৯৭০-৭১ সালের দিকের কথা। রক ব্যান্ড রোলিং স্টোনসের দলপতি নিউইয়র্ক সিটিতে ট্যাক্সিতে করে কোথাও যাচ্ছিলেন। ক্যাবের পেছনের সিটে বসে একটি নতুন গান বাঁধার চিন্তায় মগ্ন।
চোখ ছিল রাস্তার ওপর, টাইমস স্কয়ার পেরিয়ে যাওয়ার সময় লাইনটা তার মাথায় এল। ‘বিগ অ্যাপেল’ নামে খ্যাত এই শহরের সবকিছুই অতিরঞ্জিত, সবকিছুই বাস্তবের চেয়ে বৃহত্তর। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছিলেন এই লম্বা গানটি, যার একটি লাইন এ রকম—‘লাভ অ্যান্ড হোপ অ্যান্ড সেক্স অ্যান্ড ড্রিমস আর স্টিল সারভাইভিং অন দ্য স্ট্রিটস অব নিউইয়র্ক।’
মিক জ্যাগার নয়, আমি বলতে এসেছি বাঙালিদের কথা। এই শহর, যে কখনোই ঘুমাতে যায় না, সেখানে বাঙালিরা স্বপ্ন দেখছে, এই শহরে নিজেদের আসন গড়ে নেওয়ার স্বপ্ন। শনিবার, ১৩ এপ্রিল, এই শহরে তাদের হাতে রচিত হলো সেই স্বপ্নের এক নতুন অধ্যায়।
নিউইয়র্কের প্রাণকেন্দ্র টাইমস স্কয়ার, সেখানে কয়েক হাজার বাঙালি, সঙ্গে আরও কত শত ভিন্নভাষী মানুষ, সমবেত হয়েছিলেন বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বরণ করে নিতে। এটি কেবলই একটি উদ্যাপন নয়। বস্তুত এই সাড়ম্বর উদ্যাপনের ভেতর দিয়ে বাঙালিরা জানান দিল, তারাও এখানে আছে।
কেবলই উৎসব নয়
ঢাকায় তখন সদ্য সকাল হয়েছে, আগুনরাঙা সূর্য রমনার বুড়ো বটগাছটার মাথায় নরম হাত বোলাচ্ছে। ঢাকার সঙ্গে মিল রেখে ঠিক সেই সময়টাই বেছে নেওয়া হয়েছিল নববর্ষকে স্বাগত জানাতে। নিউইয়র্কে তখন পড়ন্ত বিকেল। বাতাসে কনকনে হিমেল হাওয়া গায়ে কাঁটা দেয়। আকাশ মেঘে ঢাকা, মাঝেমধ্যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। সবকিছুকে উপেক্ষা করে বিপুলসংখ্যক বাঙালি এখানে জড়ো হয়েছে বাংলা নববর্ষকে আহ্বান জানাতে।
ভিনদেশের মাটিতে এই উৎসব, সে কি শুধু বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন, নাকি এর অন্য কোনো তাৎপর্য রয়েছে?
■ নিউইয়র্কে বাঙালির সংখ্যা নেহাত কম নয়, বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে সম্ভবত দুই লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
■ এই শহরে কথা বলা হয় এমন ভাষার সংখ্যা ২০০ বা তার চেয়েও বেশি। এর মধ্যে বাংলার স্থান সপ্তম।
■ একটি দুপুর ও একটি সন্ধ্যা এই শহর ছিল বাঙালিদের দখলে। গানে গানে তারা প্রবাসে বাঙালিদের সরব, সানন্দ উপস্থিতিও ঘোষণা করল।
টাইমস স্কয়ারে পা দিয়েই প্রশ্নটি আমার মাথায় এল। বাঙালিরা এই শহরে নতুন অভিবাসী, অধিকাংশই গত তিন দশকে এসে থিতু হয়েছে। বহিরাগত তকমা লাগানো এসব মানুষ এখনো লড়াই করে চলেছে নিজেদের পায়ের নিচের মাটিটুকু শক্ত করতে। নগরবাসী হিসেবে নিজের অবস্থান সুসংহত না করতে পারলে তারা এখানে ‘সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন’ হয়েই থাকবে। সে দুর্ভোগ এড়াতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অন্য সবার চোখে নিজেদের দৃশ্যমান করা, অন্য সবার কানে নিজের উপস্থিতির খবরটি পৌঁছে দেওয়া। আমরাও আছি, কথাটি সরবে ও সগৌরবে ঘোষণা করা।
টাইমস স্কয়ারে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের একটা উদ্দেশ্য, সেই ঘোষণার নাকাড়া বাজানো, যে দায়িত্ব পালনের নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছে এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড নামের একটি সংগঠন।
নিউইয়র্কে বাঙালির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে সম্ভবত দুই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এখানে মোট বাঙালির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নগর প্রশাসন থেকেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশিরাই হচ্ছে এই শহরে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধিঞ্চু জনগোষ্ঠী। এই শহরে কথা বলা হয় এমন ভাষার সংখ্যা ২০০ বা তার চেয়েও বেশি। এর মধ্যে বাংলার স্থান সপ্তম।
অনেক সরকারি নথি বা ঘোষণাপত্রে বাংলা স্থান করে নিয়েছে। ভোটকেন্দ্রে গেলে বড় করে বাংলায় লেখা থাকে, ‘এইখানে ভোট দিন’। মোট পাঁচটি বরো বা উপশহর নিয়ে গঠিত এই মহানগরে একাধিক রাস্তার নাম ‘বাংলা ওয়ে’, অথবা পাড়ার নাম ‘বাংলা টাউন’। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি হিসেবে একটি নগর উদ্যানও নির্মিত হয়েছে বাঙালিপ্রধান কুইন্সে।
সংখ্যার হিসেবে বাঙালিদের গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বাড়লেও ঠিক সেই অনুপাতে শহরের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় তারা কার্যত অনুপস্থিত। মাত্র তিন বছর আগে প্রথমবারের মতো নগর পরিষদে একজন বাঙালি কাউন্সিলর ও একজন জন আদালত (সিভিল কোর্ট) বিচারক নির্বাচিত হয়েছেন। বড় শ্লাঘার কথা, তাঁরা দুজনেই নারী। এই নগণ্য উপস্থিতির কারণ মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বদলে অধিকাংশ বাঙালি এখনো দেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে ভালোবাসে।
এই শহরে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরও কোনো অভাব নেই। ঈদ, পূজা-পার্বণ সবই রয়েছে, লাখ ডলার খরচ করে সাংবাৎসরিক সম্মেলনও হয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের গণ্ডির বাইরে তাদের খবর কেউ পায় না। ফলে বাঙালি অদৃশ্য হয়েই থাকে।
আর অদৃশ্য নয়
প্রবাসে বাঙালির এই অদৃশ্য হয়ে থাকার চলটি ভাঙতে চায় এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড। সেই লক্ষ্যেই তারা এই শহরের সবচেয়ে পরিচিত, সবচেয়ে আকর্ষণীয় টাইমস স্কয়ারকে বেছে নিয়েছে বাঙালির নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য। এই সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন বিশ্বজিৎ সাহা, প্রবাসী বাঙালিদের সহস্র কর্মকাণ্ডের যিনি মধ্যমণি। তারই নেতৃত্বে এই শহরে ৩২ বছর ধরে জমজমাট বইমেলা বসে। উদ্যাপিত হয় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ঘটা করে আয়োজিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশি দিবস।
তবে টাইমস স্কয়ারে নববর্ষের উদ্যাপন একটি ভিন্ন ব্যাপার। এ এক মহাযজ্ঞ। প্রধান চ্যালেঞ্জ সরকারি, বিশেষত পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি পাওয়া। ব্যাপারটি জটিলতা মুক্ত হতে সাহায্য আসে নগর প্রশাসনের শীর্ষস্থান থেকে।
গত বছর প্রথমবারের মতো টাইমস স্কয়ারে কিছুটা সীমিত পরিসরে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষের আয়োজন করেছিল এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড। সেখানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন এই শহরের নগরপতি, মেয়র এরিক অ্যাডামস। বাংলাদেশের পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, নিজেকে বাঙালিদের বন্ধু বলে ঘোষণা করেছিলেন। খোদ নগরপতি যেখানে বন্ধু, সেখানে পুলিশ প্রশাসন শত শর্তের চুক্তিপত্র এগিয়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত তারাও হ্যাঁ বলতে বাধ্য হয়।
অনুমতি মিললেও টাইমস স্কয়ারে কোনো বড় ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন খুব সহজ নয়। অহোরাত্রি এখানে প্রতি মুহূর্তে মানুষের চলাচল, গাড়ির ভিড়। দল বেঁধে আসে দেশি-বিদেশি পর্যটক, যাঁদের প্রধান আকর্ষণ ব্রডওয়ের থিয়েটার ডিস্ট্রিক্ট। সেই টাইমস স্কয়ারের কয়েক ব্লক জায়গাজুড়ে, আনুষ্ঠানিক মঞ্চ বানিয়ে, আশপাশের রাস্তা থেকে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় আট থেকে দশ ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠান আয়োজন, প্রায় অসাধ্য একটি কাজ। এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সে কাজটি করে দেখাল।
সহস্র কণ্ঠে বাংলা গান
আমি যখন অনুষ্ঠানকেন্দ্রে হাজির হই, তখন বিকেল চারটা। ততক্ষণে উৎসব শুরু হয়ে গেছে। শুধু বাঙালি নয়, এই উৎসবে যুক্ত হয়েছে প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশ। রাস্তার পুরো একটি ব্লকে পেশাদারি মঞ্চ সাজানো হয়েছে। ঘের দেওয়া নির্ধারিত জায়গা রাখা হয়েছে গায়ক ও নৃত্য শিল্পীদের জন্য। নির্দিষ্ট ব্যবধান ছাড়িয়ে বিশেষ অতিথিদের জন্য স্বল্পসংখ্যক চেয়ার পাতা। তারপর দর্শকদের দাঁড়ানোর স্থান। তারও পর নগর প্রশাসন নির্মিত সুউচ্চ গ্যালারি।
অবাক হয়ে দেখি, মূল মঞ্চের আশপাশে কোথাও তিন ধরনের জায়গা নেই। দেখে মনে হয় উৎফুল্ল বাঙালি যেন এক দিনের জন্য হলেও এই টাইমস স্কয়ারের রাজা। একদম প্রথম সারিতে দেখি পরিচিত মুখ, প্রখ্যাত অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম ও নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান। হাসান ভাইয়ের বয়স এখন ৮৯, অথচ এমন হাস্যোজ্জ্বল মুখ, নিজেই বললেন, এখানে এসে সব ক্লান্তি মুছে গেছে।
নববর্ষের অনুষ্ঠান, ফলে রবি ঠাকুরের গান, শিশুদের পরিবেশনা, বৃন্দ নৃত্য এসব তো ছিলই। আরও ছিল একটি যাত্রা, মহামতি আকবর। কীভাবে বাংলা সনের প্রবর্তন হলো, তার সরস উপস্থাপনা। কলকাতা থেকে এসেছেন পার্বতী বাউল, ঢাকা থেকে শিল্পী মমতাজ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের অধীর প্রতীক্ষা মহিতোষ তালুকদারের পরিচালনায় সহস্র কণ্ঠে গানের জন্য।
এই তরুণ গায়ক ও সংগীত পরিচালক তিন মাস ধরে কয়েক শ ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষকে নিয়ে মহড়া দিয়েছেন। সবই পরিচিত ও উদ্দীপনামূলক গান। মঞ্চের সামনে বেশ খানিকটা জায়গা খালি রাখা হয়েছিল। মহিতোষ হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো ডাক দিতেই খোলা জায়গা মুহূর্তে ভরে যায়। স্থানসংকুলান না হওয়ায় শিল্পীদের অনেকেই লোহার রেলিংয়ের বাইরে রয়ে যায়। বলা হয়েছিল সহস্র কণ্ঠে গান হবে।
দর্শকদের যদি ধরা হতো তো সহস্র কণ্ঠে তো বটেই, কয়েক সহস্র কণ্ঠে গমগম করে ওঠত টাইমস স্কয়ার। বাংলাদেশ থেকে বারো হাজার মাইল দূরে অচেনা আকাশে ভেসে বেড়ায় ব্রতচারীদের চিরচেনা গান, আবার তোরা মানুষ হ, মানুষ হ।
সরকারি অনুমতি ছিল রাত ১০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার। ঠিক ১০টায় মঞ্চে আসেন বিশ্বজিৎ সাহা, সঙ্গে চারজন নিউইয়র্ক শহরের পুলিশ। মঞ্চে তখন তাঁর শেষ গানটি গেয়ে প্রস্থানের আয়োজন করছেন মমতাজ। পুলিশ দলের নেতৃত্বে একজন বাংলাদেশি, তিনি জানালেন, দর্শকেরা যতক্ষণ চায় ততক্ষণ চলবে এই অনুষ্ঠান।
মিক জ্যাগারের গানের কথা মনে পড়ে যায়। প্রতিদিন এখানে ককটেল পার্টি। একটি দুপুর ও একটি সন্ধ্যা এই শহর ছিল বাঙালিদের দখলে। গানে গানে তারা শুধু বাংলা নববর্ষকেই আহ্বান জানাল না, প্রবাসে বাঙালিদের সরব, সানন্দ উপস্থিতিও ঘোষণা করল।
●হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক