ভারতের উত্তর প্রদেশের নিকটবর্তী নেপালের শাক্য রাজ্যের কপিলাবস্তু নামক রাজধানীর উপকণ্ঠে লুম্বিনী কাননে বৈশাখী পূর্ণিমা দিবসে শাক্যমুনি গৌতমের জন্ম। তিনি বংশগতভাবে ক্ষত্রিয় ছিলেন। তাঁর বাল্যনাম ছিল কুমার সিদ্ধার্থ। তাঁর পিতা শাক্যরাজ শুদ্ধোধন এবং মাতা রানি মহামায়া।
রাজকুমার সিদ্ধার্থ ২৯ বছর বয়সে ঘরবাড়ি ও পরিবার—সবকিছু ত্যাগ করে জীবজগতের কল্যাণের তরে হয়েছিলেন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। তিনি ছয় বছর কঠোর সাধনার মাধ্যমে ৩৫ বছর বয়সে গয়ার বোধিবৃক্ষমূলে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধত্ব লাভ করেন।
বুদ্ধত্ব লাভের পর সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের কাছে ধর্মচত্রু প্রবর্তন করেন। ধর্মচক্র প্রবর্তনের পর তিনি সুদীর্ঘ ৪৫ বছরব্যাপী দেব-মানবের কল্যাণে সদ্ধর্ম প্রচার করেন। তিনি ৮০ বছর বয়সে কুশীনগরে মল্লরাজের শালবনে বৈশাখী পূর্ণিমা দিবসে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।
সদ্ধর্ম প্রচারকালে বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছেন মানবতা, দয়া, ভালোবাসা, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা, সহমর্মিতা, অহিংসা, সাম্য, অন্যের ধর্মবিশ্বাসে শ্রদ্ধা, ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য, সামাজিক মূল্যবোধ, সমাজকল্যাণ, নৈতিকতা এবং সব ধরনের দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় সম্পর্কে। তাঁর প্রচারিত ধর্মে ছিল না কোনো জাতপাত, বর্ণবৈষম্য, উঁচু–নিচু ভেদাভেদ। তিনি বলেছেন, সব মানুষ সমান। ভগবান বুদ্ধ তাঁর ধর্মদেশনায় বলেছেন, সাগরের জলের যেমন একটি মাত্র স্বাদ এবং সে স্বাদ লবণাক্ত, তদ্রূপ আমার ধর্মমতেরও একটি মাত্র স্বাদ, আর তা হলো সর্বদুঃখের অন্তসাধন।
বুদ্ধের ধর্ম যথাযথ অনুশীলনের দ্বারা মানুষ সব দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করতে সমর্থ হন। তিনি আরও বলেছেন, গঙ্গা, যমুনা, অচিরবতী, সরভু, সরস্বতী ইত্যাদি নদী সাগরে মিলিত হয়ে তাদের স্বতন্ত্র সত্তা ও নাম হারিয়ে ফেলে, তেমনি ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র—সবাই আমার ধর্মে প্রবেশ করে জাতি, গোত্র, নাম হারিয়ে ফেলে।
এ ধর্মে সব মানুষ সমান। আর বুদ্ধের জীবপ্রেম, সব সৃষ্টির প্রতি মমত্ববোধ সম্পর্কেও আমরা সবাই অবগত। ভগবান বুদ্ধ ছিলেন বাস্তববাদী ধর্মসংস্কারক। সংসারের দুঃখ–কষ্ট থেকে মানুষ যাতে মুক্তি পায়, সেটাই ছিল তাঁর ধর্মের মূল দর্শন। বুদ্ধ চারটি মহান সত্যের বিশ্লেষণ করেছেন। সেই চার আর্যসত্য হলো ১. সংসারে দুঃখ–কষ্ট আছে, ২. এই দুঃখ–কষ্টের কারণ আছে, ৩. দুঃখ–কষ্টের অবসান করতে হবে, ৪. দুঃখ-কষ্ট অবসানের উপায় আছে।
ভগবান বুদ্ধের মতে, জন্মই দুঃখের কারণ। পার্থিব ভোগবিলাস, কামনা-বাসনার তৃষ্ণা থেকেই সব দুঃখের উৎপত্তি। ভোগের তৃষ্ণাই মুক্তির পরিবর্তে বারবার জন্মধারণ করতে সাহায্য করে। তৃষ্ণার অবসানকল্পে ভগবান বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গের নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো হলো ১. সৎ সংকল্প, ২. সৎ চিন্তা, ৩. সৎ বাক্য, ৪. সৎ কর্ম, ৫. সৎ জীবনযাপন, ৬. সৎ প্রচেষ্টা, ৭. সৎ দর্শন এবং ৮. সম্যক সমাধি।
তথাগত বুদ্ধ এ কথাও বলেছেন, কেবল ভোগবিলাস অথবা কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারা নয়, এই দুইয়ের মাঝামাঝি, অর্থাৎ মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ–অনুশীলন করলেই সব ধরনের দুঃখ থেকে মুক্তি বা পরিত্রাণ লাভ সম্ভব।
ভারতবর্ষে এযাবৎকাল যত ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে, প্রায় সব ধর্মই ব্যক্তি–ঈশ্বরকে প্রাধান্য দিয়ে শুধু ইহলোক তথা ভূতলবাসীর কল্যাণেই প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ ইহজগৎ ও পরমার্থজগৎ—উভয়কে সম্পৃক্ত করে জল–স্থল–অন্তরিক্ষে প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক জগতের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে স্বীয় ধর্ম ও দর্শন প্রচার করেছেন।
এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ ভগবান বুদ্ধ নিজে একসময় আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে মনুষ্যলোক থেকে এয়োত্রিংশ দেবলোকে (তুষিত স্বর্গে) গিয়ে তাঁর গর্ভধারিণী মাতৃদেবীসহ ১৮ কোটি দেবতাকে অভিধর্ম দেশনার মাধ্যমে সদ্ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। দেবলোকে অভিধর্ম দেশনা পরিসমাপ্ত করে তিন মাস পর পুনরায় আশ্বিনী পূর্ণিমা দিবসে ভূতল সাংকাশ্যনগরে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
বুদ্ধপূর্ণিমার এই পবিত্র তিথিতে অন্যের কল্যাণ কামনা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ–বেদনা ভাগাভাগি করে নেওয়ার মধ্যেই পরম সুখ, পরম শান্তি, পরম আনন্দ। এই তিথিতে আমাদের সবার প্রার্থনা, জগতের সব প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক।
ভদন্ত বুদ্ধানন্দ মহাথেরো প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ, আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহার, ঢাকা এবং সিনিয়র সহসভাপতি, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন