শাসনের নামে শিশুদের ওপর নির্যাতন সম্পূর্ণ হারাম

শিশুর সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার জন্য মাতা-পিতা, শিক্ষক ও অভিভাবকের সুশাসন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে শাসনের নামে নির্যাতন ইসলাম অনুমোদন করে না। এটি অমানবিক ও জুলুম। শিশুরা বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। সাধারণত শারীরিক শাস্তিটা পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বেশি। 

শিশুর ৩ বছর থেকে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিক শাস্তি বেশি দৃশ্যমান হয়ে থাকে। নাবালেগ মাসুম (নিষ্পাপ) শিশুদের শাসনের নামে যদি এমনভাবে মারধর করা হয়, যাতে কেটে যায়, ফেটে যায়, ছিঁড়ে যায়, ভেঙে যায়, ফুলে যায়, ক্ষত হয়, লাল হয়ে যায় বা কালো হয়ে যায়, বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয় অথবা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়; তাহলে ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক, কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ফিকহের বিধানমতে, তা সম্পূর্ণরূপে হারাম, নাজায়েজ, অবৈধ, অনৈতিক, অমানবিক ও বেআইনি এবং কবিরা গুনাহ বা বড় পাপ; যা তওবা ছাড়া মাফ হবে না।

বিশেষত মাথায়, মুখমণ্ডলে ও কানে আঘাত কোনো বয়সীদেরই (শাস্তিযোগ্য অপরাধী হলেও) করা যাবে না; এমনকি পশুদেরও এসব স্থানে আঘাত করা নিষিদ্ধ। শিশুর মাতা-পিতা বা অভিভাবকের অনুমতি বা নির্দেশক্রমেও শিশুদের শারীরিক শাস্তি প্রদান শিক্ষক বা অন্য কারও জন্য জায়েজ নয়। কারণ, মাতা-পিতা বা অভিভাবক নিজেই তাঁর নিজের নাবালেগ সন্তানকে (শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হতে পারে, এমন প্রচণ্ড ও কঠিন আঘাতের মাধ্যমে) শাস্তি দানের অধিকার রাখেন না; সুতরাং তিনি অন্যকে এই অধিকার প্রদান করতে পারেন না। (ফাতাওয়ায়ে শামী, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী)। 

স্বগৃহ বা আপন আলয় শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। মাতৃকোল শিশুর পরম শান্তির নিবাস। যথোপযুক্ত মাতৃভাষার অভাবে এখানেই শিশু প্রথম বঞ্চনা ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। অপরিণত ও কম বয়সী মায়েরা অসহিষ্ণু হয়ে দুধ পান না করার জন্য অনেক সময় রাগে শিশুকে কোলের মধ্যে চেপে ধরেন বা ঝাঁকুনি দেন; অথবা দুধ পানের জন্য কান্নাকাটির কারণে দুগ্ধপোষ্য শিশুদের চড়–থাপ্পড়ও মারেন। 

অভাবের সংসারে এবং অনেক মা কর্মব্যস্ততার কারণে মেজাজ বিগড়ে গেলে শিশুদের মারধর করেন। কর্মজীবী বা শ্রমজীবী পিতারা শিশুদের খেলাধুলা ও চঞ্চলতার জন্যও মেরে থাকেন, যা আদৌ কাম্য হতে পারে না। সুশিক্ষা, সচেতনতা সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে এ পর্যায়ে শিশুর শারীরিক শাস্তি ও জুলুম বন্ধ করা সম্ভব। 

কর্মক্ষেত্রে শিশুরা অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, অবহেলার শিকার হয়; এমনকি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বলি হয় অধিকাংশ জায়গায়। শিশুশ্রমিক বা শ্রমজীবী শিশুরা কম বয়সেই বেশি নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হয়। 

এ ক্ষেত্রে গৃহকর্মী শিশুরা হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও বঞ্চিত। এই গৃহকর্মীরা প্রায় কন্যাশিশু। তাদের বয়স ৭ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী (গৃহকর্ত্রী) ও শিশুদের (গৃহমালিকের সন্তান) দ্বারাই বেশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন।

আমরা ভাবি, আমরা যা শেখাই (যা বলি), শিশুরা তা শেখে। আসলে শিশুরা আমাদের শেখানোটা (বলাটা) হয়তো কিছুটা শেখে; কিন্তু শিশুরা আমাদের দেখে দেখে (আমাদের আচরণ থেকে) তার চেয়ে বেশি শেখে। কারণ, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়; তারা যা দেখে, তা আত্মস্থ করে। আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি তাদের কোমল মনে স্থায়ীভাবে রেখাপাত করে, অনুপ্রাণিত হয় তা প্রকাশে। 

এর প্রতিফলন ঘটে তাদের কাজকর্মে ও সারা জীবনের আচার-আচরণে। যেমন ধৈর্য বা সহিষ্ণুতার উপদেশ যদি আমরা অসহিষ্ণুভাবে উপস্থাপন করি; তবে শিশু এখান থেকে দুটি বিষয় শিখবে, এক. ধৈর্য বা সহিষ্ণুতার বাণী বা বুলি; দুই. অধৈর্য বা অসহিষ্ণু আচরণ। আসলে আমরা শিশুকে কোনটি শেখাতে চাই?

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]