সম্প্রতি সুইস ব্যাংকে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের যে গোপন অর্থ সঞ্চিত রয়েছে, তা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যে বোমা ফাটিয়েছে সেটা নিয়ে বহু দেশে তোলপাড় হয়ে গেলেও আমাদের এখানে পত্রপত্রিকায় কিছু বিচ্ছিন্ন লেখা ছাড়া আর তেমন কোনো আলোড়ন দেখা যাচ্ছে না কোনো মহলে। সরকারি মহলের নীরবতা হয়তো কিছুটা অর্থবহ। কারণ, সবার জানা আছে সুইস ব্যাংকে কারা গোপন সঞ্চয় রাখে।
সুইস ব্যাংকগুলো যে দেশ-বিদেশের পাচার করা গোপন অর্থের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে, তার ইতিহাস বহু আগের। প্রায় ৩০০ বছর আগে থেকেই সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে গোপন অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা চালু ছিল। ফ্রান্সের রাজাদের সঞ্চিত অর্থ গোপন রাখার প্রবণতা থেকেই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৭১৩ সালে জেনেভার সিটি কাউন্সিলে যে আইন করা হয়, তাতে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টের হিসাব গোপন রাখার বিধান চালু করা হয়। কেবল গ্রাহক ছাড়া অন্য কারও কাছে অ্যাকাউন্ট–সম্পর্কিত তথ্য জানানো ছিল নিষিদ্ধ। মূলত তখন থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচার করে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে রাখার প্রবণতা শুরু হয়েছিল।
আদিতে সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তা রক্ষার আইন ফৌজদারি ছিল না বিধায় গোপনীয়তা ভঙ্গের কারণে কোনো ব্যাংক কর্মচারীকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ১৯৩৪ সালের নতুন ব্যাংকিং আইন এই গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টিকে ফেডারেল আইনে পরিণত করে আরও কঠোর করে দেওয়া হয়। ১৯২৯ সালের মহামন্দার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং আইনের এই সংশোধন প্রয়োজন ছিল। নতুন আইনে ব্যাংকিং গোপনীয়তার বিষয়টিকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় নিয়ে আসা হয়, ফলে গোপনীয়তা ভঙ্গকারীর শাস্তি ছিল কারাদণ্ড। জার্মানিতে হিটলারের শাসনামলে বিদেশে ধনসম্পদ জমা করার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান চালু করা হলে সুইজারল্যান্ডে এই ব্যাংকিং গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপীয় ইহুদিরা তাদের সমুদয় সম্পদ সুইস ব্যাংকে জমা রাখা শুরু করে। যুদ্ধের ডামাডোলে বহু ইহুদি সুইস ব্যাংকের গোপন দলিলপত্র হারিয়ে ফেলে, ফলে যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তারা আর তাদের সঞ্চিত অর্থ ফেরত পায়নি। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, সুইস ব্যাংকে যে কেবল ইহুদিদের সম্পদ গোপন করে রাখা হতো তা নয়, নাৎসি বাহিনী যুদ্ধবন্দী এবং অধিকৃত দেশ থেকে যে সম্পদ লুণ্ঠন করে, সেসবও গচ্ছিত রাখা হয়েছিল সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তায়। বিষয়টির মধ্যে কোনো আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না।
মার্কিন কূটনীতিবিদ স্টুয়ার্ট আইজেনস্ট্যাট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে অর্থনৈতিক অসংগতি এবং ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই ইমপারফেক্ট জাস্টিস: লুটেড অ্যাসেটস, স্লেভস লেবার, অ্যান্ড দ্য আনফিনিশড বিজনেস অব ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু-তে দেখিয়েছেন যে ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৪৫-এর জুন পর্যন্ত জার্মানি তখনকার মূল্যে ৪০ কোটি ডলারের স্বর্ণ ন্যাশনাল ব্যাংক অব বার্নে পাচার করেছে। ধারণা করা যায়, যুদ্ধের খরচ চালানোর জন্য নিয়ে যাওয়া এই স্বর্ণের বেশির ভাগই ছিল হতভাগ্য ইহুদিদের কাছ থেকে লুট করা। আইজেনস্ট্যাট লিখেছেন, ‘সুইজারল্যান্ড বা অন্য নিরপেক্ষ দেশগুলো যে ভিকটিমদের স্বর্ণ জেনেশুনে গ্রহণ করেছে তার কোনো প্রমাণ নেই...তবে সুইজারল্যান্ড ও ইতালিতে পাঠানো স্বর্ণের মধ্যে অন্তত একটা ছোট অংশ ছিল, যা অধিকৃত দেশের নাগরিক এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের হতভাগ্য এবং ক্যাম্পে আনার আগেই মেরে ফেলা লোকজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা।’ এসব স্বর্ণালংকার অন্যান্য সোনার সঙ্গে মিশিয়ে গলিয়ে ফেলা হয়। এতে ধারণা করা যায় যে সুইজারল্যান্ড জার্মান আগ্রাসনের ভয় করছিল।
যুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে সুইস-ওয়াশিংটন চুক্তির অধীনে সুইস সরকার ত্রিপক্ষীয় গোল্ড কমিশনের কাছে প্রায় ছয় কোটি (৫.৮) ডলারের সমপরিমাণ স্বর্ণ হস্তান্তর করতে সম্মত হয়। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফরাসি সরকার জার্মানি থেকে প্রাপ্ত সব স্বর্ণের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড এবং সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের সম্পৃক্ততার দাবি ছেড়ে দেয়। এর ফলে ষাটের দশক পর্যন্ত সুইস ফেডারেল আইনের কারণে সেখানকার ব্যাংক, অ্যাটর্নি অফিস, ট্রাস্টিসহ সর্বত্র জার্মান সহিংসতার শিকার এবং উদ্বাস্তুদের
সুপ্ত হিসাব খঁুজে বের করার কাজ চলে। এভাবে খঁুজে পাওয়া যায় প্রায় ২৪ লাখ ডলার, (১৯৬২-এর মূল্যমানে) যা যোগ্য উত্তরাধিকারীদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে একটা ঘটনা সুইস ব্যাংকের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টাকে আরও স্পষ্ট করে দেয়। ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডের (ইউবিএস) এক প্রহরী ধ্বংস করে ফেলার ঠিক আগে ব্যাংকের কিছু পুরোনো লেজার আবিষ্কার করে, যেখানে জার্মানিতে ইহুদি নিধনের সময়কার অ্যাকাউন্টের হিসাব ছিল। বার্লিনসহ বিভিন্ন শহরের ঠিকানাসংবলিত সেই সব হিসাব দেখে ক্রিস্টোফার মেইলি নামের সেই প্রহরী সেসব লেজার তুলে দেন একটা ইহুদি সাহায্য সংস্থার কাছে। বিষয়টি সুইস আইনে অপরাধ হলেও মেইলি এই ঐতিহাসিক দলিল ধ্বংস হতে দিতে চাননি। জার্মানিতে ইহুদি নিধনের সময়কার হিসাবপত্র দেওয়ার জন্য সুইস ব্যাংকগুলো বিভিন্নমুখী চাপের মুখে থাকলেও মেইলির এই বোমা ফাটানো ঘটনা তাদের নতুন চাপের মুখে ফেলে দেয়। শাস্তি এড়ানোর জন্য মেইলি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। মেইলির এই উদ্ঘাটন অবশ্য সুইজারল্যান্ডের মানুষ এবং সংবাদমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়৷ এক পক্ষ মেইলির সাহসী বিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপের প্রশংসা করে, অন্য পক্ষ তাঁকে দেশপ্রেমরহিত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক, পরের বছরই সুইস ব্যাংকের তরফ থেকে ইহুদি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ১২৫ কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ রফা হয়।
ঘটনাটা ইউবিএস কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলে দেয়, কারণ এটি নতুন সুইস আইনে জার্মানি কর্তৃক ইহুদি নিধনের প্রমাণস্বরূপ যেকোনো আলামত সংরক্ষণ করার যে বিধান রয়েছে তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ফলে বিষয়টা যে এক দুঃখজনক ভুল, সেটা স্বীকার করতেও হয়েছে তাদের। কোনো প্রাচীন দলিল ধ্বংস করার আগে ব্যাংকের নিজস্ব একজন ইতিহাসবিদ সেসব পরীক্ষা করে দেখতেন যে সেগুলোতে ইহুদি নিধন সম্পর্কে কোনো প্রমাণ রয়েছে কি না। মেইলির আবিষ্কারের আগে আরও যেসব দলিল ধ্বংস করা হয়েছে, সেখানে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি বলে সেই ইতিহাসবিদ সেসব ধ্বংসের অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তবে ধ্বংস করা দলিলগুলোর কোনো তালিকা না রাখার কারণে সেই ইতিহাসবিদকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
অবশ্য মেইলি একা নন, পরবর্তী সময়ে রুডলফ এলমার নামের একজন সুইস ব্যাংক কর্মকর্তা কর ফাঁকি দেওয়া টাকার হিসাব ফাঁস করে দেওয়ার পর সুইস কর্তৃপক্ষ তার পেছনে লাগে। উইকিলিকসকে দেওয়া তার তথ্যগুলো কর ফাঁকি দেওয়া কালোটাকার অভয়ারণ্য হিসেবে সুইস ব্যাংকের ভূমিকা আর গোপন থাকে না। এরপর ব্র্যাডলি বার্কেনফেল্ড নামের আর একজনের ভূমিকার কারণে ইউবিএস আরও একবার কর ফাঁকিতে সহায়তা করার জন্য ধরা পড়ে। এর জন্য ইউবিএসকে সাত কোটি ৮০ লাখ ডলার জরিমানা দিতে হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় সাড়ে চার হাজার সন্দেহভাজন মার্কিন করখেলাপি হিসাবধারীর তালিকা সরবরাহ করতে হয়। বলা বাহুল্য, মেইলির মতো এলমার এবং বার্কেনফেল্ডকেও সুইস কর্তৃপক্ষ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল।
সুতরাং বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সুইস ব্যাংকে গোপন সঞ্চয় নতুন কোনো ঘটনা নয়। মূল ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন যে আমাদের দেশের কঠোর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের ফাঁক গলে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে (২০১৩ সাল পর্যন্ত মোট জমা তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ) সুইস ব্যাংকে পাড়ি দিতে পারে, তা ভেবে। কেবল সুইস ব্যাংক নয়, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের সঞ্চিত সম্পদ কোন পথে গেল, তার কোনো কার্যকর তদন্ত কখনো করার চেষ্টা কি হয়েছে কখনো? আজ পৃথিবীর প্রভাবশালী দেশগুলোর চাপে সুইস ব্যাংকগুলো তাদের গোপনীয়তা রক্ষার অঙ্গীকার থেকে কিছুটা সরে আসতে বাধ্য হয়েছে বোঝা যায়। ৩০০ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে যদি সুইস ব্যাংকগুলো তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে গোপন হিসাবের তালিকা প্রকাশ করতে পারে, তাহলে আমাদের মতো দেশগুলোর সরকার দেশের স্বার্থে পাচারকৃত সম্পদের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে পারছে না কেন?
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷