করোনাকালে বহু নতুন শব্দ হামেশা ব্যবহার করতে শিখছি আমরা। এ তালিকায় সর্বশেষ এল ‘ভ্যাকসিন পাসপোর্ট।’ ভ্যাকসিন পাসপোর্ট হচ্ছে কোনো নাগরিক টিকা নিয়ে ভাইরাসমুক্ত হয়ে আছেন, এমন নিশ্চয়তা। মানুষকে দরকারি জিনিসপত্রের সঙ্গে এখন থেকে ওই রকম টিকা সনদও সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হবে বলে মনে হচ্ছে।
কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা পেতে চালু হওয়া সব টিকার কার্যকারিতা নিয়েই অল্পবিস্তর বিতর্ক আছে। তারপরও বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসের টিকা দেওয়া ক্রমেই বাধ্যতামূলক করার নীরব আয়োজন চোখে পড়ছে। জুন পর্যন্ত হিসাবে প্রায় ৯০টি দেশ চলাচলের জন্য কোনো না কোনো ধরনের টিকা সনদ বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবছে। আঞ্চলিক ধরনের ভ্যাকসিন পাসপোর্ট ধারণা নিয়েও কাজ চলছে। ইইউ ইতিমধ্যে এটা চালু করে দিয়েছে।
যে দেশে পাসপোর্টের ধরন যে রকমই হোক, প্রশ্ন উঠেছে, টিকার প্রক্রিয়া থেকে বাদ যাওয়া মানুষের তাহলে কী হবে? ভ্যাকসিন পাসপোর্ট কি তবে বিশ্বজুড়ে মানুষকে আবার নতুন করে দুই ভাগে ভাগ করতে আসছে? যেভাবে ভাগ করেছে দারিদ্র্য, বর্ণ কিংবা লিঙ্গবৈষম্য। এটা কি তবে নতুন এক জাতপাত ব্যবস্থা?
ভ্যাকসিন পাসপোর্টকে কেউ কেউ ‘কোভিড পাসপোর্ট’ও বলছে। নাম যা–ই হোক, এর শর্ত হলো টিকা দিতেই হবে। সেটা হতে হবে অনুমোদিত টিকা এবং টিকার সনদ সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হবে। সেই সনদ দেখিয়ে পাসপোর্টের মতো আরেকটা সনদও নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এটা স্মার্ট কার্ডের মতো নতুন কিছুও হতে পারে। এতে কিউ আর কোড থাকবে টিকা পাওয়ার নিশ্চয়তা হিসেবে।
কোনো কোনো দেশে এই পাসপোর্টের কথা বলা হচ্ছে কেবল আন্তর্জাতিক চলাচলের জন্য, আবার কোথাও অভ্যন্তরীণ কাজেও এর ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে।
নানান দেশে নানান ধাঁচের ভ্যাকসিন পাসপোর্ট
বিভিন্ন দেশে সরেজমিনে লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, ভ্যাকসিন পাসপোর্টের জন্য বেশি আগ্রহী ব্যবসায়ী সমাজ ও সরকারসমূহ। মানুষকে এ সনদ ধরিয়ে দিয়ে বিধিনিষেধের যন্ত্রণা থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা সমাজকে ‘মুক্ত’ করতে চায় তারা। ভয়ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে আগের মতো চলাফেরার একটা রক্ষাকবচ হিসেবে ভাবা হচ্ছে একে। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভ্যাকসিন পাসপোর্টের ধারণা আসছে বিশ্ববাসীকে বর্তমানের বন্দিদশা থেকে উদ্ধারের জন্য এবং মানুষকে দ্রুত টিকা নেওয়ায় উৎসাহ জোগাতে। এটা থাকলে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে না।
বিশ্ব-অর্থনীতি ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চাইছে
ভ্যাকসিন পাসপোর্টের হাত ধরে জনজীবন আগের চেহারায় ফিরতে পারে বলে দাবি করা হচ্ছে। এ–ও বলা হচ্ছে, অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠবে এর প্রতিক্রিয়ায়। মূলত বাজারব্যবস্থায় অক্সিজেন জোগাতেই ভ্যাকসিন পাসপোর্টের পক্ষে বেশি বলা হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ভ্রমণ ও বিনোদন খাতের হিস্যা বেশ বড়। কোভিডে তারা কাহিল। এই মহল খুব চাইছে, মানুষকে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে তাদের ঘরের বাইরে আনা হোক। সে জন্য ধনী দেশগুলো ব্যাপক হারে টিকা কিনছেও। বিশ্ব জনসংখ্যায় এ রকম দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের হিস্যা ২০ ভাগের কম। অথচ তারা ভ্যাকসিনগুলোর ৫৪ ভাগ কিনে বসে আছে।
তবে ধারণা হিসেবে প্রাথমিকভাবে নিষ্পাপ ও আকর্ষণীয় মনে হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিস্তর ব্যবহারিক সমস্যা। বিশেষ করে প্রথম থেকেই এই পাসপোর্টের ধারণা দরিদ্রবিরোধী ব্যবস্থার আকার নিচ্ছে।
ভ্যাকসিন পাসপোর্ট ঘিরে সমস্যা অনেক
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, ধনী দেশগুলোর সঙ্গে সমানতালে নিজ নাগরিকদের টিকা দিতে দরিদ্র দেশগুলোর বছর বছর বাড়তি অর্থ দরকার। এটা তারা পাবে কোথায়? এসব দেশে ভ্যাকসিন দেওয়ার অবকাঠামোও দুর্বল। সুতরাং এশিয়া, আফ্রিকার যেসব মানুষ তাদের ইচ্ছা সত্ত্বেও ভ্যাকসিন পায়নি, পাচ্ছে না বা পাবে না, তারা ভ্যাকসিন পাসপোর্ট কোথায় পাবে? ফলে এই সনদের ধারণা তার আবির্ভাবেই বিশ্বকে দুই ভাগে ভাগ করে নিচ্ছে। দুই ধরনের মানুষের অস্তিত্বকে এর মধ্য দিয়ে স্বীকার করে নেওয়া হবে। যার একদল স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় শামিল হতে পারবে, অন্যরা অনুমতি পাবে না।
কর্মসংস্থানের জগতে ভ্যাকসিন পাসপোর্টহীন মানুষেরা যে সরাসরি বঞ্চনার শিকার হবে, তা স্পষ্ট। আবার লক্ষণ বলছে, অনেক দেশ এই পাসপোর্ট গ্রহণ করবে ডিজিটাল আকারে। ওপরে যে ৯০টি দেশের কথা বলা হয়েছে, তাদের ৬৩ ভাগই ডিজিটাল সনদ দিচ্ছে। কাগজের সনদের জাল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু এর মানে এ–ও দাঁড়ায়, কোভিড পাসপোর্টের নামে তাবৎ নাগরিকের স্মার্টফোন নিয়ে চলাফেরা বাধ্যতামূলক হতে পারে। যেসব দরিদ্র মানুষের সেটা থাকবে না, তাদের কী হবে?
আবার এমন অ্যাপ তৈরিও অসম্ভব নয়, যা মিথ্যা কোভিড পাসপোর্ট তৈরি করে দিতে পারে। ইসরায়েলে ‘ভ্যাকসিন পাস’ ব্যবস্থার শুরুতে এ রকম ঘটেছে। তখন হয়তো জাল ভ্যাকসিন পাসপোর্টের চড়া মূল্যের আলাদা বাজার তৈরি হবে।
বিভেদের নতুন দেয়াল হতে পারে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট
যেহেতু কোনো কোভিড ভ্যাকসিনই অনন্তকালের সুরক্ষা দেবে বলে মনে হয় না, তাহলে এই পাসপোর্টের মেয়াদ কত দিনের হবে, সেটাও বড় প্রশ্ন হিসেবে থাকছে। এ রকম ক্ষেত্রে কিছুদিন পরপর করোনা পরীক্ষা করে ভ্যাকসিন পাসপোর্টের মেয়াদ টিকিয়ে রাখতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় কোটি কোটি মানুষের জন্য বারবার ‘টেস্ট’ বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিশ্ব জনসংখ্যার ২ দশমিক ১১ ভাগ। অথচ গত মাসের হিসাবে বিশ্বে যখন প্রায় পৌনে চার শ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে, তখন এখানে সেটা দুই কোটি অতিক্রম করেনি। অথচ জনসংখ্যার ৮০ ভাগের ভ্যাকসিন পাসপোর্ট পেতে হলেও দরকার ২৬-২৭ কোটি ডোজ। আবার নতুনদের টিকা দিতে দিতেই পুরোনোদের টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তাহলে তাঁদের পাসপোর্টের তখন কী হবে? মোটকথা, টিকা সহজলভ্য না হওয়া পর্যন্ত ভ্যাকসিন পাসপোর্টের ধারণা সমস্যা বাড়াবে কেবল।
ভ্যাকসিন পাসপোর্টকে উন্নত দেশগুলো তাদের দেশের শ্রমনীতি ও বিদেশনীতির অংশ করে তুললে তাতে বিশ্বজুড়ে গুরুতর এক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও ঘটবে। তৃতীয় বিশ্বের শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে সেটা হতে পারে উঁচু দেয়ালের মতো। এভাবে ভ্যাকসিন-জাতীয়তাবাদ অসাম্যে ভরা বিশ্বে নতুন করে বিভেদ বাড়াতে পারে।
ভ্যাকসিন পাসপোর্ট সংক্রমণও বাড়িয়ে দিতে পারে
টিকা নেওয়ার পরও যেহেতু মহামারির হাত থেকে রেহাই মিলছে না বা মিলবে বলে নিশ্চয়তা মিলছে না, সুতরাং একে পাসপোর্টতুল্য ধরে নিয়ে সবকিছু খুলে দেওয়াতেও ঝুঁকি থাকবে। এমনকি সে রকম ঝুঁকি বাড়তেও পারে। ভ্যাকসিন পাসপোর্টধারী মানুষের মধ্যে যদি ক্ষুদ্র এক অংশও সংক্রমিত থাকে, তাহলে তাদের উন্মুক্ত চলাফেরা, পাসপোর্ট নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরতে থাকা অন্যদের অজান্তেই বিপদে ফেলবে। কথিত ‘পাসপোর্ট’ এভাবে বরং সংক্রমণ দ্রুততর করে তুলতে পারে।
তা ছাড়া কোভিড পাসপোর্টের তথ্য-উপাত্ত হ্যাক হলে সেটা স্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তারও সর্বনাশ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় মানুষের জন্য বিড়ম্বনা হলো, তাদের দেশটি বিশ্ব পরিসরে নীতিনির্ধারণী জায়গায় নেই। ক্ষমতাধর দেশগুলো যদি ভ্যাকসিন পাসপোর্টের বিষয়টিতে একমত হয়ে যায়, বাংলাদেশের সেটা না মেনে উপায় থাকবে না। আবার একে ঘিরে বাণিজ্যের যে বাড়তি সুযোগ আছে, সেটা মাথায় রেখে এখানেও অনেকে এর পক্ষে জনমত তৈরিতে নেমে পড়বে। বিশ্বে যেসব দেশের মানুষ কাজের জন্য বেশি বেশি বাইরে যায়, তার মধ্যে বাংলাদেশের হিস্যা বেশ বড়। বিদেশমুখী এই শ্রমজীবীর বড় অংশই গ্রামের দরিদ্র মানুষ। ভ্যাকসিন পাসপোর্ট ধারণা এদের জন্য এক নতুন বোঝা হয়ে উঠতে পারে।
বর্ণপ্রথা ও জাতপাতের দেয়াল অতীতে যেসব বহু অনাচার করেছে, অতিমারি থামানোর নামে সেই আতরাফদের যেন আরেক দফা কোণঠাসা করা না হয়।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক