‘তোমরা সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায়বিচার করো...’

১৯৭১ সালে যখন এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তখন ধর্ম বা জাতিগত বিভেদ ছিল না। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বাঙালি-আদিবাসী সবাই মিলেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। জাতীয় ঐক্যের ওপর প্রথম আঘাত আসে যখন লাখো প্রাণের রক্তে রঞ্জিত সংবিধানে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। দ্বিতীয় আঘাত আসে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দেওয়ায়। সংবিধান থেকে সামরিক ফরমান বলে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিলেন সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। এরপর আরেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম আইন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ছাড়া অন্য সবাইকে ‘অপর’ করে দিলেন।

তারিখটি ছিল ৯ জুন ১৯৮৮। এই রাষ্ট্রধর্ম আইনের প্রতিবাদে গঠিত হয় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। তারা ৯ জুন কালো দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছে। আবার তারা সংগঠনের নামের সঙ্গে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নাম ব্যবহার করছে। এটা স্ববিরোধিতা নয় কি? তাঁদের এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমাদের আরও পেছনে যেতে হবে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করেন এবং নিজের সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করতে তফসিলি ফেডারেশন, হিন্দু লীগ ইত্যাদি নামে দল করতে সংখ্যালঘুদের প্ররোচিত করেন। তখনো মূলধারার সংখ্যালঘুরা সম্প্রদায়ভিত্তিক কোনো সংগঠন গঠনের চিন্তা করেননি। কিন্তু এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম আইনের পর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতেই তাঁরা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠন করেন।

১৯৮৮ সালে বিরোধী দলবিহীন চতুর্থ সংসদে রাষ্ট্রধর্ম আইন পাস হয়। তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বিরোধী দল এর বিরোধিতা করেছিল। নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালা করে ক্ষমতায় এলেও আইনটি বাতিল করেনি। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে নীতিগত পার্থক্য নেই। দুই দলই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আড়ালে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’কে লালন করে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আশা করেছিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের হেফাজতকারী আওয়ামী লীগ এরশাদ প্রবর্তিত কালো আইনটি বাতিল করবে।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন, সংবিধান পরিবর্তন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের নেই। ২০০৯-এর পর এই যুক্তি খাটে না। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদে তারা দুই-তৃতীয়াংশের অনেক বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং এখনো আছে। ১২-১৩ বছর ধরে সংসদের ভেতরে ও বাইরে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। তারপরও সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের সময় রাষ্ট্রধর্ম রেখে দিল। আওয়ামী লীগের দাবি, ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তারা বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চার নীতি প্রতিস্থাপন করেছে। একই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম যেন সোনার পাথরবাটি। যেসব মুসলিম দেশে রাষ্ট্রধর্ম আছে, তার মধ্যে পাকিস্তান অন্যতম। তাহলে কি আমরা পাকিস্তানের পথেই হাঁটছি?

নানা কারণে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা আইনি, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার। কখনো গুজব ছড়িয়ে, কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালানো হয়। গত মার্চে সুনামগঞ্জের শাল্লায় ঝুমন দাশ নামের এক যুবককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে হেফাজতের এক নেতা সম্পর্কে ফেসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দেওয়ার দায়ে। কেউ আইন ভঙ্গ করলে সরকার ব্যবস্থা নেবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ঝুমন দাশের ঘটনায় নোয়াগাঁও গ্রামের সংখ্যালঘুদের শতাধিক বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা কেন ঘটল? এ হামলায় হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরাও জড়িত ছিলেন। এর আগে কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের বহু ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও বৌদ্ধমন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে আরজি জানানো হয়েছিল, যেসব মন্ত্রী ও সাংসদ সংখ্যালঘুদের বাড়ি-জমি-সম্পত্তি দখলের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের যেন মনোনয়ন না দেওয়া হয়। তাঁরা একজন সাবেক মন্ত্রীসহ ৩১ জন সাংসদের তালিকাও দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ কি পরিষদের সেই আরজি শুনেছে? পরিষদের একজন নেতাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, অভিযুক্তদের বেশির ভাগই একাদশ সংসদে আছেন। তবে কয়েকজন মনোনয়ন পাননি।

বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল করার মতো বেআইনি ও অমানবিক কাজটি যাঁরা করেছেন, তাঁরা এ সমাজেরই মানুষ। তাঁদের কেউ রাজনীতিক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ আইনজীবী, কেউ সরকারি কর্মকর্তা। অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত সম্পাদিত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বঞ্চনা: অর্পিত সম্পত্তির সঙ্গে বসবাস বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, অতীতে অর্পিত সম্পত্তি দখলের সময় সর্বোচ্চসংখ্যক ৩৭ শতাংশ সুবিধাভোগী মুসলিম লীগের সঙ্গে জড়িত ছিল। আর বর্তমানে (২০০৬) ক্ষমতাসীন বিএনপির সঙ্গে ৪৫ শতাংশ, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ৩১ শতাংশ, জামায়াতের সঙ্গে ৮ শতাংশ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে ৬ শতাংশ সুবিধাভোগী সংশ্লিষ্ট। উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপির সঙ্গে সুবিধাভোগীদের ৭২ শতাংশ সংশ্লিষ্ট ছিল। ওই সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে সুবিধাভোগীদের বেশির ভাগই দলবদল করে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। আবার ১৯৯৭ সালে সুবিধাভোগীদের বেশির ভাগই ২০০৩ সালে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয়।

সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার প্রশ্ন এলে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেকে বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে তো সংখ্যালঘুরা ভালো আছে। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। পূর্ববর্তী সরকারগুলোর আমলের সঙ্গে তুলনা করলে তাঁদের এ বক্তব্য সঠিক।

আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, আপনারা যখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অন্যায়-অবিচারের কথা বলছেন, তখন ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থা কী? ভারতে মুসলমানদের অবস্থা ভালো নয়। মোদি সরকারের সংশোধিত নাগরিক আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যেসব অমুসলিম (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ প্রমুখ) সে দেশে গেছেন, তাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন। অর্থাৎ মুসলমানরা পাবেন না। গান্ধী-নেহরুর দেশে এ রকম বিদ্বেষ ও বৈষম্যমূলক আইন হতে পারে, তা অতীতে চিন্তাও করা যায়নি। তারপরও হয়েছে। সেক্যুলার ভারত এখন গৈরিক বসন পরেছে। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক নির্বাচনের বিতর্কের মূল বিষয়ই ছিল হিন্দু-মুসলমান। মোদি সরকারের নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে ভারতে জোরালো প্রতিবাদও হচ্ছে। আরও অনেক বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে কূটনীতিক দেব মুখার্জি (বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার) মোদি সরকারের নাগরিক আইন চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদে একজন কেন্দ্রীয় সচিব স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশেও ১০ জন বিশিষ্ট নাগরিক এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম আইনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন, যদিও সেই রিট গৃহীত হয়নি।

ভারতের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব দেশটির সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। আবার বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব এখানকার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। অন্য দেশের মন্দ উদাহরণ টেনে আমরা যেন এ সত্য ভুলে না যাই। এ প্রসঙ্গে ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। পৃথক নির্বাচনসংক্রান্ত প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ যদি আমরা হিন্দু সংখ্যালঘুদের সমানভাবে গ্রহণ করে বিচার করি, দুনিয়ায় তাহলে বলতে পারব, হিন্দুস্তানে মি. নেহরু এবং মি. রাজেন্দ্র প্রসাদকে বলতে পারব, ডু জাস্টিস টু দ্য মাইনরিটিজ অব ইয়োর কান্ট্রি।’ (সূত্র: স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড)

বাংলাদেশ এমন রাষ্ট্রনায়কই প্রত্যাশা করে, যিনি নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করে ভারতসহ পৃথিবীর সব দেশের রাষ্ট্রনেতাদের জোর গলায় বলতে পারবেন, ডু জাস্টিস টু দ্য মাইনরিটিজ অব ইয়োর কান্ট্রি—তোমার দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায়বিচার করো।

একদা ঘোষিত হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল নিজেকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা সেক্যুলার রাষ্ট্রের চরিত্র কেন রাষ্ট্রধর্মের মোড়কে ঢেকে দেব?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]