২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

একাত্তরে পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতি

একাত্তরে কেমন কাটছিল পাকিস্তানের জেলে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়? এর কোনো দলিল কোথাও নেই। এত দিনে পাওয়া গেল তার কিছু আভাস। মিলানওয়ালি জেলে বন্দী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সহবন্দী হয়েছিলেন রাজা আনার খান। আসলে কয়েদি ছিলেন না, পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কয়েদির ছদ্মবেশে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী। তাকে দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর নজর রাখতে। ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের টিভি চ্যানেল ‘দুনিয়া নিউজ’–এর নেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে পাওয়া যাচ্ছে মিলানওয়ালি জেলে বন্দী বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। সাক্ষাৎকারের শেষ কিছু অংশ পাওয়া যায়নি। উর্দু থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন জাভেদ হুসেন

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আপনার কীভাবে কোথায় প্রথম দেখা হয়?

রাজা আনার খান: আমি তখন লাহোরে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম। আমার কাছে হুকুম এল বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে মিয়ানওয়ালি যেতে হবে। আরও কয়েকজন অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে। আমি মিয়ানওয়ালি পৌঁছে গেলাম। পুলিশ লাইনে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। আমাকে জানানো হলো, এখানে শেখ মুজিবুর রহমান আছেন। তিনি তো সুপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন, ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নির্বাচন করেছেন। অজানা কেউ তো নন। মোট কথা, আমি জানতাম শেখ মুজিবুর রহমান কে।

আমাকে বলা হলো, ‘তিনি এখানে বন্দী, মিয়ানওয়ালি জেলে। আপনাকে সেখানে ডিউটি দিতে হবে।’ ঘটনা হলো, আমি তাঁর সেলে যাব, কিন্তু যেতে হবে কয়েদির বেশে। মানে আমি যে পুলিশ অফিসার বা অন্য কিছু, এটা যেন বোঝা না যায়। তো আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। এটা সেই সেল, আগে কোনো এক সময় যেখানে জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: সেলটা কেমন ছিল?

রাজা আনার খান: ছোট এক কামরা। সঙ্গে এক চিলতে লনের মতো। বাইরে বারান্দা। ভেতরেই একপাশে একটা বাথরুম আর ছোট একটা রান্নাঘর।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: আপনি কি তাঁর সেবাদাতা হিসেবে সেখানে গিয়েছিলেন?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ, আমি যাওয়ার তিন-চারদিন আগে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। সে সময়টায় আইয়ুব নামে এক কয়েদি তাঁর জন্য নিযুক্ত ছিল। ওঁর মুখে ছিল দাড়ি, আজাদ কাশ্মিরের বাসিন্দা। আগেই ঠিক করা হয়েছিল, আমাকে কী নামে পরিচয় দেওয়া হবে। আমি বললাম, আমাকে পরিচয় করানো হোক রাজা খান নামে। আমি এই নাম শুনতে অভ্যস্ত।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: এর পর শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ, দেখা হলো। তিনি জানতে চাইলেন, আমার কী নাম, কোথায় বাড়ি, জেলে কেন এসেছি? বললাম, আমি কয়েদি, আপনার সেবক। তিনি আবার জানতে চাইলেন, ‘কী অপরাধে এসেছ?’ আমি বললাম, জি, একটা মেয়েকে অপহরণ করেছিলাম। বয়স কম ছিল, তাই এ কথাটিই মাথায় এল। বললেন, কোথা থেকে এসেছ। জবাব দিলাম, ফয়সলাবাদ থেকে। জিগ্যেস করলেন, কত বছরের সাজা হয়েছে? বললাম, তিন বছর। আমার আগে যে আইয়ুব নামে একজন ছিলেন, তারও তিন বছরের সাজা ছিল, অপহরণের মামলায়। তিনি হেসে বললেন, আরে! আমার কপালে দেখি সব অপহরণকারী এসে জুটেছে! আমার মনে হলো, শেখ সাহেব আমার কথা বিশ্বাস করেননি। তাঁর সন্দেহ ছিল এ নিশ্চয়ই কোনো গোয়েন্দা সংস্থার লোক!

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: আগে আইয়ুব নামে যিনি ছিলেন, তিনিও কি তা–ই?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ, আইয়ুবও গোয়েন্দা ছিলেন।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: শেখ সাহেব খাট পেয়েছিলেন। ঠিকঠাক বিছানা পেয়েছিলেন। টেবিল, চেয়ার—এসব দেওয়া হয়েছিল?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ, ভেতরে বিছানা পাতা ছিল। রাতে তাঁর ঘরে আমি নিজে তালা লাগাতাম। আর চাবিটা বাইরে বালির নিচে কোথাও লুকিয়ে রাখতাম। তবে মনে রাখতাম, ঠিক কোথায় চাবি রেখেছি। তিনি কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করলেন না। তাঁর সন্দেহ থেকেই গেল। তবে আমিও আমার আচরণে অবিচল রয়ে গেলাম। মানে, চেয়ার নিয়ে তিনি বাইরে বসলে আমিও নিচে বালিতে বসতাম। তিনি বলতেন, আরে ভাই, তুমি এই টুলটা নিয়ে বসো। আমি বলতাম, জি না, আমি নিচেই ঠিক আছি।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: তাঁর খাবার কি আইয়ুবই রান্না করত?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ, আইয়ুবই করত, তবে তাঁর পছন্দমতো। তিনি যা খেতে চাইতেন, তার সবকিছু ওখানে দেওয়া হতো। তবে এর মধ্যেও কিছু ব্যাপার ছিল। যেমন বাইরে থেকে হয়তো মাংশ এল, খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো। সেই কাগজ বাইরে ফেলে দিয়ে তারপর আমরা মাংশ ভেতরে ঢোকাতাম, যাতে তিনি আবার কিছু পড়ে না ফেলেন। খবরের কাগজ, রেডিও, কথা বলার কোনো মানুষ—কিছুই তাঁকে দেওয়া হতো না।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: টেলিভিশন বা কোনো বই?

রাজা আনার খান: কী যে বলেন! কিছু না, একেবারেই কিচ্ছু না। তাঁর কাছে থাকত একটা পাইপ আর এরিনমোর তামাক। তিনি এর খুব ভক্ত ছিলেন। বাইরে থেকে কোনো মানুষ ভেতরে আসতে পারত না, মানে, খাজা তুফায়েল সাহেব ছাড়া আর কেউ ভেতরে আসতে পারতেন না।

তিন-চার মাস পার হওয়ার পর শেখ সাহেব একটু একটু করে আমার সঙ্গে মিশতে শুরু করলেন। এক দিন তিনি বাইরে বসে ছিলেন চেয়ারে। আমি নিচে বসেছিলাম। আমাদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল। কথা হতে হতে—তাজউদ্দীন তাঁদের এক বড় নেতা ছিলেন—আমি প্রশ্ন করলাম, বাবা, আপনার দলে বড় নেতা কারা কারা? তিনি বলতে শুরু করলেন, ইনি আছে, উনি আছে, একজন আছেন তাজউদ্দীন।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: আপনাদের মধ্যে যখন নৈকট্য বাড়ল, তখন তাকে কেমন মানুষ হিসেবে দেখলেন?

রাজা আনার খান: তিনি ভালো একজন মানুষ ছিলেন, দরদি মানুষ। অন্যের জন্য মনে সহমর্মিতা ছিল। তবে একটা ব্যাপার, তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির নন, ছিলেন আঞ্চলিক রাজনীতির মানুষ।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: মানে, তিনি বাংলার রাজনীতিবিদ ছিলেন, বাংলাই তাঁর মনোযোগের কেন্দ্র ছিল। বাংলার উন্নতিই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তিনি কী এমন কথা বলতেন যে আমি বাংলাকে আলাদা করতে চাই, আমাদের ওপর অত্যাচার হয়েছে? পাকিস্তানের নেতৃত্ব আমাকে দেওয়া হয়নি?

রাজা আনার খান: পরে যখন তিনি জানতে পারলেন, জানতে পারলেন মানে...তিনি বলতেন, ‘আমার কী এমন অপরাধ যে এখানে ধরে আনা হলো? এই ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানকে ধংস করছে।’ তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) জানতেন না যে ভুট্টো (রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের দোরগোড়ায়) এসে পড়েছেন। ইয়াহিয়া পাকিস্তানকে ধংস করতে চাইছে। এই ইয়াহিয়া ভারতের এজেন্ট। ইয়াহিয়া ভারতের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছেন। তাঁর ধরন দেখে সে রকমই মনে হয়।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: আর নয় তো সে বোকা?

রাজা আনার খান: না, না, বোকা বলতেন না। বলতেন, সে বেঘোরে এই কাজগুলো করে, নেশার মধ্যে করে, বাজে কাজ করা একজন মানুষ—এসব বলতেন। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, ‘পাকিস্তানের জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি। নিজের ক্যারিয়ার শেষ করেছি।’ তিনি বলতেন, ‘দ্যাখো, আমার সম্পত্তি বলতে এখন মাত্র তিন একর জমি, সেখানে আমার ঘর। ওখানে ছোট্ট একটা পুকুর, তাতে আমি মাছ চাষ করি। জমিতে ধানচাষ হয়। পানের বরজও আছে। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে হাজার পাঁচেক টাকা পাই।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: এই দায়িত্ব নিয়ে আপনি যখন জলখানায় এলেন, তখন শেখ সাহেব সম্পর্কে আপনার কী ধারণা ছিল?

রাজা আনার খান: আমি ইতিহাস পড়েছি। পাকিস্তানের ঘটনাধারা তখন পড়ছি। দেখছি সব। নির্বাচন হয়েছে আমার সামনে। আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চে ছিলাম। আমার নিজ চোখে সব দেখা। আমার স্মৃতিতে আছে, পাকিস্তানে ভুট্টো সাহেব কুসুরি সাহেবের পেটে ঘুষি মারছেন। ভুট্টো বলছিলেন, যে ওদিকে যাবে আমি তার পা ভেঙে দেবো। আমার সঙ্গে তখন দু–তিনজন অফিসার ছিলেন। আমি বলেছিলাম, পাকিস্তান আজ ধ্বংস হয়ে গেল। ভুট্টো আজ তাঁর কথায় পাকিস্তানের ধংসের বীজ বপন করলেন।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: যা হোক, শেখ সাহেবের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আপনার কী ধারণা হলো—একজন দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি?

রাজা আনার খান: তিনি দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি ছিলেন, অথচ তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বানানো হয়েছিল। তাঁকে এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তিনি যুক্তরাজ্য চলে গেলেন। সেখান থেকে বাংলাদেশে গিয়ে সেখানকার প্রেসিডেন্ট হলেন।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: আচ্ছা, ফয়সালাবাদে তো শুনানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। শেখ মুজিবের উকিল কে ছিলেন?

রাজা আনার খান: ব্রোহি সাহেব। ব্রোহি সাহেব এলে আমি তাঁকে সঙ্গ দিতাম। আরেকটা কথা, মিয়ানওয়ালি না, স্যাহিবাল থেকে তিনি প্রতিদিন ডায়েরি লিখতে শুরু করলেন।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: পরে মামলা শুরু হলো। আপনার ওপর নির্দেশ ছিল, পরিস্থিতি তেমন হলে গুলি চালাবেন?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ। মানে সে রকম কোনো বিপদ ঘটলে। বেশি ভয় ছিল, ভারত থেকে কমান্ডো চলে এসে পড়তে পারে। হেলিকপ্টারে করে ভারতের কমান্ডোরা এসে না তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: শুনানি কি জেলের ভেতরে হতো নাকি বাইরে?

রাজা আনার খান: জেলের ভেতরে।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: বিচারক কি ওখানেই আসতেন?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ। ওখানেই সাক্ষীরা আসতেন, সওয়াল-জবাব হতো। পুরো একটা আদালত বলতে যা বোঝায়, তা–ই।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: আপনি কি সেই আদালতের ভেতরে থাকতেন?

রাজা আনার খান: আমি শেখ সাহেবকে নিয়ে যেতাম। কখনো–কখনো তাঁকে রেখে ফিরে আসতাম।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: শেখ সাহেব কি উদ্বিগ্ন থাকতেন? উকিলের সঙ্গে দেখা করার সময় কী অবস্থায় থাকতেন?

রাজা আনার খান: উকিলের সঙ্গে দেখা করতেন। বিস্তারিত কথা বলতেন। নিজের পরামর্শ দিতেন, উকিলের কথাও শুনতেন। তবে কিছু দিন পর একবার তিনি অসহযোগিতা–প্রবণ হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘আমি শুনানিতে যাব না।’ সবাই বিপদে পড়ে গেল। শেখ আবদুর রহমান, খাজা তুফায়েল মিনতি করলেন। তিনি কারো কথাই শুনলেন না। বললেন, ‘আমি যাব না।’ তিন-চারদিন, সপ্তাহ এভাবে চলে গেল। শেষে শেখ আবদুর রহমান একদিন আমাকে বললেন, এখন কী করা যায়? বললাম, আমি চেষ্টা করে দেখি। একটু একটু করে তাঁকে আমি বোঝাতে শুরু করলাম। অবশেষে শেখ সাহেব একদিন রাজি হয়ে শুনানিতে হাজির হলেন।

এও আমার এক অদ্ভুত ভাগ্য ছিল। ওই যে খলিলুর রহমান সাহেব বলেন যে তিনি আমার সঙ্গে ভাইয়ের মতো আচরণ করতেন। এ ঘটনা সে কথারই এক প্রমাণ। উনি আমাকে ভাইয়ের মতো দেখতেন বলে আমার কথা রাখতেন। আমি তাঁকে ভালোই বাসতাম। মানে ভালোবেসে ভালো কি মন্দ যা–ই বলা হোক। মানে...তিনি তো বন্দী ছিলেন। আমার কাজ ছিল তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাঁর সঙ্গে থাকা। আমার যে দায়িত্ব ছিল, আমি সেটা পালন করছিলাম।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: উল্লেখ করার মতো কোনো ঘটনা কি মনে পড়ে?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ। একবার একজন ব্রিগেডিয়ার সাহেব এলেন। তিনি ফিরে যাওয়ার পর শেখ সাহেব তাঁকে নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে আমাকে বললেন, এই ব্রিগেডিয়ারটি মিথ্যুক। তাঁর সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখাই হয়নি।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: সেই ব্রিগেডিয়ার কি নকল লোক ছিলেন?

রাজা আনার খান: না, আসল লোকই ছিলেন। তবে জেলে থেকে থেকে বোধহয় মানসিক ভারসাম্য কিছুটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই লোকটিকে শাহি কিল্লায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: জেলখানায়? কেন?

রাজা আনার খান: মানে, সরকারের উদ্দেশ্য ছিল যে এই ব্রিগেডিয়ারটিকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী বানাবে।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: এই ব্রিগেডিয়ার কি শেখ সাহেবের সঙ্গে অভিযুক্ত ছিলেন?

রাজা আনার খান: না, অভিযুক্ত ছিলেন না। ব্রিগেডিয়ারটি কে ছিলেন, আমার জানা নেই। তবে তাঁকে শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়েছিল। শেখ সাহেব খুব বিরক্ত হয়ে আমাকে বলতে লাগলেন, এই ব্রিগেডিয়ার মিথ্যুক। সে বলছে, আমার সঙ্গে নাকি তার অমুক অমুক জায়গায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে; অথচ জীবনে ওকে আমি আগে কখনো দেখিইনি।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: যুদ্ধ তো তখন শুরু হয়েছে? শেখ মুজিব কি জানতেন যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে?

রাজা আনার খান: আমি জানতাম। কারণ আমার কাছে ছোট একটা রেডিও ছিল। মিয়ানওয়ালিতে আমি ঘুমাতাম বারান্দায়। শাহিওয়ালে রান্নাঘরের পাশে খোলা জায়গায় চারপাইয়ে শুয়ে থাকতাম। ফয়সলাবাদে সেলের ভেতরে ঘুমাতাম। সেখানে আমার বিছানা ছিল। সঙ্গে সেই রেডিও ছিল। চাবি তো আমার কাছে থাকত। তাই আমার ঘরে আর কারো আসার উপায় ছিল না। আমি সেখানে রেডিও শুনতাম, বিবিসি। কী ঘটছে সবই আমি জানতে পারতাম।

শেখ সাহেবের অভিযোগ ছিল, পূর্ব পাকিস্তান গরিব, কারণ ইন্ডাস্ট্রির জন্য যে লাইসেন্স দেওয়া হয়, সেগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের চিনোটি শেখেরা (একটি ধূর্ত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়) নিয়ে যায়। সেগুলো সব কব্জা করে নেয়। বাইশ পরিবার সব কিছু দখল করে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে গেছে। সব শিল্প-কারখানা এদের হাতে। বাঙালির কাছে কিছু নেই। এর দরিদ্র, ক্ষুধার্ত। বাঙালি ঋণ পায় না। আমাকে যদি বলেন, আমার মতে পূর্ব পাকিস্তান হারানোর পেছনে এই চিনোটি শেখেরাই দায়ী।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: এটা কি শেখ সাহেবের মত?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ, শেখ সাহেবের মত।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: যুদ্ধ যে শুরু হয়ে গেছে শেখ সাহেব তার কিছুই জানতেন না?

রাজা আনার খান: একদমই কিছু জানতেন না, তাঁকে এমন অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। তাঁর কাছে আমি এত মিথ্যা বলেছি। প্রতিদিন তাঁকে নতুন নতুন কথা বানিয়ে বলতাম। কোথাও গুলি চললে বলতাম, কাছেই ফায়ারিং রেঞ্জ আছে। ব্ল্যাক আউট হলেও সে রকমই কিছু বলতাম। তিনি মেনে নিতেন। বলতেন, আচ্ছা, ঠিক আছে।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: তিনি কখনো বলতেন না যে আমাকে ইয়াহিয়া খান বা অন্য কারো সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও—আমি কথা বলব, বোঝানোর চেষ্টা করব?

রাজা আনার খান: সেটা আমাকে কেন বলবেন? আমি তো সেখানে একজন কয়েদি!

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: মানে, অন্য কোনো অফিসারের কাছে?

রাজা আনার খান: সেটা বললে উনি বলতে পারতেন আবদুর রহমান বা খাজা তুফায়েল সাহেবের কাছে, কিন্তু উনি বলেননি।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: সেনা শাসকদের কাছ থেকে কোনো বার্তা আসেনি? কেউ দেখা করতে আসেননি—কোনো বড় মানুষ? কেউ কথাবার্তা বলেননি, কেউ কোনো যোগাযোগ করেননি?

রাজা আনার খান: কেউ না।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: ট্রায়ালের সময়ও শেখ সাহেবের সঙ্গে এমন কারো দেখা হয়নি, যারা জানেন যে যুদ্ধ চলছে?

রাজা আনার খান: তাঁর উকিলও তাঁকে এই খবর দিতেন না। সরকারের কাছ থেকে উকিলদের কাছে এই নির্দেশ দেওয়া ছিল যে তারা এ বিষয়ে কিছু জানাবে না।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: ওরা শুধু মামলা নিয়ে কথা বলবে?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ, কেবল মামলা নিয়ে কথা বলবে।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: উকিল যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তখন কি সেখানে আর কেউ থাকতেন?

রাজা আনার খান: আমি থাকতাম। সব সময়ই আমি থাকতাম।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: ব্রোহি সাহেবের যখন দেখা হচ্ছে...

রাজা আনার খান: ব্রোহি সাহেবের সঙ্গে যখন দেখা হচ্ছে, তখন একদিকে ব্রোহি সাহেব, আরেক দিকে চেয়ারে শেখ সাহেব, আর অন্যদিকে আমি। মানে, ঠিক কাছে না। তাঁরা কথা বলছেন, আমার দায়িত্ব হচ্ছে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাঁদের যাতে কোনো বিপদ না হয়। কেউ যেন তাঁদের মেরে ফেলতে না পারে।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: উকিলের সঙ্গে শেখ সাহেবের কী কথা হলো, তা কি পরে আপনি জানাতেন?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ। বাথরুমে গিয়ে বাইরে থেকে আনানো কাগজে সেসব কথা লিখে পাঠিয়ে দিতাম।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: উকিল সাহেবের সঙ্গে বাইরের বিষয়ে কোনো গল্পগুজব...

রাজা আনার খান: একদম হতো না। আমি তো এ জন্যই ওখানে থাকতাম, যাতে উকিল সাহেব বলে না দেন যে বাইরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: উকিলকে সরকারের পক্ষ্য থেকে এসব বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া ছিল?

রাজা আনার খান: অবশ্যই। উঁচু মহলের কর্মকর্তারা তখনই উকিলকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন, যখন তিনি সম্মত হয়েছেন যে তিনি এসব বিষয়ে খেয়াল রাখবেন। আর ব্রোহি সাহেবকে যাঁরা চেনেন তাঁরা জানেন, তিনি কী বিশ্বাসযোগ্য মানুষ ছিলেন। তিনি তেমন কোনো আচরণ করার প্রশ্নই ওঠে না।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: ব্রোহি সাহেব কি শেখ সাহেবকে আশ্বস্ত করতেন যে তিনি তাঁকে মুক্ত করতে পারবেন?

রাজা আনার খান: হ্যাঁ, ব্রোহি সাহেব বলতেন, ‘এই মামলা একেবারে ভিত্তিহীন। আপনি ভরসা রাখুন, ইনশাল্লাহ আপনাকে আমি মুক্ত করে ফেলব।’

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: আপনার তো এই সন্দেহ ছিল যে তাঁর ফাঁসির সাজা হয়ে যেতে পারে?

রাজা আনার খান: আমার এই সন্দেহটা ছিল। কারণ এই যে সব নাটক হচ্ছিল, এই যে ব্রিগেডিয়ারকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানো হলো। সেই শাহি কিল্লা, এসব বিষয়ে খুব গালমন্দ করতেন তিনি। তাঁর সামনে আমি চুপ করে থাকতাম। তিনি বলতেন, শাহি কিল্লায় এই যে সব অত্যাচার–নিপীড়ন হয়, আমি যদি কাল ক্ষমতায় আসি, সম্ভব হলে এদের সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেব।

পরে আশে-পাশে দু–চারটা বোমা পড়লে তখন এই জেলের ওপরেও না হামলা হয়, আমরা সেই বিপদের আশঙ্কা করলাম। তখন ওখান থেকে, ফয়সালাবাদ থেকে আমাদের নিয়ে আসা হলো। সড়কপথে আমরা মিয়ানওয়ালি গেলাম। রাস্তায় গাড়ি দেখে শেখ সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই গাড়িগুলোর কাচে মাটি লেগে আছে, এগুলোতে ক্যামোফ্লাজ কেন? আমি বললাম, জি, এখন মহড়া চলছে তো, সেনাবাহিনীর মহড়া। সে কারণে। তাঁকে নিয়ে যাওয়ার সময় এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কম্বল–বালিশ এমন করে ঠেসে ঢোকানো হয়েছিল, যাতে তাঁকে কেউ দেখে না ফেলে, আবার তিনিও যেন কাউকে না দেখতে পান। তো তাঁকে নিয়ে গিয়ে সেলে রেখে এলাম। এর পর ফিরে এসে আমি রেডিও শুনছি। ওই যে কী যেন জেনারেলের নামটা, অরোরা (জগজিৎ সিং অরোরা)। অরোরার পক্ষ থেকে রেডিওতে বারবার ঘোষণা হচ্ছিল, ‘আপনার অস্ত্র সমর্পণ করুন। আমরা অগ্রসর হচ্ছি।’ আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। বারবার ঘোষণা হচ্ছিল, ‘আপনারা আত্মসমর্পন করুন।’ আমি ভাবছি, কী ব্যাপার? কী হচ্ছে? সে রাতে আমার খুব সর্দি হলো। শেখ সাহেব আমাকে ঘর থেকে বের করে আনলেন। বললাম, আমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আমি পুলিশ লাইনে গেলাম। সেখানে কোয়ার্টার ছিল। কর্মচারীরা থাকতেন। আমি সেখানে রোদে বসে রইলাম। সেখানেই পাকা খবর পেলাম, ঢাকা আত্মসমর্পণ করেছে। আমার মনে আছে। জীবনে এর চেয়ে বেশি বোধহয় কখনো কাঁদিনি।

প্রশ্ন :

দুনিয়া নিউজ: আপনি কল্পনাও করতে পারেননি যে এমন হতে পারে? শেখ সাহেব কি তখনো কিছু জানতে পারেননি? আপনি নিজেকে সামলে নিলেন?

রাজা আনার খান: ওখনে হামলার আশঙ্কা ছিল। তাই আমরা একটা পরিখা খনন করালাম। ‘এল’ আকারের পরিখা। সেই পরিখার প্রবেশমুখে প্রথমে মাদুর, তার ওপর কম্বল বিছিয়ে সেখানে শেখ সাহেবকে রাখা হলো। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, প্রথম বিবিসির একটা অনুষ্ঠানে শেখ সাহেব বলেছিলেন, ‘আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল।’ এটা একটা বিখ্যাত কথা। এটাই আসলে হলো সেই কবর।

সেখানে একটা ঘটনা ঘটল। আমি রাতে শুয়ে আছি। রাত তখন দুইটা কি তিনটা হবে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। খাজা সাহেব জোরে চিৎকার করছেন, ‘রাজা খান! রাজা খান! দরজা খোলো।’ আমি তো ঘাবড়ে গেলাম। দরজার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, কে? উত্তর এল, ‘আমি খাজা তুফায়েল, তাড়াতাড়ি দরজা খোলো।’ আমি বললাম, ‘আমি দরজা খুলব না, সিকিউরিটি আছে।’ উত্তর এল, ‘খোদার দোহাই, দরজা খোলো, খুব জরুরি। তোমার আর শেখ মুজিবের প্রাণসংশয়।’ এবার আমি চাবি নিয়ে দরজা খুললাম। দ্বিতীয় চাবি নিয়ে শেখ সাহেবের ঘরের তালা খুললাম। খাজা সাহেব ভেতরে গেলেন। শেখ সাহেব ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁকে খাজা সাহেব ডেকে তুললেন। উনি হঠাৎ ঘুম ভাঙানোয় চমকে গিয়েছিলেন।

খাজা সাহেব বললেন, শেখ সাহেব, জলদি আপনার জিনিশপত্র গুছিয়ে নিন। তিনি একটা ফতুয়া পরা ছিলেন। সময়টা ছিল ফাঁসি দেওয়ার প্রহর। কয়েদিদের ফাঁসি দেওয়া হয় এই রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে। শেখ সাহেব বললেন, ‘আমাকে কি ফাঁসি দিতে নিয়ে যাচ্ছেন?’ খাজা সাহেব বললেন, ‘না, ফাঁসি নয়। অন্য ব্যাপার।’ শেখ সাহেব বললেন, ‘না, আমাকে তো ফাঁসি দিতেই নিয়ে যাচ্ছেন।’ কয়েকবার এ রকম কথাবার্তা হওয়ার পর জিনিসপত্রসহ তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মাঠ পার হয়ে একটা ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। কড়া নাড়া হলো। শেখ আবদুর রহমান ভেতরে ছিলেন। দরজা খুলল। আমরা ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম।