২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আমরা যে কারণে পুষ্টিবঞ্চিত

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে সেদ্ধ চালের ভাত খাওয়া হয়। সেদ্ধ চালের ভাত খাওয়ার নেতিবাচক দিক: (ক) সেদ্ধ চালের ভাত আতপ চালের ভাতের তুলনায় স্বাদহীন; যা নির্দেশ করে, ধান সেদ্ধ-শুকানোর কারণে চাল অনেক গুণাগুণ হারায়। (খ) স্বাদহীন বলে মুখে দেওয়ার আগে ম্যানুর সঙ্গে যুক্ত করে দলাইমলাই করতে হয়, যা হাত দিয়ে থালায় করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয়। ফলে আমরা পুষ্টিসমৃদ্ধ অনেক রকমের কাঁচা বা আধা কাঁচা খাবার না খেয়ে খুব সীমিত খাবার খাই, যা সুষম খাবার গ্রহণের অন্তরায়। (গ) স্বাদহীন ভাত খাওয়ার উপযোগী করতে ম্যানুগুলোয় অত্যধিক মসলা-ভোজ্যতেল ব্যবহার করতে হয়, যা গ্যাসট্রিক ও গ্যাসট্রিক-আলসারসহায়ক। ওই সব দেশে মসলা ব্যবহার করা হয় না এবং খুব কম মেন্যুতে ভোজ্যতেল ব্যবহার করে। চার সদস্যের পরিবারে মাসে তাদের লাগে এক লিটার, কিন্তু আমাদের লাগে ১০ লিটারের বেশি ভোজ্যতেল। এ জন্যই ওই সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে হার্টের রোগ অনেক বেশি। অথচ এক কণা মসলা বা এক ফোঁটা ভোজ্যতেল ব্যবহার না করে অত্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর রেসিপি কম ঝামেলায় তৈরি করা সম্ভব। (ঘ) মসলা-ভোজ্যতেলনির্ভর ম্যানুর কারণে রান্নার সময় দীর্ঘ বলে রান্নার কাঁচামালগুলো পুষ্টিগুণ হারায়। আমরা গরুর মাংস আড়াই-তিন ঘণ্টা ধরে সেদ্ধ করি, অথচ ওই সব দেশে এমনও গরুর মাংসের রেসিপি আছে, যা হাড়ছাড়া মাংস কাগজের মতো পাতলা করে কেটে গরম পানিতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সেদ্ধ করে খায়। (ঙ) ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় আমরা একবারে অনেক খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে খাই, যা স্বাস্থ্যসহায়ক নয়। ওই সব দেশে এমনকি গরিব পরিবারেও দুপুরের খাবার রাতে বা এক বেলার খাবার অন্য বেলায় খায় না। (চ) একই কারণে আমাদের কাজের লোকদের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি, যদিও তাঁদের হাইজেনিক থাকার বিষয়টি মানিয়ে চলা কঠিন। (ছ) সেদ্ধ চালের ভাত ও উপযোগী ম্যানু লাঞ্চের জন্য কর্মস্থলে নেওয়া আরেক বিড়ম্বনা, (জ) সেদ্ধ চালের ভাত আতপ চালের ভাতের তুলনায় বেশি খেতে হয়। ফলে লোক বেশি দেশ ছোট হলেও বাংলাদেশকে অধিক পরিমাণে ধান ফলাতে হয়।

এ ছাড়া চুলা, ধান শুকানোর উঠান বা চাতাল, কর্মঘণ্টা ও বাড়তি পরিবহন এবং ধান সেদ্ধ করতে জ্বালানিবাবদ খরচ গুনতে হয়। সব মিলিয়ে কেজিপ্রতি দুই টাকা ধরলে দেশে বছরে উৎপাদিত কমবেশি তিন কোটি টন ধান সেদ্ধ-শুকানোর জন্য বাড়তি খরচ হয় ছয় হাজার কোটি টাকা। গ্রামে গোবর লেপন করা উঠানে শুকানোর কারণে এবং গৃহপালিত হাঁস-মুরগির মলমূত্র দ্বারা ধান কলুষিত হয়। গোবর ও মলমূত্র ধান ভাঙানোর সময় অনেকটা কুঁড়া-তুষের সঙ্গে আলাদা হলেও চালের সঙ্গে থেকে যায়। এ ছাড়া ধান সেদ্ধ করার শ্রমের পরিমাণ বিশাল, যা অন্যত্র উৎপাদন খাতে নিয়োগ করা যায়।

ধান সেদ্ধ করার মূল কারণগুলো: চাল কম ভাঙে, ভাত হয় ঝরঝরে, সংরক্ষণ করা সহজ, কোষ্ঠকাঠিন্য হয় না ইত্যাদি। যেসব দেশে একটি ধানও সেদ্ধ করা হয় না, তাদের চাল তো ভাঙেই না এবং আতপ চাল সংরক্ষণের কৌশলও তাদের জানা। কোষ্ঠকাঠিন্যের বিষয়টি গুরুত্বের হলে তারা আতপ চাল খেত না। ওই সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পাইলসের রোগী কয়েক গুণ বেশি।

একটি প্রচলিত ধারণা, গরিব বলে বাংলাদেশিরা ধনী দেশের তুলনায় কম শাকসবজি, মাছ-মাংস ও ফলমূল খায় বলে ভাত বেশি খায়। ভিয়েতনাম বা ফিলিপাইনে এখনো অনেক গরিব আছে, যারা একবারে ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম চালের ভাত এবং সঙ্গে পর্যাপ্ত শাকসবজি ও ফলমূল খায়। আতপ চালের ভাত অল্পতেই ক্ষুধা নিবারণ করে। এই ভাতের সঙ্গে খাবার মেন্যু অল্প হলেই চলে। সুতরাং জ্বালানি, শ্রম ও সময় কম লাগে। তাই আতপ চালের ভাত এবং সঙ্গে খাবার ম্যানু সাশ্রয়ী। তা ছাড়া নিকট অতীতে কয়েকটি দৈনিকের কিছু প্রতিবেদন ছিল: (ক) উত্তরবঙ্গে কৃষক বেগুন ৫০ পয়সা কেজি দরে এবং মুলা এক-দুই টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন বা মুলা-বাঁধাকপি গরু দিয়ে খাইয়েছেন; (খ) সবজি বিক্রি করতে না পেরে কৃষক রাগ করে হাটেই ফেলে গেছেন; (গ) টমেটোর কেজি ৫০ পয়সায় নেমে আসায় উপজেলার সামনে প্রতিবাদ এবং দুধের দাম না পাওয়ায় রাস্তায় ঢেলে ক্ষোভ প্রকাশ; (ঘ) তরমুজের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত; (ঙ) ক্রেতার অভাবে বিপাকে কাঁঠালচাষিরা ইত্যাদি। এসব খবরের জন্মই হতো না, যদি আমরা সেদ্ধ চালের একগাদি ভাত না খেয়ে আতপ চালের কম ভাত এবং বেশি করে কাঁচা বা আধা কাঁচা শাকসবজি, ফলমূল (যখন যেটার সিজন ও সস্তা) মূল খাবারের সঙ্গে খেতে অভ্যস্ত হতাম, যা সুষম খাদ্য গ্রহণও নিশ্চিত করত। ফলে ধান উৎপাদন অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হতো। তা হলে বর্তমানের অর্ধেক ধানের জমিতে আরও বেশি শাকসবজি ও ফলমূল ফলানো যেত।

আমরা দেখেছি, পুষ্টিবঞ্চিত হওয়ার মূল গলদটাই শুরু হয় ধান সেদ্ধ থেকে। এটি পুষ্টির জন্য ক্ষতিকর অনেক নেতিবাচক কারণের জন্মদাতা। অথচ অনেক বাংলাদেশি বেশি দাম দিয়ে দোসেদ্ধ চালও খেতে পছন্দ করে। অনেক পরিবার ভাতের মাড়ের সঙ্গে ১৫ শতাংশ পুষ্টিগুণ ড্রেনে ঢেলে দেয়। সেদ্ধ, দোসেদ্ধ ও মাড় ফেলা—সবই সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা।

সেদ্ধ চালের ভাতে ইতিবাচক যে কিছু নেই, তা নয়। তবে নেতিবাচক দিকই বেশি। শুধু চট্টগ্রাম-সিলেটের কিছু অঞ্চলই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ ধান সেদ্ধ করা বন্ধ করে আতপ চাল খেতে অভ্যস্ত হলে এ জাতির সুষম খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত হবে এবং পুষ্টিবঞ্চিত হওয়া থেকে রেহাই পাবে। কাজটি করতে রাষ্ট্রের উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের ধান ও পুষ্টিগবেষকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। না হলে আমাদের রান্নাঘরে স্বাদহীন সেদ্ধ চালের ভাত এবং পুষ্টি নষ্ট করা ম্যানু রান্না হতে থাকবে এবং সমগ্র জাতি পুষ্টিহীনতায় ভুগতেই থাকবে।

ড. মো. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ।