অপ্রদর্শিত আয় মানেই কালোটাকা

বাংলাদেশের সংবিধানের ২০(২) ধারা বলছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক—সকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে।’

সংবিধানের ইংরেজি ভাষ্যে অনুপার্জিত আয়কে আনআর্নড ইনকাম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই সাংবিধানিক ধারার উদ্ধৃতি দিতে হলো এ জন্য যে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী মহোদয় ‘যত দিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে, তত দিন বাজেটে তা সাদা করার ব্যবস্থা থাকবে’ বক্তব্যটি
দিয়ে সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। দেশের রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রত্যেক মন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের সময় দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছেন। অতএব, কোনো ব্যক্তি যাতে ‘অনুপার্জিত আয়’ ভোগ করতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করা তাঁদের অবশ্যপালনীয় সাংবিধানিক কর্তব্য। সংবিধানে ‘অপ্রদর্শিত আয়’ বা আনডসিক্লোজড ইনকাম বলে কোনো টার্ম বা শব্দ নেই, ওটা ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছে। ওই টার্ম সম্পূর্ণভাবে অসাংবিধানিক, যেটি ব্যবহারের মাধ্যমে তখনকার সরকার অনুপার্জিত আয়ের সমস্যাটিকে লঘু বা গৌণ করার ব্যবস্থা করেছে।

সংবিধানের বর্ণিত অনুপার্জিত আয় মানেই কালোটাকা, যেটাকে শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার ব্যবস্থা চালু রেখে সরকারের নীতিপ্রণেতারা সংবিধান লঙ্ঘনের গুরুতর অন্যায় করে চলেছেন। এই বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার-এ ২৪ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমদের একটি মতামত কলামে ‘শুড ব্ল্যাক মানি লিগালাইজড ইন-২২-এ বিষয়টি সম্পর্কে কিছু সুনির্দিষ্ট মত ব্যক্ত হয়েছে, যেগুলোকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের বিবেচনা করা উচিত মনে করি। কারণ, এগুলো একজন সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যানের সুচিন্তিত বক্তব্য। (নাসিরউদ্দিনকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ছাত্র হিসেবে পেয়েছি।)

তিনি হিসাব দিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে মোট ৩০ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় কালোটাকা সাদা করার সরকারপ্রদত্ত সুবিধা ব্যবহার করে ‘প্রদর্শিত আয়ে’ পরিণত হয়েছে এবং এ বাবদ সরকার ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা কর-রাজস্ব সংগ্রহ করেছে। কিন্তু চলতি বছর ব্যতিরেকে অন্য কোনো বছর খুব বেশি অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শিত হয়নি। বর্তমান অর্থবছরে সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগ করলে আয়ের সূত্র সম্পর্কে কোনো সরকারি মহল থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না মর্মে সুবিধা দেওয়াতেই এবং হয়তো করোনা মহামারির কারণেও এ বছর প্রদর্শিত আয়ের এমন স্ফীতি পরিলক্ষিত হয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলছেন, দেশের সংবিধানে এভাবে অনুপার্জিত আয় প্রদর্শনের সুযোগ রাখা হয়নি। এহেন অনুপার্জিত আয় কর ফাঁকি, মানি লন্ডারিং এবং ইনফরমাল ইকোনমি (দুর্নীতি) থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে।

১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশে যে আয়কে অপ্রদর্শিত আয় অভিহিত করা হয়েছে, দেশের সংবিধান মোতাবেক ওই আয় বৈধ সূত্র থেকে অর্জিত আয় হতেই হবে। সুতরাং, অবৈধ সূত্র থেকে প্রাপ্ত আয় (অনুপার্জিত আয়) স্বপ্রণোদিতভাবে প্রদর্শিত আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয়। অবৈধ আয় যেহেতু বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূত, তাই কর দিলেই তা বৈধ আয়ে (উপার্জিত আয়) রূপান্তরিত হওয়ার কোনো ‘সাংবিধানিক সুযোগ’ নেই। কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রদর্শিত আয়ের সূত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে না—এই সরকারি ঘোষণারও কোনো সাংবিধানিক বৈধতা নেই; কারণ, দেশের সংবিধান বেআইনি আয় বা অনুপার্জিত আয়কে আইনসম্মত আয়ে রূপান্তর করার কোনো ব্যবস্থা রাখেনি।

নাসিরউদ্দিন তাঁর সারণিতে দেখাচ্ছেন, শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ পর্বেই ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা অবৈধ আয় ১০ শতাংশ কর পরিশোধের মাধ্যমে প্রদর্শিত আয়ে পরিণত হয়েছে, যেটা বড় ধরনের উল্লম্ফন। তিনি বলছেন, শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে অনুপার্জিত আয়কে বৈধ আয়ে রূপান্তর করার সুযোগ দেওয়া সৎ করদাতাদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক বিধায় অনৈতিক এবং অসৎ করদাতাদের বেআইনি সুবিধা দেওয়ার শামিল। তিনি মনে করেন, আসলে এই সুবিধার কারণে অত্যন্ত নিম্ন ‘কর প্রদান-সদিচ্ছা’ ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স সৃষ্টি হওয়ায় সরকারেরও খুব বেশি ফায়দা হয় না। বরং এর ফলে সমাজের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে ভুল বার্তা দেওয়া হয় এবং দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের খারাপ ধারণা গেড়ে বসে।

নাসিরউদ্দিন দেখিয়েছেন যে ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) সেকশনে স্বপ্রণোদিত হয়ে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ‘প্রযোজ্য করহারে কর পরিশোধের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা প্রদান’ সুবিধার মাধ্যমে। ভারতে ২০১৭ সালের অবৈধ অর্থ ঘোষণা স্কিমে ৪৯ দশমিক ৯০ শতাংশ ‘কর, সারচার্জ এবং জরিমানা’ দিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশে শুধু ১০ শতাংশ কর পরিশোধ করে অবৈধ আয় বৈধকরণের বর্তমান ব্যবস্থা নৈতিকও নয়, আইনসম্মতও নয়, এটা ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের সরাসরি লঙ্ঘন। নাসির ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশটিরও যুগোপযোগী সংস্কারের কয়েকটি সুপারিশ করেছেন, যেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা এ কলামে অপ্রয়োজনীয়।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশের নিচে রয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ যথাযথ আয়কর সংগ্রহে সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা। আর এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ, দুর্নীতিলব্ধ অবৈধ আয়কে (অনুপার্জিত আয়) করজালের বাইরে রেখে দেওয়ার অভিপ্রায়ে প্রতিবছর কালোটাকা সাদা করার জন্য সরকারের এই অসাংবিধানিক বাজেট-ব্যবস্থা চালু রাখা। দক্ষিণ এশিয়ায় কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশেই সর্বনিম্ন। অর্থনীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নকে এহেন সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এ দেশের সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের দুর্বৃত্ত পোষণেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ, দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ শুধুই রাজনৈতিক বাত্-কা-বাত্। বিশ্বের যেসব দেশের সরকার এহেন দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি পরিত্যাগ করে সত্যিকার জনবান্ধব শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা নিয়ে দুর্নীতি দমনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেসব দেশ ক্রমেই উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় চমৎকার নজির সৃষ্টি করতে সমর্থ হচ্ছে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আয়করকে সরকারের কর-রাজস্বের প্রধান সূত্রে পরিণত করতে হলে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার ব্যবস্থার মাধ্যমে কালোটাকাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের বর্তমান নীতি সরকারকে পরিত্যাগ করতে হবে। কালোটাকার মালিক শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে তার অবৈধ আয়কে বৈধ করতে সমর্থ হলে সৎ করদাতা হয়ে ১৫-২০-২৫ শতাংশ আয়কর প্রদান তো আহাম্মকি! কালোটাকার একটি ক্ষুদ্রাংশের জন্য ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুরো অবৈধ আয়ের জন্য যদি আইনি বৈধতার সার্টিফিকেট অর্জন করা যায়, তাহলে ওই সব কাগজপত্র নিজের কাছে রেখে বছরের পর বছর কালোটাকার পাহাড় গড়তে থাকলে সরকার কীভাবে তা ঠেকাবে?

বাংলাদেশে যে কয়েক শ ধনকুবের পয়দা হয়েছেন, তাঁদের কতজন এক কোটি টাকার বেশি আয়কর দেন? ‘হাকিম জর্দার’ মালিক বছরের পর বছর এ দেশের সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী হচ্ছেন, ওয়েলথ-এক্সের গবেষণায় যে ২৫৫ জন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর (কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫৫ কোটি টাকার মালিক) নাম উঠে এসেছে, তাঁদের নাম তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এই কালোটাকার মালিকেরাই দেশ থেকে পুঁজি পাচারের প্রধান হোতা। সরকার যদি মনে করে, কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থার কারণেই দেশে বিনিয়োগের জোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে, তাহলে মারাত্মক ভুল হবে। দুর্নীতিকে লালন করার পরিবর্তে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে সরকারি রাজস্বের প্রধান সূত্র হিসেবে আয়করকে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে প্রতিবছর যে ক্রমবর্ধমান সরকারি রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর বিপজ্জনক নির্ভরশীলতার দুষ্টচক্রে সরকারকে আটকে থাকতে হচ্ছে, তা থেকে সরকার নিষ্কৃতি পাবে।

l মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়