স্মরণবেলায় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান

গণ–অভ্যুত্থানের সেই সব উত্তাল দিন, ১৯৬৯। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে ঢাকায় আসি আটষট্টির শেষের দিকে। এ বছরের নভেম্বর থেকে গণ–আন্দোলনভিত্তিক সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। এই আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করার সুযোগ ছিল না। ঢাকা তখন আমার কাছে অচেনা-অজানা শহর। রাস্তাঘাটও ঠিকমতো চিনতাম না। আমরা থাকতাম এলিফ্যান্ট রোডে। স্লোগান শুনলে বেরিয়ে আসতাম রাস্তায়। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখি। কয়েকটি পত্রিকা কিনে খুঁটিয়ে পড়ে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। যতবার নির্বাচন করেছি, ততবার ভোটে জিতেছি। মন্নুজান হলে থাকতাম না, কিন্তু সেই হলের সাধারণ সম্পাদক পদেও জিতেছি। মাথায় রাজনীতির চরকা ঘুরপাক খেত।

নভেম্বরের ৩ তারিখে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি সরকারের তীব্র সমালোচনা করে এক উত্তেজক ভাষণে জনগণকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন। নভেম্বরের ১৮ তারিখে ঢাকার আইনজীবীরা সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে রাজপথে নামেন। প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনসহ সেই মিছিলে শেষ পর্যন্ত পথচারীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। পত্রিকায় এই খবর পড়ে খুশিতে অনুপ্রাণিত হই। গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আন্দোলনকে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে—এই প্রত্যাশা ধারণ করি নিজের সাহসের সঙ্গে।

প্রতিদিন সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে মিটিং মিছিল হচ্ছে চারদিকে। পত্রিকার পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হই। চিরচেনা বর্ণমালা কখনো কখনো অস্পষ্ট হয়ে যায়। নিজের ক্রোধ ও উত্তেজনা শূন্য ঘরে বয়ে যায় স্রোতের মতো। যেন সব নদীতে জোয়ার এসেছে। শুধু মনে হয় এসব মিছিলে আমিও আছি। আমি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা মাথায় নিয়ে হাঁটছি। শুধু তিনি এখন জেলে। উনসত্তরের গণ–আন্দোলন তাঁর মুক্তির বার্তার একটি বড় দিক।

পত্রিকার পৃষ্ঠায় পড়ি পুরো দেশের খবর। সকালের আলো ফুটে ওঠার আগেই পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। জেনেছি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে হত্যা করা হয়। পল্টনে লক্ষাধিক লোকের জনসভায় মাওলানা ভাসানী সার্জেন্ট জহুরুল হকের গায়েবানা জানাজা পরিচালনা করেন। তিনি তাঁর ভাষণে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘দুই মাসের মধ্যে ১১ দফা কায়েম এবং রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া না হইলে খাজনা বন্ধ করা হইবে।’ তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন হলে জেলখানা ভেঙে মুজিবকে নিয়ে আসবেন। ওই দিনই প্রেসিডেন্ট সারা দেশ থেকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করেন।

১৯৬৯ সালে ৪ জানুয়ারি ডাকসু কার্যালয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের 

এক অংশ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করে। শুরু হয় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি।

৮ জানুয়ারি আট দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে সম্মিলিত বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ বা ‘ডাক’ গঠিত হয়। এই দিনে সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ৮টি বিরোধী দলের ঐক্যফ্রন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে।

গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর। ছবি: সংগৃহীত
গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর। ছবি: সংগৃহীত

দেশব্যাপী দেয়ালের লিখন ছিল, ‘জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব।’ এই প্রতিজ্ঞা পূরণের পথে এগোতে থাকে ১৯৬৯ সালের পূর্ব বাংলা। ২০ জানুয়ারি ছিল উনসত্তরের গণ–আন্দোলনের মাইলস্টোন। এই তারিখের ঘটনায় বদলে যায় আন্দোলনের চরিত্র এবং এই আন্দোলন দ্রুত ইপিআরের জুলুমের প্রতিবাদে এবং ১১ দফা দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় যে ছাত্রসভা আহ্বান করা হয়, সেখানে হাজার হাজার ছাত্র লাঠি নিয়ে উপস্থিত হন। শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে গিয়ে মিছিল রশীদ বিল্ডিং অতিক্রম করার সময় পুলিশ বাধা দেয় এবং অতর্কিতে গুলি ছোড়ে। ঘটনাস্থলেই ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) অন্যতম নেতা আসাদুজ্জামান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।


মুহূর্তে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ ধারণ করে।

একদিকে শোক, অন্যদিকে বারুদ। ছাত্রসমাজের ঊর্ধ্বমুখী বজ্রমুঠিতে শপথের উচ্চারণ।

ছাত্ররা শহীদ আসাদের লাশসহ মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করতে চান, কিন্তু পারে না।

পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্ডন করে রাখে। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ তিন দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করে।

কর্মসূচিতে ছিল ২১ জানুয়ারি হরতাল, ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল ও ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল।

পরে কালো পতাকাসহ বিশাল শোক মিছিল নগ্নপদে শহর প্রদক্ষিণ করে।

২৪ তারিখে ঢাকা শহরে যে ঘটনা ঘটে, তা ছিল অসাধারণ, অভূতপূর্ব। এ কারণে এ দিনটিকে পরবর্তী সময়ে ‘গণ–অভ্যুত্থান’ দিবস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মানুষের ঢল প্লাবিত করে ফেলে রাজপথ, গণজাগরণের উত্তুঙ্গ জোয়ার।

পুলিশ, ইপিআর কুলোতে পারে না। গুলিবর্ষণ করে সেনাবাহিনী। সচিবালয়ের সামনে প্রথমে মৃত্যুবরণ করেন রুস্তুম। পরবর্তী পর্যায়ের গুলিতে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর।

সমগ্র নগরী বিক্ষোভে কাঁপে। দুপুরে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। সেখান থেকে মিছিল এসে জমায়েত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে।

এই জমায়েতে বক্তৃতাকালে শহীদ মতিউরের বাবা বলেন, ‘এক মতিউরকে হারিয়ে আজ আমি হাজার মতিউরকে পেয়েছি।

’ সে তারিখে সেনাবাহিনী আদমজীনগরে ও নারায়ণগঞ্জে গুলিবর্ষণ করে।

খুলনার দৌলতপুর ও খালিশপুর এলাকায় গুলিবর্ষণ করলে তিনজন নিহত ও বহু আহত হন।

সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেনাবাহিনী তলব করা হয় ও সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।

১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখে যিনি বিশ্বকবি হয়েছেন।

আমরা এ ব্যবস্থা মানি না—আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এ দেশে গীত হবেই।’ তিনি নিজের সাংস্কৃতিক বোধ থেকে রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির মাত্রা যুক্ত করেছেন।

পত্রিকায় পৃষ্ঠা থেকে এই খবর জেনে উৎফুল্ল হই। ভাবী, এবার রসাতলে পৌঁছাবে পাকিস্তানের সামরিক শাসন।