সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো আরেকজন মানুষ কই?
গতকাল প্রয়াত হয়েছেন লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ আমার শিয়রের কাছে থাকেন। রয়ে যাবেন। তাঁর লেখা মাওলানা ভাসানীর বিশাল জীবনীগ্রন্থটি আমার জন্য নিত্যব্যবহার্য। কারণ, আমি বাংলাদেশের গড়ে ওঠার ইতিহাস নিয়ে উপন্যাসধারা লিখে চলেছি—লিখে চলেছি তাঁদের নিয়ে, যাঁরা ভোর এনে দিয়েছিলেন আমাদের। সে যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ‘ফায়ার ইটিং’ মাওলানা। মাওলানা ভাসানী। আর তাঁকে জানতে হলে সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম পাঠ্য। একই কারণে সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’ বইখানিও আমার নিত্যপাঠ্য।
মনে আছে, সৈয়দ আবুল মকসুদ মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে বই লিখছেন। কীভাবে লিখছেন, তা নিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে হবে। আমি তখন কাজ করি ‘ভোরের কাগজ’-এ। আমাকেই অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হলো, লেখকের বাড়ি গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে আসার। তিনি তখন থাকতেন এলিফ্যান্ট রোডে। জাহানারা ইমামের বাড়ির উল্টো দিকে ছিল সেই বাসা। আমি তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে এসেছিলাম।
তিনি বাসস–এর চাকরি ছাড়লেন। প্রতিবাদ হিসেবেই। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে কড়া লেখা লিখেছিলেন। ‘প্রথম আলো’য়, ২০০৪ সালের মার্চ মাসে। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলাকে ‘ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। শিরোনামেই ছিল ‘ফ্যাসিবাদ’। এটা তৎকালীন সরকার পছন্দ করল না। বাসস থেকে তাঁকে উপদেশ দেওয়া হলো, এই ধরনের কলাম না লেখার জন্য। তিনি বাসস–এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন হয়ে গেলেন। ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে শার্ট-প্যান্ট ছাড়লেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরা কাপড় পরেন। আমাদের কালের গান্ধী তিনি। গান্ধী আবার সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণারও একটা প্রিয় বিষয়।
নিজের সেলাইবিহীন পোশাক পরা নিয়ে তিনি নিজেই রসিকতা করতেন। আমাদের অফিসে এসে বলতেন, ‘শোনেন, সেদিন দেখি, দুই লোক রাস্তায় ঝগড়া করছে। আমি আর এগিয়ে যেতে পারলাম না তাদের থামানোর জন্য। কারণ, বোঝেনই তো নিজে লুঙ্গি পরা থাকলে অন্যের ঝগড়া–মারামারি থামাতে যেতে হয় না।’
আমি একটা কবিতায় লিখেছিলাম, ফরহাদ মজহারের জটিল লুঙ্গি আর সৈয়দ আবুল মকসুদের সরল লুঙ্গি। তিনি কথাটা পছন্দ করেছিলেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের জীবনীসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় নাম। তাঁর লেখা ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য’, ‘স্যার ফিলিপ হার্টগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য’, ‘ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু’, ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’, ‘পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রন্নেসা খাতুন’, ‘নবাব সলিমুল্লাহ ও তাঁর সময়’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ প্রভৃতি বইয়ে তাঁর গভীর অভিনিবেশ, পরিশ্রম ও মননশীলতার পরিচয় ধরে আছে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন একজন অ্যাকটিভিস্ট। রামুতে বৌদ্ধ স্থাপনার হামলার প্রতিবাদে তিনি মিছিল করেছেন, সড়কে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন, পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলন করতেন, নদী ও বন রক্ষার জন্য রাস্তায় নামতেন। এমন হয়েছে, কখনো তিনি একাই দাঁড়িয়েছেন রাস্তায়।
‘প্রথম আলো’তে নিয়মিত কলাম লিখতেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। ‘সহজিয়া কড়চা’ আর ‘বাঘা তেঁতুল’ নামে। তাঁর কাছ থেকে আমরা শিখলাম, কলাম শুধু লিখলেই হয় না। সরস করে লিখতে হয়। ভাষাটা যেমন সুন্দর হতে হয়, বলার ভঙ্গিটাও হওয়া চাই আকর্ষণীয়। আর তাতে একটু তথ্য থাকতে হয়, ইতিহাসের উল্লেখ রাখলে ব্যাপারটা আরও ঋদ্ধ হয়। তাঁর কলাম বেরোত মঙ্গলবারে। একেকটা লেখা বেরোত, আর নড়ে উঠত সারা দেশ। তো তিনি কলাম লিখতেন মঙ্গলবারে, আমিও কলাম লিখতাম মঙ্গলবারে। আমার কলামের নাম ‘অরণ্যে রোদন’ আর ‘গদ্যকার্টুন’। আমরা ছিলাম জোটবদ্ধ। আমরা ছিলাম জুটির মতো। মঙ্গলবারে দুজনেরই লেখা বেরোত। তিনি আমাকে ফোন করতেন মঙ্গলবারে। ‘আনিস, এইটা ভালোই লিখেছেন।’ আমি বলতাম, আরে আপনারটার তো তুলনা হয় না। তিনি খুশি হতেন। বলতেন, ‘পাঠকের ফোন পাচ্ছি, বুঝলেন। আসলে আমরা সাহিত্যিক তো!’
পরে আমি শুক্রবারে সরে গেলাম। মঙ্গলবারে রইলেন মকসুদ ভাই।
বুকের মধ্যে হাহাকার। বাংলাদেশ মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যার পর গত এক বছরে আমরা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গুণী ও প্রিয়জনকে হারালাম। আমরা বলি বটে যে এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়, কিন্তু কথাটার মানে এখন বুঝছি মর্মে মর্মে। ঢাকা শহরে সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো মানুষ আরেকজন দেখান তো, যিনি সৎ, সুলেখক, প্রতিবাদী ও অ্যাকটিভিস্ট; যিনি সেই যে সেলাইছাড়া কাপড় পরা শুরু করলেন, এবং কবরে পর্যন্ত সেই কাপড়ই পরে রইলেন।
আমরা দুজন প্রায়ই প্রথমার বইমেলা উদ্বোধন করতে যেতাম। আমাদের দুজনের নতুন স্লোগান ছিল, বই পড়তে হবে না, বই কিনুন। বই কিনলে একদিন না একদিন কাজে লাগে। আমি বহু বই কিনে রেখেছি, পড়ি না, কিন্তু কোনো একদিন তাক থেকে নামাতে হয়, কাজে লাগে, পড়ি। আর আপনি যদি না পড়েন, আপনার বাসার লোকজন পড়বে। যদি কেউ না-ও পড়ে, তখন একটা লাইব্রেরিতে দান করে যাবেন। তবুও বই কিনুন।
আরও একটা জোড়া ছিল আমাদের। আমরা দুজন একই পাড়ায় থাকি। তাঁর ‘প্রথম আলো’তে যাওয়ার দরকার পড়লে তিনি আমাকে ফোন দিতেন, ‘আনিস, কয়টায় যাবেন?’
আমি বলতাম, এই এগারোটায়।
তিনি বলতেন, ‘তাহলে আমাকে নিয়ে যান।’
আমরা এক গাড়িতে যেতাম। আমাদের সেই জুটি ভেঙে গেল। বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো এই খবর। অসুখের খবর না, বিসুখের খবর না, সরাসরি মৃত্যুর খবর।
আমিও এইভাবে মরতে চাই। টুপ করে ঝরে পড়ব। কেউ বিরক্তি বোধ করার আগেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ ভাই, আপনার বিদায়ের খবর এখনো মেনে নিতে পারছি না।
বুকের মধ্যে হাহাকার। বাংলাদেশ মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যার পর গত এক বছরে আমরা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গুণী ও প্রিয়জনকে হারালাম।
আমরা বলি বটে যে এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়, কিন্তু কথাটার মানে এখন বুঝছি মর্মে মর্মে।
ঢাকা শহরে সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো মানুষ আরেকজন দেখান তো, যিনি সৎ, সুলেখক, প্রতিবাদী ও অ্যাকটিভিস্ট; যিনি সেই যে সেলাইছাড়া কাপড় পরা শুরু করলেন, এবং কবরে পর্যন্ত সেই কাপড়ই পরে রইলেন।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]