সৈয়দ আবুল মকসুদের অন্বেষণ
এপ্রিল ১৯৯৪, বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দে আমার পিতা সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর জীবনের প্রথম প্রচারাভিযান শুরু করেন। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘দেশ পরিক্রমা’। এ উপলক্ষে তিনি একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। সেই প্রচারপত্রে তাঁর কাজের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আজ বঙ্গমাতা অসহায়, তার দুর্দশার অন্ত নেই। চির সবুজ বাংলা আজ ধূসরতায় আচ্ছাদিত। সে তার সন্তানদের সেবা থেকে বঞ্চিত দীর্ঘকাল।... দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পরে দেশে অসংখ্য পত্রপত্রিকা বেরিয়েছে, সেগুলোতে জাতীয় সমস্যা নিয়ে লেখালেখি ও সমালোচনা প্রচুর হচ্ছে, কিন্তু কাজ হয় খুবই কম। ভালো কথা ও উপদেশ অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে, বিপুল অধিকাংশ নিরক্ষর ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষ অন্তহীন অন্ধকারে পড়ে রয়েছে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার জীবাণু কুষ্ঠের চেয়েও ভয়াবহ, যা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী, মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণের পথে যা এক মারাত্মক অন্তরায়। বাঙালির মধ্যেও তা সংক্রমিত হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের সকল মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে পারস্পরিক সম্প্রীতির ওপর। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান প্রভৃতি সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের বন্ধন শক্তিশালী করতে হবে। বাঙালি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এ দেশে রয়েছে প্রায় তিরিশটির মতো ক্ষুদ্র সম্প্রদায়। তারাও এদেশের অধিবাসী— দেশকে তাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের জীবনের চেয়ে বেশি। গারো, হাজং, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, মুরং, খাসিয়া, লুসাই, ত্রিপুরা, বম, উরাও, কোচ, হাদি, ডালু, পাহাড়ি, মাল পাহাড়ি, মালো, মনিপুরী, তঞ্চঙ্গা, শিং, পাথর প্রভৃতি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠদের সম্পর্ক হওয়া উচিত অবাধ ও গভীর হৃদ্যতার।’
এরপর তিনি বলেছেন তাঁর কর্মপরিকল্পনা, ‘প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা চিরকালই রয়েছে, কিন্তু সমাজসংস্কারে বা সেবায় ব্যক্তির ভূমিকা যত অল্পই হোক, তার মূল্য অশেষ। ছোট ছোট কল্যাণকর্মের কোনো বিকল্প নেই। ছোট কাজের যোগফলে বিরাট কাজ সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের মানুষের বা মানবজাতির কোনো বৃহত্তর কল্যাণ আমার দ্বারা হবে না। তাই আমি আমার সীমিত শক্তি নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ করতে উদ্যোগ নিয়েছি দেশ পরিক্রমার। ধনবল আমার সীমিত। শারীরিক সামর্থ্যও অল্প। শুধু মনের জোর আমার পুঁজি। শৈশব থেকে সামান্য সাহিত্যচর্চা করছি। এ ক্ষেত্রে কিছু কাজ করেছি। কিন্তু আজ আমি আমার জীবনের এই পর্যায়ে এসে, মধ্য চল্লিশের পর, সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শুধু লেখালেখির মাধ্যমে নয়, হেঁটে হেঁটে, সাইকেলে চড়ে, নৌকায় বা লঞ্চ-ইস্টিমার, ট্রেনে ঘুরে ঘুরে দেশের বিশেষ করে গ্রামের মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলব। তাঁদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে শিক্ষা, পরিবেশ, সংস্কৃতি, পরিবার পরিকল্পনা প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁদের অনুপ্রাণিত করব। দেশের সাধারণ মানুষকে তাঁদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলব। পুরাকীর্তি, স্থাপত্য যেমন প্রাচীন মন্দির মসজিদ, বিহার, গির্জা, মঠ, অতীতের নানা প্রতিষ্ঠান ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের বাসস্থান ব্যবহার্যদ্রব্য রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উৎসাহিত করব, তৈরি করব সেগুলোর তালিকা। বাঙালির ও এ দেশের অন্যন্য ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় তা সরবরাহ করবে উপাদান। ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারমুক্ত হওয়ার জন্য তাঁদের পরামর্শ দেওয়া হবে।...সর্বোপরি আমার ‘দেশ পরিক্রমা’র লক্ষ্য— দেশবাসীর মধ্যে সম্প্রীতি জাগ্রত করা, জাতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে উদ্যোগ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা।’
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ সম্পর্কে অবহিত যে কেউ স্বীকার করবেন, তাঁর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ছিল অভিনব ও অনন্য। নিজের দেশ, দেশের মানুষ আর দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকলে একজন মানুষ সম্পূর্ণ নিজ খরচে এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। সেই সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় কর্মরত, তাই সাংবাদিকতার ফাঁকে ফাঁকে তাঁকে এই কাজ করতে হতো। মনে আছে, তিনি চষে বেরিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন, সেসব অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাস সংস্কৃতির উপাদান সংগ্রহ করেছেন আর এই ভাবেই তিনি যেমন নিজে সমৃদ্ধ হয়েছেন, তেমন নিজেকে প্রসারিত করেছেন দেশের মানুষের মধ্যে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ সম্পর্কে যাঁরা কিছুটা আগ্রহ রাখেন, তাঁরা তাঁর ইরাকে ইঙ্গ–মার্কিন হামলার প্রতিবাদে আরম্ভ করা সত্যাগ্রহ সম্পর্কে জানেন। বিশেষ করে এই সময় থেকে (এপ্রিল, ২০০৩) তাঁর সাদা লুঙ্গি–চাদর পরিধান করা অনেকের কাছেই কৌতূহলউদ্দীপক মনে হয়েছে। কিন্তু নব্বই দশকের মাঝামাঝি তাঁর ‘দেশ পরিক্রমা’ সম্পর্কে খুব কম মানুষই আজকাল অবগত আছেন।
দুই.
যে সব অভিধায় সৈয়দ আবুল মকসুদ জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ‘গবেষক’। একজন গবেষক হিসেবে তাঁর আগ্রহের পরিধি ব্যাপ্ত ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। একদিকে যেমন লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ আধুনিক সাহিত্যিকদের নিয়ে, অন্যদিকে আলোকপাত করেছেন গোবিন্দচন্দ্র দাশের মতো ইদানীং অপেক্ষাকৃত অজনপ্রিয় কবি নিয়ে। মওলানা ভাসানীর মতো গণমানুষের কাতার থেকে উঠে আসা জননেতাকে নিয়ে যেমন লিখেছেন আঁকর গ্রন্থ, ঠিক তেমনি এই বঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর কার্যক্রম নিয়ে করেছেন মৌলিক গবেষণা। তিনিই প্রথম গ্রন্থ রচনা করেছেন পথিকৃৎ বাঙালি নারীবাদী খায়রন্নেসা খাতুন ও পূর্ববঙ্গের সাময়িক পত্রের পথিকৃৎ হরিশচন্দ্র মিত্রের ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লিখতে গিয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই অঞ্চলের মধ্যশ্রেণি বিকাশের গভীর সম্পর্ক। তাঁর কোনো গ্রন্থই শুধু প্রাথমিক সূত্র থেকে ছেঁকে আনা তথ্যের সমাহার নয়, বরং তা সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্তক্রিয়ার বিশ্লেষণে উজ্জ্বল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তার একটি বড় অংশজুড়ে ছিলেন; তাঁর রবীন্দ্রচর্চা বুদ্ধি–যুক্তির সমাবেশে নিরাবেগ বোঝাপড়া, এতে ভক্তিগদগদ আত্মসমর্পণ একেবারেই অনুপস্থিত। তাঁর জীবনের শেষ ২৫ বছর তিনি নজরুলের ওপর বিস্তৃত গবেষণা করেছেন। পরিতাপের বিষয় এই, তিনি তা শেষ করে যেতে পারলেন না।
নিজেকে সম্পূর্ণ রিক্ত করে সাহিত্যের ভুবনকে সমৃদ্ধ করার দুর্লভ অধ্যবসায় দেখেছি তাঁর মধ্যে। এটাই তাঁর জীবন, এটাই তাঁর অস্তিত্ত্বের একটি অঙ্গ।
সমাজজীবনে একজন লেখকের যে দায়িত্ব, তা সৈয়দ আবুল মকসুদ বরাবর পালন করে এসেছেন। নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের যন্ত্রণায় তিনি কাতর হয়েছেন, চঞ্চল হয়েছেন, নিজেকে অন্বেষণ করেছেন মানুষের দুঃখ–যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। মানুষের দুঃখ–যন্ত্রণায় তিনি এমনই অভিভূত হয়েছেন, এমনভাবে তাঁর মন নাড়া দিয়েছে, তিনি শুধু লিখেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি, ছুটে গেছেন বঞ্চিত মানুষের পাশে। তাঁদের মুখ থেকে শুনেছেন সব হারানোর আহাজারি। এ জন্য তিনি ছুটে গেছেন নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিন্দুদের কাছে, বঞ্চিত আদিবাসী গ্রামে, দেশহীন বিহারিদের ক্যাম্পে অথবা মৌলবাদীদের আক্রমণে বিধ্বস্ত বৌদ্ধমন্দিরে। মানুষের ক্রন্দন শোনার জন্য এমন কান পেতে থাকা বুদ্ধিজীবী আমাদের সমাজে নিতান্তই বিরল।
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময়ে কী সাহিত্য, কী সাংবাদিকতা, যা-ই তিনি করেছেন, সবক্ষেত্রেই মনুষ্যত্বের সংগ্রামের জন্য সব সময় বিচলিত থেকেছেন। আমি দেখেছি, তিনি তাঁর আদর্শ ও নির্দিষ্ট পথ থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি। মানুষ হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় এখানেই।
সমাজে যেখানেই তিনি লক্ষ করেছেন মিথ্যার আশ্রয়, কারচুপি, প্রবঞ্চনা সেখানেই তাঁর অন্তর গুমরে উঠেছে বিদ্রোহে। এমন হৃদয়বান, শুদ্ধপ্রাণ প্রতিবাদী সত্তা যেকোনো সমাজের অন্তর্জগতের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করে। তিনি মনে করতেন সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে আমরা যেন সেই শুদ্ধতায় পৌঁছাই, যে শুদ্ধতা মানুষ হিসেবে মানুষের জীবনকে পবিত্র করে, সমাজকে পবিত্র করে। সেই পবিত্রতাই তিনি চিরকাল অন্বেষণ করে এসেছেন। তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল সেই শুদ্ধতায় হোক মানুষের উত্তরণ।
সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সৃষ্টি কতটা প্রসাদগুণসম্পন্ন, চিন্তাবিদ হিসেবে রাজনীতি-সমাজ-ইতিহাস নিয়ে তাঁর মতামত কতটা প্রণিধানযোগ্য অথবা একজন গবেষক হিসেবে গবেষণার সূত্রসমূহ কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করেছিলেন অথবা কী কী করেননি, সেই বিতর্ক করে কিছু লাভ নেই; দেখতে হবে তিনি তাঁর স্বদেশ, দেশের মানুষ, মানুষের অধিকার সম্বন্ধে কতটা সচেতন ছিলেন, তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলেন কি না, তিনি ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন কি না, জীবনের মোহের কাছে পরাজিত ছিলেন কি না—এই একটি মাত্র সূত্র যদি আমরা বিচার করি এবং মনে রাখি, তাহলে দেখতে পাব আজীবন সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর স্বদেশকে অন্বেষণ করেছেন, সারা জীবন দেশের মানুষের মনুষ্যত্বকে অন্বেষণ করেছেন। আর এ কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশের আপামর জনসাধারণের শ্রদ্ধার ব্যক্তিত্ব, আস্থার মানুষ।