বাংলা কবিতায় সুফিয়া কামালের আবির্ভাব ঘটে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের শেষ দিকে। সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন তাঁর আত্মকথায় জানাচ্ছেন, বাংলা ১৩৩৩ সালের ফাল্গুন মাসে তাঁর হাতে একটি কবিতা আসে। কবির নাম সুফিয়া এন হোসেন। কবিতাটি আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা ছিল। পাঠোদ্ধার করাই মুশকিল। একটানা লেখা। দাঁড়ি-কমার ঠিকঠিকানা নেই। নাসিরউদ্দীন কবিতাটি তিন–চারবার পড়লেন। দাঁড়ি-কমা ঠিক করলেন। লাইনও ঠিক করে দিলেন। এমনকি নামহীন কবিতাটির নামকরণও করলেন ‘বাসন্তী’ বলে। নাসিরউদ্দীন বলেছেন, এরপর কবিতাটি আবার পড়ে দেখলাম। এবার ভালো লাগল। এর আগেও বরিশালের দু-একটা স্থানীয় পত্রিকায় সুফিয়া এন হোসেনের ছিটেছাঁটা কবিতা ছাপা হয়েছে। সেগুলো তেমন কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু সওগাত–এ এই কবিতা প্রকাশের পর কলকাতায় অনেকেই কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছেন, কে এই সুফিয়া এন হোসেন? সওগাত–এর পাতায় পরপর কয়েক সংখ্যায় কবিতা ছাপা হতে থাকলে সুফিয়া পরিচিত হয়ে ওঠেন কবি হিসেবে। এই সুফিয়া এন হোসেনই উত্তরকালের সুফিয়া কামাল।
আধুনিক বাংলা কবিতার বড় পটে রেখে বিচার করলে দেখা যাবে, সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে তত বড় নন। বাংলা কবিতাকে তিনি বড় কোনো মৌলিক অবদানেও সমৃদ্ধ করেননি। যে ধরনের রোমান্টিক ভাবাবেগের কবিতা দিয়ে সুফিয়া কামাল বাংলা কবিতার ভূগোলে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সেই প্রকৃতিলগ্ন তীব্র আবেগ আর ভাবকল্পনার স্নিগ্ধ কবিতার পাঠ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক আগেই চুকিয়ে এসেছেন। ইতিমধ্যে আশ্চর্য আবেগে কাঁপা রোমান্টিক প্রেমে ঠাসা নজরুলের অধিকাংশ কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়ে গেছে। শুধু তা–ই নয়, বাংলা কবিতা ইতিমধ্যে পা ফেলেছে রবীন্দ্রোত্তর যুগে। পাঠককে নতুন ধরণের কবিতার অভিজ্ঞতা দিতে শুরু করেছেন রবীন্দ্রোত্তর যুগের আধুনিকতাবাদী কবিরা। তার মানে সুফিয়া কামালের আবির্ভাব এবং ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তাঁর সাঁঝের মায়া কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতার পাঠকের জন্য নতুন কোনো স্বাদ–গন্ধের বারতা বয়ে নিয়ে আসেনি।
তবু সুফিয়া কামালের কবিতা চারদিকে ব্যাপক প্রসংশা কুড়িয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলাম সাঁঝের মায়া বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবিতার বইটি উপহার হিসেবে পাঠালে তিনি পড়ে প্রীত হন এবং কবিকে আশীর্বাদপত্র পাঠান। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বরাবর তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন। আর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁকে ডাকা শুরু করেন ‘ফুল কবি’ মানে পুরোদস্তুর কবি। কিন্তু এর কারণটা কী? এই কারণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সুফিয়া কামালের বিশেষত্ব ও মাহাত্ম্য।
সুফিয়া কামাল যে সময় বাংলা কবিতার জগতে পা রাখেন, তখন আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নারী কবি তেমন ছিলেন না। আর মুসলমান সমাজে তো আরও বিরল। নজরুল যখন সুফিয়া কামাল সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন, তখন বারবার এ কথা বলতে ভুলছেন না যে ওই বিশের দশকে বাঙালি মুসলমান নারীর ‘হেরেমে বন্দিনী’ দশা পার করার সময়। নজরুল সাঁঝের মায়া কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখছেন, ‘কয়েক বৎসর আগেকার কথা। কল্যাণীয়া কবি সুফিয়া এন হোসেন তখন হেরেমের বন্দিনী বালিকা।
তাঁর স্বর্গত স্বামী আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু সৈয়দ নেহাল হোসেন সাহেব আমায় কয়েকটি কবিতা দেখতে দিলেন। আমার বিশ্বাস হলো না যে, সে কবিতা কোনো মুসলিম বালিকার লেখা।’ নজরুল মনে করেছেন, এই কবিতাগুলি ‘বদ্ধ বুলবুলের অবগুণ্ঠনের বাধা অতিক্রম করে দিগ্দিগন্তে ধ্বনিত’ হয়েছে। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনও বলেছেন, সুফিয়া কামাল যখন বাংলা কাব্যের জগতে প্রবেশ করেছেন, ‘তখন বাংলার মুসলমান সমাজে উল্লেখযোগ্য মহিলা কবি ছিলেন না বললেই চলে।’
আদতে সুফিয়া কামাল এমন একটি সময়ে কবিতা লেখায় হাত দিয়েছিলেন, যখন তাঁর মতো বাঙালি অভিজাত মুসলিম পরিবারে বাংলা ভাষার চর্চা একেবারেই নিষিদ্ধ। উর্দুই তাঁদের শিক্ষা ও মুখের ভাষা। এ তো গেল ভাষার দিক। আরও দিক আছে। একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব-অনুভূতি প্রকাশের প্রশ্ন তখনই ওঠে, যখন ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যক্তিত্ব দানা বেঁধে ওঠে। বুর্জোয়া বিকাশের সঙ্গে ব্যক্তির মনোতলের একান্ত অনুভূতি প্রকাশের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। বাঙালি মুসলমান সমাজে এই ঘটনা তখনো পুরোপুরি ঘটেনি। নারীর মধ্যে তো আরও ঘটেনি। এ রকম একটা বাস্তবতার মধ্যে সুফিয়া কামাল নির্দ্বিধায় একটা জুতসই ভাষায় নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছিলেন। ফলে তিনি সমকালীন কাব্যভোক্তাদের মধ্যে রীতিমতো একটা বিস্ময় উৎপাদন করেছিলেন। তিনি চিহ্নিত হয়েছিলেন ওই কালের প্রাগ্রসর নারী হিসেবে।
এদিক বিবেচনায় সুফিয়া কামাল ছিলেন বাঙালি মুসলমান নারী কবিকুলের মধ্যে ‘ভোরের পাখি’। কারণ, তখনো গীতিকবিতার গীতল ভাষা আর ছন্দের বাহারের মধ্যে কোনো বাঙালি মুসলমান নারী নিজের হৃদয়কে এভাবে মেলে ধরতে পারেননি।
সুফিয়া কামাল কলকাতায় রোকেয়া সাখাওয়াতের গভীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন (রোকেয়া সুফিয়ার মাকে ফুফু ডাকতেন)। শুধু রোকেয়ার সান্নিধ্য নয়, সুফিয়া কামালের ব্যক্তিগত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ছিল পাহাড়সমান। নারীর মুক্তির জন্য কাজ করার বাসনা তাই তাঁকে চিরকাল তৎপর রেখেছে। তিনি রাজনীতিসচেতন ছিলেন। পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন গভীরভাবে যুক্ত। দেশের যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমৃত্যু সক্রিয় থেকেছেন তিনি। এসবই তাঁকে আরও নতুন নতুন মাত্রায় উপস্থিত করেছে। কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা, তিনি বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে এসবেরও প্রায় ‘ভোরের পাখি’—সবার আগে জেগেছিলেন। তাই সুফিয়া কামালের উজ্জ্বলতা বাংলাদেশের বাঙালি নারীর ইতিহাসে এত বেশি।