সুধীর চক্রবর্তী: ‘একান্ত আপন’
গতকাল প্রয়াত হয়েছেন লোকসংস্কৃতি গবেষক ও লেখক সুধীর চক্রবর্তী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।
তাঁর সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি। আলাপ যা, তা কেবল ফোনেই। সে আলাপ ঘনিষ্ঠতায় ঠেকে বছর সাতেক আগে। এরপর কারণে-অকারণে নানা সময়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। কখনো–সখনো সে আলাপ দীর্ঘও হয়েছে। বাংলাদেশের বাসিন্দা হওয়ার কারণেই বোধ হয় আমার প্রতি তাঁর একটা অপত্যস্নেহ কাজ করত।
সেই তিনি চলে গেলেন গতকাল মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর ২০২০)। বলছিলাম কলকাতার মান্যবর লোকসংস্কৃতি গবেষক ও সংগীত বিশেষজ্ঞ সুধীর চক্রবর্তীর কথা। ১৯৩৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন ভারতের নদিয়া জেলার দিগনগরে। তবে ১৯৪২ সাল থেকে কৃষ্ণনগরের স্থায়ী বাসিন্দা হন। ছিয়াশি বছর পেরোনো সুধীর গতকাল আচমকাই ‘গভীর নির্জন পথে’র সন্ধানে অনন্তযাত্রায় পাড়ি জমান অনেকটা ‘নির্জনসজনে’।
দুই.
নানা স্বাদ আর ছাঁদের লেখা সুধীর চক্রবর্তী রচনা করেছেন। ‘গানের ভিতর দিয়ে’ যেমন যাপনের পরিপার্শ্বকে ছুঁতে চেয়েছেন, তেমনই ‘আখ্যানের খোঁজে’ ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রাম-গ্রামান্তর। মেঠোপথ-প্রান্তর পেরিয়ে ধুলা-কাদা আর রোদ-বৃষ্টি গায়ে মেখে মিশে গিয়েছেন ‘আকুল প্রাণের উৎসবে’। ফলে ‘অনেক দিনের অনেক কথা’ জমা হয়েছে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। সেসব লিখে গিয়েছেন তাঁর প্রকাশিত অন্তত পঞ্চাশটি বইয়ে। তাঁর বহুবিস্তৃত ছড়ানো জীবন ‘রূপে বর্ণে ছন্দে’ অনন্যতা পেয়েছে প্রতিটি লেখায়। তাঁর আখ্যান মানেই ‘শত শত গীতমুখরিত’ আর ‘সাহিত্যের লোকায়ত পাঠ’।
সুধীর চক্রবর্তী প্রায় সাড়ে ছয় দশক ধরে লোকায়ত বাংলার বিচিত্র পথ ধরে হেঁটেছেন। বাঙালির আবহমান বিপুল ও বিশাল ‘সংস্কৃতির লোকায়ন’ নতুন এক ভাষাশৈলীতে ‘বর্ণে বর্ণে পুষ্পে পর্ণে’ উদ্ভাসিত করেছেন। বিষয়টি মাথায় রেখেই হয়তো কবি জয় গোস্বামী লিখেছেন, ‘জীবনকে, সুধীর চক্রবর্তী দেখেছেন তার অজস্রতায়, বিচিত্রতায়। [. . . ] বহমান জীবনের অভিজ্ঞতাধারার ভেতরকার সত্য সুধীর চক্রবর্তী দেখিয়েছেন, তাঁর ভাষার আশ্চর্য স্বাচ্ছন্দ্যে, তাঁর সাংগীতিক বোধের সৌন্দর্যভাবনায় ও তাঁর জীবনদৃষ্টির গভীরতায়।’
‘জীবনদৃষ্টির গভীরতা’ সুধীর চক্রবর্তীর মধ্যে এতটাই প্রকটভাবে ছিল যে সেটা তাঁর প্রতিটি লেখা পাঠেই বিশেষভাবে ধরা পড়ত। প্রান্তিক মানুষের অন্দর–বাহির ও গভীর দার্শনিকতা আর সাধক-মহাজনদের রহস্যঘেরা নিভৃত জীবনের কড়চা তাঁর সমঝদারি ও সজীব গদ্যে স্বতন্ত্র চিহ্নায়ন তৈরি করেছে।
তিন.
সুধীর চক্রবর্তীর সামগ্রিক রচনাকে মোটামুটি পাঁচটি পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে। এর মধ্যে প্রথম ভাগে থাকবে বাউল-ফকির, গৌণধর্ম এবং লোকায়ত ধারার সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর নিবিষ্ট পর্যবেক্ষণ। দ্বিতীয় ভাগে রাখা যায় রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে তাঁর অনুভব ও ভাবনার বিস্তার। এরপরই থাকবে বাংলা গানের কালপর্ব ও নানা ধারা নিয়ে রচিত রচনাগুলো। চতুর্থ ভাগে কবিতা-গল্প-উপন্যাস বিষয়ে তাঁর লেখাগুলোকে ঠাঁই দেওয়া যায়। শেষ ভাগে, অর্থাৎ পঞ্চম পর্যায়ে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ ও পত্রিকাকে রাখা যায়।
‘লোকায়তের অন্য বাঁকে’ ঘুরতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী যে সহজিয়া পথ ও দিশার হদিস পেয়েছেন, তা যেমন রহস্যসংকুল, তেমনই ‘দেখা না-দেখায় মেশা’ অন্য আরেক ভুবন।
সে ভুবনের পথিক হয়ে ‘একাকী পায়ে হেঁটে, দু-দশক নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমান-কুষ্টিয়া-মেহেরপুরের গ্রামীণ পরিমণ্ডল ঢুঁড়ে, নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন ধারার লেখনীতে ধরেছেন সেই বিচিত্র ভুবনের অন্তর্গহন বাণী।’ সে ‘অন্তর্গহন বাণী’ময় লেখাগুলোর সমন্বয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘গভীর নির্জন পথে’ (১৯৮৯) নামের আলোচিত গ্রন্থটি। এ বই ‘বাংলার সমাজ–সংস্কৃতিচর্চার এক নতুন পথ, বাংলা গদ্যশৈলীরও এক নবনিরীক্ষা।’
‘গভীর নির্জন পথে’ বইয়ে ছয়টি লেখা ঠাঁই পেয়েছে। এসব লেখায় বাউল-ফকিরি মতবাদ, লৌকিক গৌণধর্ম, দেহসাধকদের গুহ্য ও নিগূঢ় সাধনপদ্ধতি আর জীবনযাপনের আখ্যান ‘জাদু-বাস্তবের ঢঙে’ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাংলার নানা উপাসক সম্প্রদায় এ বইয়ে বিস্তৃত পরিসরে উপস্থাপিত হয়েছে, যা এর আগে অন্য কোনো লেখকের দ্বারা হয়নি। এ বই ছাড়াও ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ (১৯৯২) নামে তাঁর একটি অতিবিখ্যাত বই রয়েছে। এ বইয়ের বিষয়বস্তু লালন সাঁই এবং তাঁর দর্শন। দুই বাংলার লালনবিষয়ক সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আকরগ্রন্থ হিসেবে এটিকেই বিবেচনা করে থাকেন বোদ্ধা মহল। এ ছাড়া তাঁর প্রকাশিত ‘কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প ও মৃৎশিল্পী সমাজ’ (১৯৮৫), ‘বাউল-ফকির কথা’ (২০০১), ‘বাংলার গৌণধর্ম: সাহেবধনী ও বলাহাড়ি’ (২০০৩), ‘উৎসবে মেলায় ইতিহাসে’ (২০০৪), ‘ঘরানা বাহিরানা’ (২০০৬), ‘আলালদোস্ত সেবাকমলিনী লালন’ (২০১১), ‘মানিনী রূপমতী কুবির গোঁসাই’সহ (২০১২) বেশ কিছু বই বাংলার লোকায়ত দর্শন ও সংস্কৃতি জানা-বোঝা-চর্চার জন্য অবশ্য পাঠ্য, অনন্য।
বহুতর বিষয়ে সুধীর চক্রবর্তীর মনোরম ও স্বাদু গদ্যের দুটি সুবৃহৎ সংকলন হচ্ছে ‘দেখা না-দেখায় মেশা’ (২০১২) এবং ‘অনেক দিনের অনেক কথা’ (২০১৩)। বাংলার নানা প্রান্তে চষে বেড়ানো সরেজমিন অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, সমাজ, সংস্কৃতি, দেশকাল ধরা পড়েছে তাঁর এ দুই বইয়ে। বাংলা গানের নানা ধারাকে পরিচিত করার পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতের অনেক অনুক্ত ঐশ্বর্যও ঠাঁই পেয়েছে তাঁর অনবদ্য সব রচনায়। লিখেছেন ‘নির্জন এককের গান রবীন্দ্রসঙ্গীত’ (১৯৯২), ‘রবীন্দ্রনাথ অনেকান্ত’ (২০১০), ‘রবিকররেখা’ (২০১৪) এবং ‘এলেম নতুন দেশে’ (২০১৯)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সব বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান বিষয়ে এসব বই বাংলা সাহিত্যের এক অপরিহার্য সংযোজন।
‘লোকায়তের অন্য বাঁকে’ ঘুরতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী যে সহজিয়া পথ ও দিশার হদিস পেয়েছেন, তা যেমন রহস্যসংকুল, তেমনই ‘দেখা না-দেখায় মেশা’ অন্য আরেক ভুবন। সে ভুবনের পথিক হয়ে ‘একাকী পায়ে হেঁটে, দু-দশক নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমান-কুষ্টিয়া-মেহেরপুরের গ্রামীণ পরিমণ্ডল ঢুঁড়ে, নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন ধারার লেখনীতে ধরেছেন সেই বিচিত্র ভুবনের অন্তর্গহন বাণী।’
আধুনিক গান থেকে শুরু করে ভারতীয় বাংলা গানের বিচিত্র সব বিষয়েই সুধীর চক্রবর্তীর কাজ রয়েছে। তাঁর সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা গান’ (১৯৮৭), ‘বাংলা দেহতত্ত্বের গান’ (১৯৯০), ‘বাংলার বাউল ফকির’ (১৯৯৯), ‘জনপদাবলি: ইহবাদী লোকায়ত মানবমুখী বাংলা গানের সংকলন’ (২০০১) এবং ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি সমগ্র’ (২০০৮) বাংলার নানামুখী গানের পরম্পরাগত ঐতিহ্যকেই প্রকাশ করেছে। একই পরম্পরা বহন করে চলেছে তাঁর ‘বাংলা গানের আলোকপর্ব’ (২০০১), ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: স্মরণ বিস্মরণ’ (২০০৮) এবং ‘আকুল প্রাণের উৎসবে’ (২০১৪) বইগুলোও। তাঁর ‘শতগানের গানমেলা’ (২০১৭) এবং ‘একশো গানের মর্মকথা’ (২০১৯) বই দুটিতে ২০০টি বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি গানের সৃষ্টি ও নির্মাণ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে তাৎপর্যপূর্ণ ও নিখুঁত পর্যবেক্ষণ উদ্ঘাটিত হয়েছে।
নানা ধরনের সংগীতের বিশ্লেষণ ছাড়াও সাহিত্যবিষয়ক বইও তাঁর রয়েছে। ‘কবিতার খোঁজে’, ‘কবিতার বিচিত্র পথে’ এবং ‘সাহিত্যের লোকায়ত পাঠ’ (২০১৩) নামে তাঁর আছে তিনটি বই। এখানেও সুধীরের লেখা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ও বিশিষ্ট। তাঁর ‘পঞ্চগ্রামের কড়চা’ (১৯৯৫) এবং ‘কৃষ্ণনাগরিকের কত কথা’ (২০১৭) বই দুটোতেও তাঁর অভিনব গদ্যের ঝলক রয়েছে। এ দুটো বইয়ে সুধীর চক্রবর্তী গ্রাম ও জনজীবন অপূর্ব ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর ‘একান্ত আপন’ (২০১২) এবং ‘দ্বিরালাপ: নির্বাচিত সাক্ষাৎকার’ (২০১৫) বই দুটো থেকে ব্যক্তি সুধীর চক্রবর্তীর মুখচ্ছদ আর স্মৃতিকথার বয়ান জানা যায়। এ দুটো বইয়ে সুধীরের চিন্তন-ভাবন-সৃজন আর ব্যক্তিজীবনের অনেকটাই ধরা আছে।
মৌলিক রচনার পাশাপাশি সম্পাদক হিসেবেও সুধীর চক্রবর্তী ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। তাঁর স্বতন্ত্র বীক্ষণে সুসম্পাদিত বার্ষিক সংকলন ‘ধ্রুপপদ’ সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানামুখী বিষয়কে আলোকিত করেছে। পত্রিকার ‘বাংলার বাউল ফকির’, ‘বুদ্ধিজীবীর নোটবই’, ‘যৌনতা ও সংস্কৃতি’, ‘গবেষণার অন্তরমহল’ সংখ্যাগুলো উৎসাহীদের কাছে ব্যাপক চাহিদা ছিল। মূলত অনুদ্ঘাটিত ভুবনের রূপ উদ্ঘাটনই ছিল সুধীর চক্রবর্তীর মূল লক্ষ্য এবং সেটা করেছেন একান্তই স্বতন্ত্ররীতির গদ্য রচনার মধ্য দিয়ে।
চার.
বার্ধক্যজনিত কারণে শরীরে নানা অসুখ বেঁধেছে, কিন্তু এভাবে হুটহাট সুধীর চক্রবর্তী দেহত্যাগ করবেন, সেটা কল্পনাতেও ছিল না। শেষবার যখন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়, তখন প্রথমা থেকে প্রকাশিত আমার ‘বাউলের আখড়ায় ফকিরের ডেরায়’ বইটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, সময়-সুযোগ করে বইটি নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া লিখতে চান। সে লেখা তাঁর হয়ে ওঠেনি, এ নিয়ে আমার ভেতরে কিছুটা আফসোস তো আছেই। তার চেয়েও বড় আফসোস, যে ব্যক্তি বাংলার মাটি-জল-বাতাস আর লোকায়ত ধারার মানুষকে বিশ্বের আকাশে রঙিনভাবে মূর্ত করেছিলেন, তাঁর পা ছুঁয়ে বলা হলো না, ‘আমরা আপনার প্রচণ্ড অনুরাগী, একান্ত আপন।’
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]