সাত কিশোরীর লড়াই
সাত কিশোরী। ১৯৭১ সালে কাজ করেছেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাংলাদেশ হাসপাতালে। তেমন কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। ছিল অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তি। সেবা আর ভালোবাসা দিয়ে তাঁরা সুস্থ করে তুলেছেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের।
মধুমিতা, অনুপমা, কল্পনা, পদ্মা, আলো আর নীলিমা একাত্তরে ছিলেন কিশোরী। এই ছয়জনের সঙ্গে আরও একজন ছিলেন, কিন্তু এখন আর তাঁর নাম কারও মনে নেই। তাঁরা যখন অষ্টম থেকে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী, তখন শুরু হয় যুদ্ধ। সে কী ভয়াবহ অবস্থা! চারদিকে আতঙ্ক। এই বুঝি পাকিস্তানি বাহিনীর সেনারা গ্রামে এসে গেল। কাকে যে কোথায় মেরে ফেলে ঠিক নেই। এমন অবস্থায় কি আর বাড়ি থাকা সম্ভব? যেতে হয় নিরাপদ আশ্রয়স্থল, ভারতে।
ওখানেই বন্ধুত্ব হয় সাত কিশোরীর। সবাই নার্স হিসেবে কাজ নেন বাংলাদেশ হাসপাতালে। ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার কাছে বিশ্রামগঞ্জে ছিল সেই হাসপাতাল। হাসপাতাল মানে দালানকোঠা জাতীয় কিছু নয়। জঙ্গলঘেরা পাহাড়ের ওপর ছন দিয়ে তৈরি ঘর। সেই হাসপাতালে বিছানা তৈরি হয়েছিল বাঁশ দিয়ে। ভিটে ছিল কাঁচা। আর সেই হাসপাতালেই বড় একটি ওয়ার্ড ছিল সার্জারি। মানে যেখানে গুলিবিদ্ধ মানুষের অপারেশন করা হতো। সেটাও ছিল বাঁশের তৈরি।
ভাবা যায়! শরীর থেকে বুলেট বের করার জন্য ডাক্তার নিজের আঙুলই ব্যবহার করেছিলেন। প্রথম অবস্থায় কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না। অপারেশন থিয়েটার বানানো হয়েছিল বাঁশের মাচায় আর মাটিতে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল পলিথিন।
জরুরি অপারেশনে রক্ত লাগবে। শরণার্থীশিবিরে খবর দেওয়া হলো, ‘কে কে রক্ত দেবে, চলে আসুন।’ মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেছে রক্ত দেওয়ার জন্য। রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা হলো। রক্তদাতাও পাওয়া গেল। কিন্তু সেই রক্ত রোগীর শরীরে দেওয়া হবে কীভাবে? ডাক্তার বললেন, রোগীকে মাটিতেই শোয়ানো হোক। বাঁশের তৈরি বিছানায় শোয়ানো হলো রক্তদাতাকে। তারপর সরাসরি রক্তদাতার শরীর থেকে রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা হলো।
এভাবেই তাঁদের চিকিৎসাসেবা চলে বাংলাদেশ হাসপাতালে। হাসপাতালের কর্মীদের মধ্যে অল্প কয়েকজন চিকিৎসক আর বেশির ভাগ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। এমন যে হাসপাতাল, সেই হাসপাতালের নার্সদের শিক্ষাদীক্ষাও অল্প। প্রথম কয়েক মাস যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের কারোরই কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না।
তবে পরামর্শ পেয়েছেন ডাক্তার মেজর আখতার, ডাক্তার নাজিমউদ্দিন, ডাক্তার ক্যাপ্টেন সিতারা বেগমসহ কিছু সিনিয়রের কাছ থেকে।
মধুমিতা আর আলো—তাঁরা যমজ বোন। পড়তেন নবম শ্রেণিতে। বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। আর কল্পনা, তিনি তো ভৈরবে মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। বাসনা, অনুপমা, নীলিমারাও ছিলেন তেমনি। বই নিয়ে স্কুলে যেতেন। কিন্তু বিপদে পড়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। আর সেখানে গিয়ে যুক্ত হয়ে যান বাংলাদেশ হাসপাতালে।
পদ্মা চাইছিলেন অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যাবেন। নিজের হাতে খুনি পাকিস্তানি সেনাদের কাবু করবেন। চেষ্টাও করলেন। ইচ্ছার কথা বললেন ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারকে।
বললেন সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফকে। কিন্তু কিশোরী পদ্মাকে তাঁরা কেউই যুদ্ধে পাঠাতে রাজি হলেন না। অতঃপর পদ্মা গেলেন তাঁদের এলাকার এম এন এ ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে।
তাঁকে পদ্মা মামা ডাকতেন। বললেন, ‘মামা আমি যুদ্ধে যাব।’ জিল্লুর রহমান আশ্বস্ত করলেন, গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া যায় কি না, খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আলোচনা করবেন। কিন্তু পরে পদ্মাকে বলা হলো, যুদ্ধে চিকিত্সাসেবা বড় জরুরি। এখানে যাঁরা কাজ করেন তাঁরাও যোদ্ধা।
সেই হাসপাতালে নার্স হিসেবে ছিলেন রেশমা, আসমা, লুলু ও টুলু। বয়স ও পড়ালেখার দিক দিয়ে তাঁরা সিনিয়র। তাই ছোটদের খুব আদর করতেন। লুলু, টুলু, আসমা, রেশমা—সবাই ছিলেন শহরের বাসিন্দা। সামাজিকভাবেও তাঁদের পরিচিতি ছিল। লুলু (সুলতানা কামাল) ও টুলু (সাঈদা কামাল) কবি সুফিয়া কামালের মেয়ে। ছোটরা তাই একটু দূরত্ব বজায় রেখেই চলতেন। তবে পরিবেশ ছিল একেবারে পারিবারিক। সবাই ছিলেন আন্তরিক।
একবার পদ্মাকে বলা হলো এক পাগল রোগীকে সেবা করতে হবে।
শিকল দিয়ে বাঁধা এক তরুণ। তাঁকে খাওয়ানো যায় না, ওষুধ কিংবা ইনজেকশন কিছুই দেওয়া যায় না। কেউ কাছে গেলেই কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় বলে, ‘মাইরা লায়াম, ফাইরা লায়াম।’ পদ্মাকে বলা হলো, এই পাগলকে সেবা দিয়ে সারিয়ে তুলতে হবে। সে এক অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা। এই পাগল মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি সেবা দিয়ে সারিয়ে তুলেছিলেন।
এই যোদ্ধাটির পাগল হওয়ার বিষয়টা যে বলতেই হয়। মালেক নামে কুমিল্লার এই যোদ্ধা সম্মুখ সমরে একাধিক পাকিস্তানি সেনাকে পরাস্ত করেন। একপর্যায়ে আত্মরক্ষার জন্য বেয়নেট চার্জ করেন একের পর এক। এত রক্ত আর ভয়াবহতা দেখে এক সময় মালেক মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পদ্মার সেবায় সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে যান তিনি।
সাত কিশোরীর থাকার জায়গা হয়েছিল হাসপাতালের কাছেই, পাহাড়ের ওপর। ছনের ঘর, বাঁশের বেড়া। এর মধ্যেই বিছানা পেতে রাত কাটাতে হতো। বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে এত কষ্টে থাকার কারণেই দেশের কথা তাঁদের খুব মনে পড়ত।
যখনই কোনো রোগী আসে, কিশোরী নার্সরা দৌড়ে যেতেন। আহারে, এই বুঝি কোনো আত্মীয়স্বজন কিংবা নিজ গাঁয়ের মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে এল!
সমবয়সী বলেই কিশোরীদের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। একবার বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালের কাছেই আবুল ব্যানার্জীর কমলাবাগানে বেড়াতে গিয়েছিলেন তাঁরা। তখন কৈশোরের দুরন্তপনা সাত বন্ধুকে পেয়ে বসেছিল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তাঁরা ওঠানামা করেছেন, ছোটাছুটি করেছেন। আর মুহূর্তটা ধরে রেখেছেন ক্যামেরায়।
এমন আনন্দ-বিষাদ নিয়েই একাত্তরের কিছু কিশোরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, যোদ্ধাদের চিকিত্সাসেবা দেওয়ার মাধ্যমে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁরা আবার নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।