শ্রদ্ধা
সাক্ষাৎকারে কাইয়ুম চৌধুরী: একজন শিল্পীর জীবন কি তার শিল্পকর্ম থেকে আলাদা হতে পারে?
আজ বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুদিন। তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালের মে মাসে। এখানে শিল্পকলা ও নিজের উপলব্ধির নানা কথা বলেছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সিলভিয়া নাজনীন। কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুদিনে সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশিত হলো।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া নাজনীন: দীর্ঘ শিল্পীজীবনে আপনি নিজেকে কতটা সার্থক মনে করেন?
কাইয়ুম চৌধুরী: সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব করা আমার কাজ নয়। আমি নিষ্ঠার সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে কাজ করে যাই। কাজের আনন্দকে যদি সার্থকতা বলা যায়, তাহলে আমিও কিছুটা দাবি করতে পারি। কী বলো?... হা হা হা।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে শিল্পীর জীবনও জড়িয়ে থাকে। জীবনকে কি কখনো আলাদাভাবে দেখতে ইচ্ছা করে না আপনার?
কাইয়ুম: এখানে ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছ, একজন শিল্পীর জীবন কি তার শিল্পকর্ম থেকে আলাদা হতে পারে? জীবন কি শিল্প নয়? জীবনের বহুরূপী চরিত্রই ক্যানভাসে এসে ধরা দেয়। এই যে একটু আগে দীর্ঘ জীবনের কথা বলেছ, শিল্পচর্চার সঙ্গে জড়িত না থাকলে জীবন তো পানসে হয়ে যেত।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: আপনার কাজে আমরা আলাদা একধরনের আস্বাদ পাই, যা ঠিক পাশ্চাত্যানুসারী শিল্পকর্মের সঙ্গে মেলে না। এটা কি আপনার সচেতন প্রয়াস, না হয়ে ওঠা?
কাইয়ুম: দেখো, আমার কাজ বুঝতে হলে আমাদের সময়টাকেও বুঝতে হবে। বিবেচনায় নিতে হবে আমাদের শিক্ষক, সহপাঠীদেরও। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান আমার দীক্ষাগুরু। আমি চেতন-অবচেতনে তাঁদের অনুসরণ করি। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানের কাজে মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। বাঙালির নিজস্ব চিত্রধারাকে এগিয়ে নিতে তাঁরা আমাদের দীক্ষা দিয়েছেন। পাশ্চাত্য উপকরণে (ম্যাটেরিয়াল) আমি কিন্তু আমার কথাই বলছি। আমাদের কিষান-কিষানির ঘর্মাক্ত শ্যামল মুখ, নকশিকাঁথা, ঘুঘু পাখির বিষণ্ন ডাক আর আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম—সবকিছুরই নিজস্বতা আছে । তাই কাজের ধরনও নিজস্ব হয়ে যায়।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: প্রকৃত শিল্পীর কি কোনো দেশ থাকে?
কাইয়ুম: প্রকৃত শিল্পী মহিরুহের মতো। বাইরে থেকে তাকে শূন্যে ভাসমান মনে হতে পারে, কিন্তু তার শিকড় মাটির অনেক গভীরে গিয়ে রসদের জোগান নেয়। জয়নুল আবেদিনকে দেখো, তাঁর কাজ দেখো, শিল্প ও শিল্পী বিষয়ে অনেক ভুল ভেঙে যাবে। তিনি জানতেন আসল পথ কোন দিকে গিয়েছে, তাই তাঁর চলার পথে কোনো দোদুল্যমানতা নেই। শিল্পের শিকড় আমাদের গণমানুষের চলন-বলন, গান, গল্প, ভাবনাচিন্তার সর্বত্র প্রোথিত রয়েছে। স্বদেশের মাটিতে দাঁড়িয়েই বিদেশকে জয় করতে হয়।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: শিল্পকর্মে বাইরের প্রভাবকে আপনি কীভাবে দেখেন?
কাইয়ুম: প্রভাবক ছাড়া নতুনত্ব নিয়ে ভাবনাটাই তো গড়ে ওঠে না। লোকশিল্পের প্রতি আমার ভালো লাগা আর ক্রমাগত নিরীক্ষণ থেকেই হয়তো আমার মধ্যে কিছুটা মৌলিকত্ব তৈরি হয়েছে। বাঙালির চিরায়ত শিল্পকলার রং ও রেখার চলাচল নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উৎকীর্ণ। এসব সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই অনাদিকাল ধরে বহমান আমাদের লোকজ শিল্প। তবে প্রভাবকে বিনা বিচারে গ্রহণ করারও অনেক বিপদ আছে।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: নকশাধর্মী চিত্রকলার প্রতি বরাবরই আপনার আগ্রহ লক্ষ করা যায়। এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে কি?
কাইয়ুম: তা আছে। জয়নুল আবেদিন একবার আমার নৌকার ড্রয়িং দেখে আরও কিছু নৌকা দিয়ে কম্পোজিশন করতে বলেছিলেন। আমি অনেকগুলো কম্পোজিশন করলাম, তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। সেখান থেকেই আমার নকশাধর্মী নতুন একটি দিকনির্দেশনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। পরিচিত ফর্মকে ভেঙে নতুন সৃষ্টির এই আগ্রহে জয়নুল আবেদিনই আমার পথনির্দেশক।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: টাইপোগ্রাফিতে একটি নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছেন আপনি। এখানে আপনার কোনো অনুকরণীয় ব্যক্তি বা উৎসাহদাতা কেউ কি ছিলেন?
কাইয়ুম: এটাকে বলতে পারো পারিবারিক উত্তরাধিকার। টাইপোগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি বাবার কাছ থেকে। চমৎকার হাতের লেখা ছিল আমার বাবার, তিনি অনেকগুলো চিঠি লিখেছিলেন আমাকে। তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন এবং আমাদের ভাইবোনদেরও পাঠাগারের সদস্য করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে আমার ভেতরে বই পড়া ও বই সংগ্রহের আগ্রহও তৈরি হয়েছে।
‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কথাটি আমাকে এতটাই তাড়িত করেছে যে শিক্ষা-পরবর্তী জীবনে যে জায়গাগুলোতেই কাজ করার চেষ্টা করেছি এবং এখনো করছি, তা এই রুচির দুর্ভিক্ষকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার একটা আপ্রাণ প্রচেষ্টারই অংশ।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: গ্রাফিক ডিজাইনে আপনি একটি দেশের রুচি তৈরি করলেন। ডিজাইনের বিবর্তন সম্পর্কে কিছু বলুন।
কাইয়ুম: জয়নুল আবেদিন একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষ তো আছেই; কিন্তু রুচির দুর্ভিক্ষ কী করে মিটবে?’ এই কথাটি এখনো আমার কানে বাজে । ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কথাটি আমাকে এতটাই তাড়িত করেছে যে শিক্ষা-পরবর্তী জীবনে যে জায়গাগুলোতেই কাজ করার চেষ্টা করেছি এবং এখনো করছি, তা এই রুচির দুর্ভিক্ষকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার একটা আপ্রাণ প্রচেষ্টারই অংশ । আর ডিজাইনের বিবর্তন আসলে প্রকাশনা শিল্পের বিস্তৃতির সঙ্গে জড়িত। আগে প্রকাশনা ঠিক শিল্প হয়ে উঠতে পারেনি। কিছু পাঠ্যবই প্রকাশ হচ্ছিল কেবল। সেই পাঠ্যবইয়ের কাজ করতেন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান ও কাজী আবুল কাশেম। তার পরপরই আমরা এসেছি। এখন নতুন নতুন প্রকাশনা সংস্থা ভালো প্রচ্ছদ, কাগজ, ছাপা—এসবের দিকে নজর দিচ্ছে। এখন তো ভালো করার একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা আছে। কিন্তু স্বাধীন দেশে কয়েকটি মাত্র চেয়ার-টেবিল দিয়ে মগবাজারের এক বাড়িতে যখন বিসিকের ডিজাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হলো—চেয়ার-টেবিলও সবার জোটেনি তখন, আমি ও শিল্পী ইমদাদ হোসেন ঘরের মেঝেতে বসেই সে সময় কাজ করেছি । তবে ওসব নিয়ে আমাদের কোনো অনুযোগ ছিল না। নতুন কিছু করতে হবে—এই তাড়না ও দেশাত্মবোধ আমাদের কোনো অপ্রাপ্তিকেই বড় হয়ে উঠতে দেয়নি ।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: শিল্পী হওয়াই আপনার নিয়তি–নির্ধারিত ছিল, এমন মনে হয়েছে কখনো?
কাইয়ুম: নিয়তির হাতে শুধু মৃত্যুকেই রেখেছি, বাকি সব মানুষের পরিশ্রমের ফসল । চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর ‘শিল্পীই হব’, এই ভাবনার বাইরে অন্য কিছুই ছিল না । জীবন চালানোর উপায় নিয়ে কখনো ভাবিনি। কিছু একটা হয়ে যাবে এমন বিশ্বাস ছিল। এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত শিল্পীদের জীবনীপাঠ আমাকে আরও সাহসী করে তোলে। ঝুঁকি নিতে জানতে হয়, শিল্পীর জীবন যুগে যুগেই এমন অনিশ্চয়তায় ভরপুর ছিল। তাতে কেউ থেমে থাকেননি।
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: এখনো কি শিল্পীদের জীবন-জীবিকা আপনাদের সময়ের মতোই অনিশ্চয়তায় পূর্ণ?
কাইয়ুম: কী যে বলো! চারদিকে দেখো না, এখন সম্ভবত শিল্পীদের জীবনই বেশি আনন্দময়। তাদের সামনে জীবনযাত্রা চালিয়ে নেওয়ার অনেক পথই খোলা আছে। এত মিডিয়া, বিজ্ঞাপনী ও প্রকাশনা সংস্থা, পত্রপত্রিকা, সরকারি-বেসরকারি চাকরি; দেশে-বিদেশে শিল্পীদের সুযোগই তো মনে হয় অন্যদের তুলনায় বেশি, কাজের আনন্দ তার বোনাস। এই সময়ে একজন শিল্প-শিক্ষার্থীর চারদিকে এত বাড়তি সুযোগ দেখে মনে হয়, শিল্পাচার্য হয়তো তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে পেলে ভীষণ আনন্দিত হতেন। আবার একই সঙ্গে এ প্রশ্নও মনে জাগে, শিল্পী হওয়ার তাগিদ কি এখনো এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছে, নাকি এরা শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রতিষ্ঠিত জীবন?
প্রশ্ন :
সিলভিয়া: শিল্পী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কি কোনো বাড়তি প্রেরণার প্রয়োজন আছে বলে আপনি মনে করেন?
কাইয়ুম: আত্মার ডাক একটি বড় ব্যাপার। তারপর হয়তো থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাগুরু, চারপাশের পরিবেশ—এসবের ভূমিকা। মোটকথা ভেতর থেকে সাড়া না পেলে কেউ শিল্পী হতে পারে না। এটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। তবে যথার্থ গুরু তাঁর শিষ্যের আত্মা তৈরি করে দিতে পারেন, গুরু সদয় দত্ত যেমন তাঁর শিষ্য কামরুল হাসানের আত্মাকে তৈরি করে দিয়েছিলেন। কামরুল হাসান আমৃত্যু তাঁর গুরুর পথেই হেঁটেছেন। এ কারণেই তিনি বলতে পারেন, ‘যামিনী রায়ের যেখানে শেষ, আমার সেখানে শুরু ।’ আকাশচারিতা শিল্পী হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে । শিল্পীর সম্পর্ক থাকে মাটির সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে। আমি নিজেও সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।