১৫ মে সরদার ফজলুল করিমের মৃত্যুদিন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা
সরদার ফজলুল করিমের ঋণ না ভোলার তাগাদা
‘কাপড় ছিঁড়িলে হয় কাঁথা, মানুষ মরিলে হয় কথা’—কাল সবাইকে কথামাত্র করে দেয়। কিছু কথা রয়ে যায়, হারায় না। যিনি ইতিহাসের হাতে কেবল পুতুল না হয়ে নিজে ইতিহাসের কর্তা হওয়ার কাজে শামিল হন, তিনি কথাশরীর প্রাপ্ত হন। সরদার ফজলুল করিম কথাশরীর প্রাপ্ত হয়েছেন।
তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ। এই বইয়ের প্রকাশকের কথা অংশে মতিউর রহমান যেমন বলেছেন, তিনি আমৃত্যু একটি মানবিক সমাজ বিনির্মাণের অভিপ্রায়ে কাজ করে গেছেন। সে জন্য তিনি একটি রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা ধারণ করেছেন। তবে সেই চর্চা সাধারণে যে চেহারা ফুটিয়ে তোলে, তিনি নিজেকে তা থেকে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘সরদার স্যার’। কৃশকায়, ধবল কেশ আর মুখে স্নেহের হাসি, এই রূপ তাঁকে শিক্ষক করে সামনে আনে। কিন্তু তিনি মনে করিয়ে দেন তাঁর লেখায়, ‘কৃষক পরিবারের ছেলে আমি।...বাবা বলতেন, “তুই লাঙলটা ধর বা মইয়ে একটু ওঠ...”।’
এই কৃষক পরিবার পূর্ব বাংলার কেন্দ্র। এ কেন্দ্র বাংলার সব রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আধার।
কিন্তু এই কৃষকসমাজ নিজের রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য লড়াই করেছিল। সেই লড়াইয়ের জন্য কী করে সে নিজেকে প্রস্তুত করেছিল, তার বয়ান সরদার ফজলুল করিমের আত্মজীবনী ও অন্যান্য। আমাদের গড়ে ওঠার কালখণ্ডকে চোখের সামনে উন্মোচন করে এই বই। এখানেই পাওয়া যাবে সেই কালের পটভূমি, যা এখন বিস্মৃতপ্রায়। সেই সময়কে ভুলে গেলে মনে হবে চিরকাল আমরা এমনি আত্মসর্বস্ব ছিলাম।
এক কৃষকের ছেলে ঢাকায় এসেছে। সে যে সমাজের অংশ, সে সমাজ রাজনৈতিক ও সামাজিক চলমান আন্দোলনে অংশ নিতে দ্বিধান্বিত। ১৯৪০–এর সময়ের কথা বলতে গিয়ে সরদার ফজলুল করিম জানাচ্ছেন, মাঝেমধ্যে যে ধর্মঘট হয়, তাতে ‘মুসলমান ছাত্ররা খুব একটা সক্রিয় ছিল না।’ বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদার রেশ ধরে লেখাপড়ার সূত্রে তাঁদের অন্য রকম দীক্ষার শুরু হয়। তিনি ঠাঁই নেন বামপন্থী সাম্যবাদী ছাউনিতে। স্থানিক আন্দোলনের জায়গায় মানুষের মুক্তির আন্দোলনে নিজের মুক্তি খুঁজতে শুরু করেন তিনি। লেখাপড়া করে ‘ভদ্রলোক’ হওয়ার চলমান ভাবনা থেকে সরে আসেন। তখন ক্লাসে তাঁর বন্ধু হলেন সব ব্যাড বয়রা। তাঁরা তাঁকে টেনে পেছনে নিয়ে যেতেন। বলতেন, ‘তুই তো গুড বয় না। তুই ব্যাড বয়। তুই আমাদের সঙ্গে থাকবি। আর আমাদের পড়াবি তুই।’ ফজলুল করিম আমৃত্যু ‘সরদার স্যার’ হয়ে ব্যাড বয়দের পড়ানোর কাজ করে গেছেন।
আত্মজীবনী ও অন্যান্য
সরদার ফজলুল করিম
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: মে ২০২১
৩৪২ পৃষ্ঠা
দাম: ৬০০ টাকা।
পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের
দোকানে।
এই কাজে তাঁর কোনো তাড়া ছিল না। স্বপ্নের মানবিক সমাজের জন্য তিনি ‘হাজার বছর’ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। এটা ফসল ফলানো মানুষের ধৈর্য। খরা, বন্যা, মন্বন্তরে ফসল নষ্ট হওয়া কৃষকের আবারও মাঠে চারা রোপণের অভিজ্ঞতা। ফসলের গায়ে আদরে হাত বোলানোর সঙ্গে শস্যের আগাছা উপড়ে ফেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি এসেছিলেন মানুষের সমাজবদলের প্রক্রিয়ায়। তাই পরাজয় বলতে কোনো শব্দ ছিল না তাঁর কাছে। বর্তমানের ভেতর তিনি স্বপ্নের ভবিষ্যৎ লালন করতেন। কোনো শ্রমজীবীকে ‘তুমি’ না বলে বলতেন ‘আপনি’।
সরদার জানতেন, এই জনগোষ্ঠী কেমন করে নিজের রূপান্তর ঘটাচ্ছে। সেই রূপান্তরের মূল অভিপ্রায় পথ হারাতে পারে, অর্জন হাতছাড়া হতে পারে, তা–ও তিনি বুঝতেন। তাই বিশদভাবে লিখে গেছেন ওই স্বপ্ন গড়ে ওঠার কথা। সে সময়ের হদিস তিনি দিয়ে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আলাপচারিতায়। আমরা যেন ভুলে না যাই এই দেশ, এই মানুষের জন্মের পেছনে কোন স্বপ্ন ছিল। এসব কথা মনে রাখলে বর্তমানের সঙ্গে বোঝাপড়া সম্ভব হবে। সরদারের কথায়, ‘আমি কৃষকের পোলা। আমি শুধু বাপের ঋণ শোধ করতে চাই।’
সরদার ফজলুল করিমের আত্মজীবনী ও অন্যান্য শিরোনামের বইটি আমাদের সেই ‘ঋণ’ না ভোলার তাগাদা দেয়।