শিল্পীর প্রতিকৃতি

আমার স্বামী ওয়ালী

আন মারি ওয়ালীউল্লাহ

প্রথমা প্রকাশন

প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী

দাম: ১৪০ টাকা

আন মারি ওয়ালীউল্লাহর ইংরেজিতে লেখা ওয়ালী মাই হাজবেন্ড অ্যাজ আই স হিম-এর অনুবাদ আমার স্বামী ওয়ালী। বাঙালি মুসলমান সমাজ ও ওয়ালীর মানস গঠন, সর্বগ্রাসী পাঠক, শিল্পী লেখক প্রভৃতি পরিচয় পাওয়া গেল আলোচ্য গ্রন্থের কল্যাণে। বাঙালি মুসলমান হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন ওয়ালী। তাঁর লেখার অনেকখানি জুড়ে রয়েছে স্বজাতির দুর্দশার চিত্র ও মুক্তির উপায়। তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ তিনি চিহ্নিত করেছেন। শিক্ষার অভাব, সামাজিক অনগ্রসরতা, কুশিক্ষা-কুসংস্কার প্রভৃতি কারণে মুসলমান সমাজ পিছিয়ে। ‘নিজের দেশের দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা, দেশটিতে ব্রিটিশ, হিন্দু জমিদার এবং পাকিস্তানিদের শোষণকে ঘৃণা করতেন। মুসলমানরা ব্রিটিশদের এত ঘৃণা করছে যে তারা তাদের সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করতে পাঠায়নি, ব্রিটিশ শাসকদের কোনোরকম সহযোগিতা করেনি, তারা আশ্রয় নিয়েছে ধর্মকর্মের কাছে।’ এসব কারণে একশ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ী পরকাল আর নরকের ভয় দেখিয়ে মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করেছে। অথচ কবর পূজা আর পীর পূজা ধর্মে নিষিদ্ধ তা সাধারণ মানুষ জানতে পারেননি।

ওয়ালী ছোটবেলায় চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। একদিন পড়া বাদ দিয়ে ছবি আঁকায় মনোযোগ দেওয়ায় বাবা এসে চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে উঠিয়ে ওর আঁকা ছবি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। তাই ওয়ালী বলেছিল ‘ছবি আঁকা চালিয়ে যেতে হলে আমাকে মাথার চুল ছেঁটে ফেলতে হবে।’ তিনি পরিণত বয়সে ছবি এঁকেছেন বেশ কিছু। জয়নুলের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। আন মারি জানাচ্ছেন যে তাঁরা যেখানেই গেছেন, জাদুঘর ও চিত্রশালা দেখতে গিয়েছেন। তিনি ইমপ্রেশনিস্ট আর আধুনিক চিত্রকরদের ভক্ত ছিলেন।

তিনি লিখতে পছন্দ করতেন। ‘আমি স্বাধীন থাকতে চাই। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব অনিশ্চয়তায় ভুগছি।’ তিনি পিইএনের জন্য বাংলা নাটক বহিপীর লিখেছিলেন। এ সম্পর্কে লিখেছেন: ‘আজ খুব চমৎকার একটি সন্ধ্যা কাটল মনে হচ্ছে। নির্ধারিত লোকজনের সামনে নাটকটি পাঠ করা হলো। নাটকটি পড়ল আমার এক বন্ধু। গত চার বছরে সে তিনবার জেল খেটেছে।’ মুনীর চৌধুরীর (১৯২৫-১৯৭১) নাম উল্লেখ না করেও অনেক প্রশংসা করেছেন। তাঁরা দুজনই বাঙালি মুসলমানের মুক্তি চেয়েছিলেন। সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আজও অর্জিত হয়নি। তাঁদের সাহিত্যে মন্বন্তর ও দুর্ভিক্ষের ছবি ফুটে উঠেছে। মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে মুর্দা ফকির জানে মানুষ শুধু একভাবেই মারা যায়, আর তা হলো না খেতে পেয়ে। ওয়ালীউল্লাহর গল্পেও আমরা দুর্ভিক্ষের ছবি দেখতে পাই। তিনি লিখেছেন ‘আমার লেখা বই, আমার নাটক, আমার গল্পগুলি ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ফটোগ্রাফিক প্রতিফলন নয়, বরং এগুলো তার চেয়ে বেশি কিছু। অন্তত আমি সেটাই মনে করি। আমি যখন ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন, মোল্লাদের হাতে গরিব মানুষের শোষণকে আক্রমণ করি তখন গোটা ব্যবস্থাটাকেই আক্রমণ করি।’

আন মারি ও ওয়ালীর মধ্যে প্রথম পরিচয়ক্ষণটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন ‘মনে পড়ে তাকে প্রথম দেখেছিলাম ঘরের সবচেয়ে দূরবর্তী একটি কোনে ডিভানে বসে থাকতে, দেখে মনে হয় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে চারিদিকে মানুষজন চোখে পড়ছে না তার। নিজেকে দূরে রাখার এই স্বভাবের কারণেই কি ঘরের ওপাশে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে আমার মন টেনেছিল? সত্যি কথা বলতে ওখানে আমিও কাউকে চিনতাম না। তা ছাড়া ওর মধ্যে আমি এক পরদেশি আবহ পেলাম, কাজেই আমার সঙ্গী মনে হলো তাকে।’ পরিচয়, প্রণয় অতঃপর পরিণয়। আন মারি, ওয়ালীর কথা লিখতে গিয়ে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ ও তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে জানতে এটি অবশ্যপাঠ্য একটি গ্রন্থ। ভূমিকায় আনিসুজ্জামান যথার্থই লিখেছেন, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে আন মারির স্মৃতিকথা এক অসাধারণ রচনা।...আমাদের সাহিত্যের আমাদের কালের একজন বড় স্রষ্টাকে জানতে আন মারির এই বই সহায়ক হবে, এমনকি আমি বলব অপরিহার্য বলে গণ্য হবে।’ এ রকম একটি গ্রন্থ অনুবাদ করার জন্য অনুবাদক শিবব্রত বর্মণকে এবং সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন প্রকাশনার জন্য প্রথমাকে ধন্যবাদ।