আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে ভবিষ্যৎ কেন মনে রাখবে?

কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার সাক্ষী তিনি। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করবেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস

লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-২১

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে আমরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। একই মানুষ যখন অনেক কাজ করেন, তখন আমরা আর তাঁকে ঠিকঠাকভাবে চিনে উঠতে পারি না। অনেকটা হাতি দেখার মতো করে তাঁকে বিচার করার চেষ্টা করি।
সায়ীদ স্যারের অনেকগুলো বই আমাকে পড়তে হয়েছে। স্যারের সঙ্গে নিউইয়র্ক বইমেলায় গেছি, চট্টগ্রামের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে থেকেছি। তাঁর বিশালত্ব এবং প্রতিভার বহুমুখীনতা আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে। খ্যাতিমান মানুষদের কাছে যেতে নেই। গেলে আপনি তাঁর মানুষি দুর্বলতাগুলো দেখে ফেলে হতাশ হবেন। সায়ীদ স্যারের বেলায় আমার তা ঘটেনি। আমি ২০০৩ সালে প্রথম আলোয় ‘ভালোবাসার সাম্পানের কাণ্ডারি’ নামে যে লেখা লিখেছিলাম, তা এখনো প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। সেই লেখাটা নিচে তুলে ধরছি:
‘এইবার!
এইবার আমি আমার উপযুক্ত পথ খুঁজে পেয়েছি,
মান্নান!
যাঁদের মধ্যে জ্বলছে শিল্পের শিখা,
জিজ্ঞাসার ক্ষুধা আর স্বপ্নের অজস্র আক্রমণ!
এক জায়গায় গুছিয়ে নিয়ে বসেছি এবার।
প্রকৃত স্বচ্ছতা! প্রকৃত শান্তি! প্রকৃত সমীকরণ!
ক ণ্ঠ স্ব র! টে-লি-ভি-শ-ন?—
লে-খা-লে-খি? শো-ম্যা-ন-শি-প?—
বি শ্ব সা হি ত্য কে ন্দ্র?—
ওসব অনেক হয়েছে।
তুমি তো জানোই, আমি আসলে নাট্যকার,
নাটকের রক্ত বইছে আমার শিরা-উপশিরায়।
হ্যাঁ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে
একটি অলিখিত অসম্ভব নাটকের
শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে আমি শিরোপা দিতে চাই।

(আশা করি, জনাব কবীর চৌধুরী ও জনাব সাঈদ
আহমদ অনুমোদন করবেন)’
কবিতাটি আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখা, ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অনেকগুলো পরিচয় এই কবিতায় চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ‘কণ্ঠস্বর’ নামের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক তিনি, টেলিভিশনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থাপক আর এ দেশে টেলিভিশন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের প্রবক্তা, প্রবল জনপ্রিয়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা তথা বই পড়া আন্দোলনের সংগঠক—আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এসব পরিচয় এই কবিতায় পাওয়া যাচ্ছে ঠিকভাবেই। কবিতাটি ইদানীংকালে রচিত নয় বলে পরিবেশ আন্দোলনের আপসহীন সেনাপতি হিসেবে অধ্যাপক সায়ীদের সাম্প্রতিকতম পরিচয়খানি এতে অনুল্লিখিত রয়ে গেছে। কিন্তু আবদুল মান্নান সৈয়দ যে গোপনতম খবরটি এ কবিতায় নির্ভুলভাবে পরিবেশন করতে পেরেছেন, তা হলো লেখক-কবি-নাট্যকার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের দ্বন্দ্বদীর্ণ অতৃপ্ত হৃদয়ের হাহাকার; নিজের লেখালেখির ব্যাপারে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তরুণতম লেখকের মতোই আন্তরিক, অতৃপ্ত, নাছোড় এবং লাজুক। শত ব্যস্ততার মধ্যেও লিখে চলেছেন তিনি, গত কয়েক বছরে তাঁর লেখার পরিমাণ ছাপার হরফে সহস্র পৃষ্ঠার বেশি।

দুই.

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে ভবিষ্যৎকাল কেন মনে রাখবে?
কিংবা কেন এবং কীভাবে তিনি আমাদের কালে আমাদের সমাজের একজন অগ্রগণ্য নায়ক হয়ে উঠলেন?
প্রথমত, তিনি ছিলেন শিক্ষক। আমাদের কাছে তিনি ‘স্যার’। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, তিনি সায়ীদ স্যার। জীবনের তিরিশটি বছর কাটিয়েছেন শিক্ষকতায়। ১৯৬২ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহী কলেজে যোগ দিয়েছিলেন প্রভাষক পদে, ১৯৯২ সালে ঢাকা কলেজের অধ্যাপক পদটি তিনি যেদিন ছেড়ে দেন, সেদিনটিও ছিল বোকা দিবস, ১ এপ্রিল। কাকতাল মনে হতে পারে এই দুই বোকা দিবসের সংযোগ। কিন্তু যখন আমরা জেনে যাই যে তাঁর প্রিয়তম উপদেশটি হলো ছোটবেলায় তাঁকে বলা তাঁর শিক্ষক পিতার উক্তি—‘বোকা হোস’, তখন বোঝা যায়, অন্তত চাকরি ছেড়ে দেওয়ার তারিখটি হয়তো ভেবে-চিন্তেই বেছে নেওয়া।

বোকা হোস—এই উক্তি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রিয় কেন? তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ওপর দেওয়া এক তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় এ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, নিজের মঙ্গল-অমঙ্গল-স্বার্থ চিন্তা না করে অন্যের মঙ্গল, দেশের কল্যাণ, সমাজের উন্নতির জন্য যাঁরা আত্মোৎসর্গ করেন, সমাজের আর দশজন সাধারণ মানুষের চোখে তাঁরা বিবেচিত হন বোকা বলে। এ ধরনের বোকা মানুষেরাই যুগে যুগে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এ রকমেরই এক বোকা মানুষ।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ছবি: অন্য আলো

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর চাকরিজীবনে পদোন্নতি, বৈষয়িক উন্নতির চেষ্টা করেননি। পড়িয়ে গেছেন। তা–ও বোধ করি বোকার মতোই। কারণ, পরীক্ষায় কোন প্রশ্নের উত্তর কীভাবে লিখলে বেশি নম্বর পাওয়া যাবে, তাঁর ক্লাসে তা আলোচনা করা হতো না। কিন্তু যা আলোচনা হতো, তার সুখ্যাতি এখনো ছড়িয়ে আছে পুরো ঢাকায়, কিংবদন্তির মতো, এমন বহু লোকের দেখা আমরা পাই, যাঁরা বলেন, স্যারের ক্লাস করার জন্য তাঁরা অন্য ক্লাস, অন্য কলেজ, অন্য প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হয়েও ছুটে যেতেন ঢাকা কলেজে।

হ্যাঁ। অসাধারণ বাগ্মিতার প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন এই নায়ক মানুষটি। রসবোধ, কৌতুকবোধ, বাকভঙ্গি, পাণ্ডিত্য, দেশপ্রেম, কথায় কথায় কবিতা মুখস্থ বলার ক্ষমতা—সব মিলিয়ে কথক হিসেবে তাঁর ক্ষমতা হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই। তার ওপর তিনি সুদর্শন, পোশাক নির্বাচনে ফ্যাশনদুরস্ত নন, কিন্তু স্টাইলিশড এবং সুরুচিসম্পন্ন। শব্দ নির্বাচন ও বাক্য গঠনে তিনি খানিক অভিজাতপন্থী। তাঁর বক্তৃতা শোনা কিংবা তাঁর সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় যোগ দেওয়া এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা, যা আমি অনেকবারই পেয়েছি।

তিন.

কিন্তু লোকটা কবি ছিলেন। তাঁর কবিতার বই আছে। নাম ‘মৃত্যুময় ও চিরহরিৎ’। ছোটগল্পের বই আছে—‘রোদনরূপসী’, ‘খরযৌবনের বন্দী’, ‘স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের গল্প’। আর নাটক ‘যুদ্ধযাত্রা’। তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন, তাঁর জীবনীমূলক গ্রন্থ ‘বহে জলবতী ধারা’য় অবশ্য তিনি লিখেছেন, ছোটবেলায় তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন, খেলোয়াড় হতে চেয়েছিলেন, দার্শনিক হতে চেয়েছিলেন, এমনকি হতে চেয়েছিলেন গুন্ডা। কিন্তু ষাটের দশকের ঢাকা শহরে শিক্ষকতা আর সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি চারপাশে দেখতে পেলেন এক বিশাল সাহিত্যিক যুগের আগমনের লক্ষণ। অনেক প্রতিভাবান তরুণ লেখক এসে ভিড় করছেন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায়, যাঁদের প্রত্যেকের ভেতর দেখা যাচ্ছে অমিত সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনার বিকাশের আয়োজনে একজন শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যাওয়া নিজের কবিতা লেখার চেয়ে বড় হয়ে উঠল তাঁর কাছে। তিনি এবং তাঁরা প্রকাশ করলেন সেই সময়ের তারুণ্যের মুখপত্র ‘কণ্ঠস্বর’, যা পরবর্তীকালে বিবেচিত হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে। সেই পত্রিকা সম্পাদনা করা, প্রকাশ করা, তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে জিব বের হয়ে আসা গ্লানিকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী একদল রাগী প্রতিভাবান তরুণ লেখককে বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখা—এসব কাজ যিনি করতেন, তাঁর নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ষাটের দশকের বিখ্যাত সব কবি-লেখক—আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন কবির, আসাদ চৌধুরী, (এমনকি হাসান আজিজুল হক), মোহাম্মদ রফিক, ফরহাদ মজহার, আবুল কাশেম ফজলুল হক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আহমদ ছফা, মাহমুদুল হক, আবদুশ শাকুর, সিকদার আমিনুল হক, সাযযাদ কাদির, আলতাফ হোসেন, শহীদুর রহমান, সেলিম সরোয়ার, আবু কায়সার, সনৎ কুমার সাহা, রবীন সমাদ্দার, শাহনূর খান প্রমুখ; সত্তরের আবিদ আজাদ, সানাউল হক খান, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, জাহিদুল হক, শিহাব সরকার, খান মুহম্মদ ফারাবী, ইকবাল আজিজ, কামাল চৌধুরীসহ আরও আরও কবি-লেখকের একটা অন্যতম প্রধান আশ্রয় হয়ে উঠেছিল সেদিনকার সেই ‘কণ্ঠস্বর’।

‘কণ্ঠস্বর’–এর লেখকদের অনেকেই আজকের বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখক। একটা দেশের সাহিত্যের জন্য এটা অবশ্যই বড় ঘটনা। শুধু এই ঘটনার প্রধান কুশীলব হিসেবেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নায়কের মর্যাদায় আসীন হতে পারেন।

চার.
শিক্ষকতা করছেন তিনি ঢাকা কলেজে, ঢাকা টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করছেন, আর বের করছেন ‘কণ্ঠস্বর’। এ পত্রিকা বের করতে গিয়েই তাঁর মনে হলো, তাঁর কালের লেখকদের প্রধান দুর্বলতা হলো তাঁরা বেড়ে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের পটভূমিতে আর তিরিশের লেখকেরা বেড়ে উঠেছে বিশ্বসাহিত্যের পটভূমিতে। তিনি শুরু করলেন ষাটের দশকের শেষের দিকে, পাঠচক্রের মাধ্যমে বই পড়া, বইয়ের আলোচনা করার অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রম। সেটাই ছিল তাঁর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কর্মযজ্ঞের প্রথম বীজটির মাটিতে পড়া।

হ্যাঁ। অসাধারণ বাগ্মিতার প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন এই নায়ক মানুষটি। রসবোধ, কৌতুকবোধ, বাকভঙ্গি, পাণ্ডিত্য, দেশপ্রেম, কথায় কথায় কবিতা মুখস্থ বলার ক্ষমতা—সব মিলিয়ে কথক হিসেবে তাঁর ক্ষমতা হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই। তার ওপর তিনি সুদর্শন, পোশাক নির্বাচনে ফ্যাশনদুরস্ত নন, কিন্তু স্টাইলিশড এবং সুরুচিসম্পন্ন। শব্দ নির্বাচন ও বাক্য গঠনে তিনি খানিক অভিজাতপন্থী। তাঁর বক্তৃতা শোনা কিংবা তাঁর সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় যোগ দেওয়া এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা যা আমি অনেকবারই পেয়েছি।

কী কর্মযজ্ঞই না গড়ে তুলেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সারা দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শ পাঁচেক শাখা আছে। প্রায় লাখখানেক ছেলেমেয়ে এসব শাখার মাধ্যমে বই পড়ে। বই পড়ে বইবিষয়ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, পুরস্কার পায়। সেও বই-ই।

বিশ্বদ্যিালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়-উত্তর ছাত্রছাত্রী আর ব্যক্তিদের জন্য কেন্দ্রের আছে নানান মানসিক উৎকর্ষ কার্যক্রম। বিশ্বের আর বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ বইগুলো প্রকাশ করার জন্য আছে প্রকাশনা কার্যক্রম। আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংগীত আর চলচ্চিত্র উপভোগের ব্যবস্থা। ঢাকাসহ সারা দেশে এই কেন্দ্র ফিবছর অন্তত পাঁচ হাজার মননশীল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। কেন্দ্রের আছে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। বই নিয়ে শকট হাজির হয় রাজধানীর মহল্লায় মহল্লায়, পাঠকের দোরগোড়ায়। ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগান নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চালিয়ে যাচ্ছে আলোর পরশমণি ছুঁইয়ে দিতে আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের হৃদয়ে-মননে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে আনিসুল হক
ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৭ সালে এক প্রতিবেদনে তাঁকে নিয়ে যা লিখেছিলাম, তা এখনো বলা যায় তাঁর সম্পর্কে। এখানে সেটা উদ্ধার করি:
‘বাতিওয়ালা, স্মৃতির শহরের সেই জাদুকরি লোকটা। যখন সন্ধ্যা আগতপ্রায়, চরাচর ছেয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে, লোকটা তখন আলো হাতে চলেছেন এক স্তম্ভ থেকে আরেক স্তম্ভে, জ্বেলে দিচ্ছেন বাতি। আকাশ থেকে অন্ধকার নামছে নিচের দিকে, যবনিকার মতো; আর লোকটা মইয়ের সাহায্যে নিচ থেকে উঠছেন ওপরে, আলোকস্তম্ভের চূড়ায় চূড়ায়। অন্ধকারের বিরুদ্ধে, পতনের বিরুদ্ধে এই এক প্রতীক—মানবের প্রতীক-সংগ্রাম।

আমাদের বৈদ্যুতিক আলোর (ও লোডশেডিংয়ের) এ শহরে আর কোনো বাতিওয়ালা নেই। কিন্তু আছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। এক লক্ষ আলো হাতে নিয়ে যিনি চলেছেন বাংলাদেশের তরুণ প্রাণপ্রদীপগুলোর কাছে। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই; নিয়তিতাড়িত বাতিওয়ালার মতোই যেন তাঁর এই ভবিতব্য। মানুষের প্রাণে প্রাণে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া, আলোকিত মানুষ গড়ে তোলা। আলোকিত মানুষ চাই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, “বাংলাদেশ একটা নতুন দেশ। এখন এর নির্মাণের সময়। নির্মাতা প্রয়োজন। একজন, দুজন নয়, চাই সহস্র লক্ষ নির্মাতা। চাই আলোকিত মানুষ, সম্পন্ন মানুষ। আমরা ৫০০ জায়গা থেকে চেষ্টা করছি সেই আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার।”’

পাঁচ.

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৬৬ সাল থেকেই টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে শুরু করেন। শিশুদের অনুষ্ঠান করতেন, করতেন নানা ধরনের কুইজভিত্তিক অনুষ্ঠান। ১৯৭৩ সাল থেকে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তিনি সিরিয়াস হয়ে ওঠেন। ’৭৫-এ রামপুরায় বিশাল স্টুডিও পেয়ে তিনি মত্ত হয়ে উঠলেন টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে। সত্তর দশকের শেষের অর্ধেকে এ দেশের টেলিভিশন দর্শকদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে আদরণীয় ব্যক্তিত্ব। ‘সপ্তবর্ণা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘আনন্দমেলা’—নানা নামে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। ‘সপ্তবর্ণা’ প্রচারিত হতো সপ্তাহে একটা, প্রতিটা পর্বের ব্যাপ্তি ছিল ৯০ মিনিট। এমনও হয়েছে, অনুষ্ঠান চলতে চলতে খবর শুরু হয়ে গেছে, খবরের মধ্যেই বলা হচ্ছে, এখন আমাদের স্টুডিওতে চলছে ‘সপ্তবর্ণা’, খবরের পরে সরাসরি আমরা যাচ্ছি সেখানে। ‘সপ্তবর্ণা’ চলাটা তখন ছিল একটা জাতীয় সংবাদ।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ পারফরমিং আর্টের এই ক্ষেত্রটাও উপভোগ করেছেন ভীষণভাবে। আজ আমরা বাংলাদেশে যত ধরনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখি, তার প্রায় সব কটাই কোনো না কোনোভাবে ঋণী তাঁর কাছে। প্রায় ১৫০ ধরনের কুইজ তিনি করেছিলেন তাঁর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানগুলোয়। আজ ভারতীয় স্যাটেলাইটে গানের প্রতিযোগিতামূলক যেসব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, সেটাও তাঁরা করেছিলেন বিটিভিতে, সে আমলেই। ‘আনন্দমেলা’ করেছিলেন ২৫ পর্ব, পরে সেটা ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান হিসেবে পরিবেশিত হতে থাকে। শেষতক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আর থাকেননি টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে, কিন্তু ঈদে আনন্দমেলা করার চল এখনো রয়ে গেছে। টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার তুঙ্গ দিনগুলোয় তাঁর মনে হয়েছিল, অনুষ্ঠান করতে করতে যদি ফ্লোরের ওপর মরে পড়ে থাকতে পারতাম, তাহলে এ জীবন সার্থকতা পেত।

সেই মত্ততা থেকেও সরে আসেন তিনি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজ বেড়ে যাওয়ায় ১৯৮২ সালের দিক থেকে তিনি ছেড়ে আসেন টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপকের জনপ্রিয়তার শৃঙ্গ থেকে, স্বেচ্ছায়।
(চলবে)