রান্নায় ভালো মানে 'সুপকুশল'

নিয়ামতনামা গ্রন্থে মোগল রান্নার বিস্তারিত জানা যায়
নিয়ামতনামা গ্রন্থে মোগল রান্নার বিস্তারিত জানা যায়

বহির্বিশ্বে ভিক্টর হুগো তত দিনে ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নতরদাম’ লিখে ফেলেছেন। বেঙ্গলে তখনো সন্ধ্যার পর বাঘের রাজত্ব, তবে চার্নকের কলকাতা আর সেই স্যাঁতসেঁতে কয়েকখানা পাতার কুটিরে সীমাবদ্ধ নেই। বাবু-কালচারের বিলাসব্যসনে ভেসে যাচ্ছে, বাবুরা গালিচার তলায় সন্দেশ বিছিয়ে রাখেন যেন নাচার সময় বাইজির পায়ে ব্যথা না লাগে। লাগামছাড়া বিলাসে মত্ত ইংরেজরাও। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর পার হয়ে গেছে প্রায় অর্ধশতাব্দীরও বেশি আগে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রধানতম পুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন রাজা রামমোহন রায়ও। ঠিক সেই সময়কার একটি বই আপনাকে বলবে—ভোগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলে রান্নাঘর সুখকর, অগ্নিকোণে রান্নাঘর রাখবে, পুব বা পশ্চিমমুখী চুল্লি রাখবে, মাটির হাঁড়ির রান্না ভালো, না হলে লোহার পাত্রে, কাঁসাও খুব জুতসই, তবে তামার পাতে রাঁধবে না...অ্যাসিডিটি হবে, পিত্তের ব্যাধি হবে, সোনা-রুপার বাসন হলে সর্বদোষহর ইত্যাদি। খেতে বসবে স্নান সেরে, চন্দন মেখে, ফরসা কাপড় (শুক্লবস্ত্র) আর মালাটি পরে, সহাস্য মুখে আর প্রসন্ন হৃদয়ে। যে পরিবেশন করবে, সেও স্নান করে আসবে, চুলে ফুলের গুচ্ছ, গায়ে কর্পূর-ধূপ আর মৃগনাভির সুবাস এবং তারও থাকবে হাসিমুখ। রান্না আর খাওয়ার কাজটি ভক্তিনম্র শ্রীমন্ত অনুষ্ঠান। না না, বইটি খনার বচন-সংকলন নয়। যে কেতাব নিয়ে আজ আমি কথা বলব, তার আধুনিক সংস্করণে শ্রীপান্থ বিশাল একটি ভূমিকা লিখেছিলেন, দীর্ঘ এবং ব্যাখ্যাকর। বইটির নাম ‘পাকরাজেশ্বর’।

ছাপাখানার আবির্ভাবে বাংলায় খাবারদাবার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রকাশিত হয় প্রথম রান্নার বিষয়ক বই
ছাপাখানার আবির্ভাবে বাংলায় খাবারদাবার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রকাশিত হয় প্রথম রান্নার বিষয়ক বই

১৮৩১ সালের ‘সমাচার দর্পণ’-এ এই বইয়ের আবির্ভাবের খবর ছাপা হয়। বলা হয়, মহারাজা বিক্রমাদিত্যের অধিকারে থাকা ‘ক্ষেমকুতূহল’-এর সঙ্গে বাদশাহ শাজাহানের পারস্যদেশীয় রান্নার কৌশলসংবলিত পুস্তক ‘নেয়ামৎখান’ মিলিয়ে, বর্ধমানের রাজা মহতাব চন্দ বাহাদুরের (চুনীলাল কাপুর) রন্ধনশালায় যা যা গুরুপাক খাদ্য রাঁধা হয়, সেগুলো বাদ দিয়ে সহজগুলো নিয়ে তৈরি এই বই। ‘ক্ষেমকুতূহল’ শ্রীযুক্ত ক্ষেম শর্মার সংকলিত সুপশাস্ত্র (রন্ধনশাস্ত্র)। এই বইয়ে আরও রয়েছে সংস্কৃত ‘জীর্ণমঞ্জরী’ থেকে পাওয়া কিছু স্বাস্থ্যবিধি, খেয়েদেয়ে হজমের অসুখ-অজীর্ণ হলে যা যা করা চাই অর্থাৎ টোটকা। শুধু তা-ই নয়, সেকালের ‘সুপকুশল’ অর্থাৎ (ডাল-ঝোলের নয় শুধু) সব রকম রান্নায় কুশলী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এবং কিছু টিপস নিয়ে তৈরি হয়েছে এই বই। রান্নাবান্নার তথা ‘পাকবিধি’র বই। ভাষা সংস্কৃতঘেঁষা। এ বই যখন বাজারে এসেছে, তিতুমীর সে বছর মারা গেছেন, মারা গেছেন ডিরোজিও সাহেব, সিপাহি বিপ্লব আরও ২৬ বছর পরের কথা। ভালো কথা, ইংরেজদের সিদ্দিকা কবীর বলা যায় যাঁকে, সেই ‘মিসেস বিটন’ তখনো জন্মই নেননি।

‘পাকরাজেশ্বর’–এর লেখক বিশ্বেশ্বর তর্কালংকার ভট্টাচার্য। এই বিশ্বেশ্বর তর্কালংকার কে এবং কোথায় বাস করতেন, বর্ধমান রাজার অন্দরের সঙ্গেই-বা তাঁর কী যোগাযোগ, তা সঠিক জানা যায় না। পরে ১৮৫৪ সালে সিলেটের সন্তান এবং শোভাবাজার রাজবাড়ির সভাপণ্ডিত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ এর সংশোধন করেন। বইটির দাম ছিল ৮ আনা থেকে ১ টাকা, আদি সংস্করণ থেকে শুরু করে পরবর্তী ১১৬ বছর ধরে বইটি বর্ধমান রাজবাড়ি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ‘পাকরাজেশ্বর’ বের হওয়ার ২৭ বছর পর বর্ধমান রাজবাড়ি থেকে বের হয় আরেকটি রান্নার বই, সেটার নাম ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’। রাজবাড়ির এমন দেশীয় সংস্কৃতিচর্চা এবং দেশি পাকপ্রণালি সংরক্ষণের শুভেচ্ছা আমরা আরও একবার দেখব দিঘাপতিয়ার রাজা এবং তাঁর অকালপ্রয়াত রানি কিরণলেখায়। রানি কিরণলেখার ‘বরেন্দ্র রন্ধন’ বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির এক অবিস্মরণীয় অংশ বলে আমি মনে করি, আমার মতো অনেকেই হয়তো তাই ভাবেন। তবে তাঁদের গল্প আরেক দিন।

পাকরাজেশ্বর
পাকরাজেশ্বর

এই রান্নার বইখানা গবেষক সুশীলকুমার দের চোখে পড়ে। তিনি এ বইয়ের সাহিত্যমূল্য নেই বিবেচনা করে ক্ষান্ত হন, কিন্তু সাহিত্যমূল্যের বাইরে এই বইয়ের যে ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক মূল্যও থাকতে পারে, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাননি। সামর্থ্যানুসারে বাংলার ঘরে ঘরে যে ভালোমন্দ রান্নার চল ছিল এবং এই রসের রসিক লোকের অভাব ছিল না, সেটার এক আশ্চর্য সাক্ষী ‘পাকরাজেশ্বর’। নইলে কে জানত রাজাদের সামনে পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল রুপার থালায় পরিবেশিত হয় অন্ন, তাকে ঘিরে চাঁদের জ্যোতির্মণ্ডলীর মতো সোনার বাটিতে করে যাবতীয় তরকারি। ডানে থাকবে ডাল, ঘি, মাছ, মাংস, শাক। বাঁয়ে থাকবে খাবার জল, দুধ, আচার, চুমুক পেড়ে খাবার অম্বল-ঝোল ইত্যাদি। দই-গুড়-পায়েস, এসব থাকবে সামনে দ্বিতীয় সারিতে দুই ভাগে ভাগ হয়ে। কে জানতে পারত, সেকালের রাজ-অন্তঃপুরে খাদ্যরুচি মুসলমানি, কোনো ডিশ সুলতানি আমলের, কোনোটা মোগলাই। সত্যভাষণের খাতিরে বলতেই হয়, বাঙালির প্রাচীন হেঁশেল আর সনাতন রান্নার চিহ্নমাত্র নেই ‘পাকরাজেশ্বর’-এ, বরং এ একেবারেই মোগলাই অভিরুচির রাজবাড়ির পাকপ্রণালি লিখে রাখা বই। তা হোক, ইংল্যান্ডেশ্বরী ভূভারতেশ্বরী হওয়ার আগের বেঙ্গলের কতটাই-বা আমরা নিজেরা সংরক্ষণ করতে পেরেছি! এইটুকু যে আছে, সেই তো আশ্চর্যের।

‘পাকরাজেশ্বর’-এর ভূমিকাতেই বলে দেওয়া আছে বিশ্ব পঞ্চভূতের সমাহার, ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম। এই বিশ্বে দেহ ধারণের উপায় খাদ্যগ্রহণ বা আহার, সেই আহার তিন শ্রেণির—সাত্ত্বিক, রাজসিক আর তামসিক। আর আহারের স্বাদ ছয় রকমের—অম্ল, তিক্ত, মধুর, লবণ, কটু, কষায়। খাদ্য গ্রহণের পদ্ধতিভেদে খাবার চার রকমের—চর্ব্য, চূষ্য, লেহ্য এবং পেয়। পশ্চিমা রান্নার বইগুলোর মতোই ‘পাকরাজেশ্বর’ও প্রথম মনোযোগ দিয়েছে রান্নাঘর আর সাজসরঞ্জামের ওপর। রান্নার জলটা পরিষ্কার হওয়া চাই, লাকড়ি শুকনো হওয়া চাই—পোকা-ধরা নয় বা পচা কাঠের নয়, আগুন ধরানোর চকমকি চাই। এরপর লাগবে খোলা হাঁড়ি, বাঁশের চুপড়ি, ধামা-ধুচুনি, চালুনি, উদুখল, শিল-নোড়া, কুলা, হাতা, ঝাঁজরি হাতা, ছাঁকনি—এসব।

রান্নার ঝকমারি তো আছেই, প্রস্তুতিভাগেই আছে বহু কাজ। এই যেমন আস্ত ধনে ঘণ্টা ছয়েক ভিজিয়ে রাখতে হবে, পরে তপ্ত বালুতে ভেজে হাতে মুছে পরিষ্কার করে নিতে হবে। মরিচ পরিষ্কার করতে হবে গরম পানিতে খানিকটা সেদ্ধ করে নিয়ে তারপর। মাছ সাফ করতে হবে বেসন, তিলের তেল আর মৌরি ভেজানো পানিতে, এই পন্থা অবশ্য পরে প্রজ্ঞাসুন্দরীও কিছু কিছু রান্নায় বাতলে দিয়েছেন। ‘পাকরাজেশ্বর’-এর পরামর্শ মোতাবেক হাঁস ধুতে হবে দই-চন্দন-মুলতানি মাটি মিশিয়ে একে একে চারবার। মসলার একরকম মাপ তৈরির কথা আছে ‘পাকরাজেশ্বর’-এ, সেখানে হিং, আদা, মরিচ, জিরা, হলুদ, ধনে—এসব এমন করে একত্র করতে হবে, যেন এরা পরিমাণে ক্রমেই দ্বিগুণ হয়। যেমন: হিং ১ তোলা, আদা ২ তোলা, মরিচ ৪ তোলা, জিরা ৮ তোলা, হলুদ ১৬ তোলা আর ধনে ৩২ তোলা। এই মসলার মিশ্রণ পানিতে গুলে ছেঁকে নিতে হবে, তারপর তেলে এই মসলা দিয়ে ভুনা করে সেই তেল ব্যবহার করতে হবে রান্নায়। এর নাম ‘বেসবার’। বালুর হাঁড়ি আছে একরকম, তাতে বালু ভরে মাছের গায়ে এক আঙুল পুরু কাদার প্রলেপ মাখিয়ে তাতিয়ে নিতে হয়, কাদা পুড়ে লাল লাল হয়ে এলে তখন নামিয়ে ভেঙে সেই মাছ বের করতে হয়। মনে পড়ে গেল, অনেক কাল আগে সৈয়দ আলী আহসানের একটি বই বের করেছিল ঐতিহ্য প্রকাশনী, তিনি দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে কবে কোথায় কী খেয়েছেন, সেখানে সিন্ধু প্রদেশের থাট্টা জেলায় তিনি এমন করে কাদায় বেক করা মাছ খেয়েছিলেন। সোহাগা আর মাকালচূর্ণ দিয়ে সেদ্ধ করলে মাছের কাঁটা থাকে না।

চার্বাক যে বলে গেছেন ‘...ঘৃতং পিবেৎ’ (ঘৃত পান করবে), সেই দর্শন যেন মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে এই বই, দু-একবার তিলের তেল-খাসির তেল—এসবের কথা বলে বাকিটা কেবল ঘি আর ঘিয়ের বন্যা ‘পাকরাজেশ্বর’-এ, ঘি খাওয়া নয়, এ একেবারে পান করা। বলা আছে আটপ্রহর পাতা দই মন্থন করলে যে ননি ওঠে, তা হালকা তাপে জ্বাল করলে লালচে সুগন্ধী ঘি তৈরি করা যায়। ঘিয়ে রং করার যে গল্প শতবর্ষ পরে বেলা দে করেছিলেন ‘আকাশবাণী’তে, এই যেমন—ঘিয়ে লালশাকের রং দিয়ে লাল ঘি; ‘পাকরাজেশ্বর’-এ সেই ঘি লাল রং করা হয়েছে হিঙ্গুলে আর আলতায়, সবুজ রং করা হয়েছে পালংশাকবাটা দিয়ে, হলদে ঘি বানানো হয়েছে কুমকুমযোগে। লাউ দিয়ে মাংস রান্নায় এক সের মাংসে এক সের লাউ দেবে, আর ঘি এক সের, আর খানিকটা দই-গরমমসলা, একবার ভাবুন তো! লাউয়ের শুকনো শুকনো ঘন্টতে বা করলা রান্নাতেও সমান মাপে ঘি। শাক রান্নায় ঘি, সেটা চাঁপানটে শাকই হোক কি শুলফা শাক। শাকের বড়া ঘিয়ে ভেজে দইয়ে ফেলে রায়তা বানানোর কথা আছে। ‘দালি পাক’-এ এক সের মুগডালে এক সের ঘি, এক সের অড়হর ডালেও এক সের ঘি। মসুর আর মাষকলাইয়ে এক সের ডালে এক পোয়া ঘি।

নিরামিষ রান্না সামান্যই এই বইয়ে। ‘মঙ্গলকাব্য’-এর রকমারি শাক রাঁধার আনন্দগাথাকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে ‘পাকরাজেশ্বর’-রে কেবল দুই পদের শাক, সবজি বলতে বেগুন-ওল-কাঞ্চনফুল-রাঙা আলু-এঁচড় আর পটোল। এই যেমন, ওলের শুকনো শুকনো ঘন্ট বানাতে তাতে আমলকী-হরীতকী-তেঁতুল-দারুচিনি-লবঙ্গ-এলাচি-হলুদ-মরিচ-আদা দিতে হবে, সেদ্ধ করে মসলা মেখে জ্বলন্ত অঙ্গারে দিয়ে তাতে কুমকুম আর আদাকুচি দিয়ে সেঁকে নিলেই তৈরি হয়ে গেল। রাঙা আলু মোরব্বার মতো কেঁচে নিয়ে দই-যোয়ান-আদাবাটা মেখে রোদে শুকিয়ে নেবে, পরে হলুদ রং করা ঘিয়ে ভেজে মরিচে ভুনা করে ওলের মতোই অঙ্গারে সেঁকে নিতে হবে। এঁচড় রান্নার কথা আছে, হলুদ-মরিচ-ধনে-দই আর গরমমসলার রান্না, কুমকুম দিয়ে নামাতে হবে। পটোলের বেলায় দিতে হবে লবঙ্গের বাগাড়। আর আছে মাষকলাই ডাল সেদ্ধ করে তৈরি বরফি, ধোকার ডালনার ধোকামতন আরকি। তখনো টমেটো ভারতে আসেনি, তাই রান্নায় টমেটো নেই। রান্নায় বাঁধাকপি-ফুলকপি বা গোল আলুও নেই। সম্ভবত বাঁধাকপি বা ফুলকপি তখনো চাষ শুরু হয়নি ভারতে।

মধ্যযুগের কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তো বর্ধমানেরই লোক ছিলেন। সেই যে ‘কটু তৈলে রান্ধে বামা চিতলের কোল, রুহিতে কুমুড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল’। বর্ধমান রাজবাড়ির রান্নার প্রভাব ‘পাকরাজেশ্বর’-এ প্রবল, সেখানে মাছ নিয়ে আলাদা করে কোনো অধ্যায় নেই। সামান্য যা কিছু আছে, তা হচ্ছে মাছের প্রলেহ (কাঁচকলা-বাদামবাটা-দই-পিটুলি আর ঘিয়ে আদা-লবঙ্গ ফোড়ন দিয়ে রাঁধা মাছের ঘন ঝোলের তরকারি বা কোর্মা), রুইমাছের কোর্মা, দমপোক্ত (তেঁতুল দিয়ে রাঁধা মাছ), কাবাব মাহি ও কোপ্তাসামি কাবাব মাহি (মাছের কাবাব), মাছের ঘন্ট (আদা-নুন-ধনেবাটা মাখা মাছ কলাপাতায় মুড়ে গরম বালুতে কিছুক্ষণ রেখে কাঁটা বেছে ভুনা করা), মাছের পোলাও (ছোলার ডালের স্টকে ফোটানো এবং ঘিয়ে ভাজা মাছ স্তরে স্তরে ভাতে সাজিয়ে অঙ্গারে দম দেওয়া), মাছের পুরি (তিন ছটাক ঘিয়ের ময়ান দেওয়া এক সের ময়দায় দই মাখিয়ে এই পুরি বানাতে হবে, ভেতরে মাছের পুর) এবং জেরবিরিয়ানমাহি (মাছের বিরিয়ানি)। বাকি ‘পাকরাজেশ্বর’-এ মাংসের জয়জয়কার।

পলান্ন বা পোলাও অবশ্যই মাংসে রাঁধা পোলাও, যা ‘মাংসভবরস’ অর্থাৎ স্টকে সেদ্ধ করা, এর নানান রকমফের আছে ‘পাকরাজেশ্বর’-এ। যেমন কমলার খোসাসেদ্ধ দিয়ে রাঁধা ‘কমলাপলান্ন’, আছে ‘নরগিসিপলান্ন’, সুজির ‘গোধূমপলান্ন’, ভাজা পোলাও বা ‘ভর্জ্জিত পলান্ন’ (পাক্কি বিরিয়ানির মতোই পড়তে শোনায়), ‘মোতঞ্জনপলান্ন’ (মাংসের আখনি তৈরি করে রাঁধা পোলাও), ‘বার্ত্তাকুপলান্ন’ (বেগুনের পোলাও, ঘিয়ে বোঁটাসহ বেগুন আধভাজা করে তাতে ফুটো করে আখনির মাংসের পুর ভরে ভাজতে হবে, পোলাওয়ের ওপর পরে দিয়ে দিলেই হয়ে গেল), ‘প্রিয়পলান্ন’, ‘শীরাজি পলান্ন’ (কিমা পোলাও), ‘ক্ষীরশর্কঘ্নপলান্ন’, ‘লোকমাপলান্ন’ (মাংসের বড়ার পোলাও), ‘পুরীপলান্ন’ (কিমাপুরী আচ্ছাদিত পোলাও), ‘আম্রপলান্ন’ (আম-কিশমিশ ইত্যাদিসহ পরিবেশিত পোলাও, পোলাও রান্নাতেও কিছুটা আমের রস ব্যবহৃত হয়েছে), ‘নাগরঙ্গপলান্ন’ (নারাঙ্গ বা কমলালেবুর আকারে ভাজা কিমার বল দিয়ে রাঁধা পোলাও), ‘সোমসাপলান্ন’ (সমুচা পোলাও) এবং ‘খেচরপলান্ন’ (কাঁচা মুগডাল-গরমমসলা-আদা-জিরে-তেজপাতা দিয়ে রাঁধা পাখির মাংসের পোলাও)। আস্ত পাখির পেটে আদা আর কিশমিশ পুরে কাবাব করে রাঁধা পোলাওয়ের কথাও আছে এতে, নাম ‘কাকোপলান্ন’।

‘পাকরাজেশ্বর’-এর রাজবাড়ির রান্নাবান্নার মূল নায়ক হচ্ছে মাংস। প্রথমত, প্রলেহ, অর্থাৎ ভুনা মাংস। নাগরঙ্গের প্রলেহ (কমলার আকৃতিতে গড়া ভাপা কিমার বল দিয়ে রাঁধা মাংসের পদ) আছে, আছে খরবুজ বা তুম্বি প্রলেহ (তরমুজের মতো ফল, কাঁকুড়?), রাজপুতী বার্ত্তাকু প্রলেহ (বেগুন-মাংসের টক-মিষ্টি কিমা কারি), কারবেল্বী প্রলেহ (করলা দিয়ে মাংস), মধুর মাংস প্রলেহ (দুধে রাঁধা কোর্মা)। দেখা যায়, রাজবাড়িতে মেষমাংসের প্রলেহ রাঁধা চলছে, কচ্ছপের মাংসের প্রলেহ, শশক অর্থাৎ খরগোশের মাংসের প্রলেহ চলছে। শুধু কি আর ছাগমাংস? রাজার হেঁশেলে ছাগমুণ্ডু আর ছাগনাড়িও (ভুঁড়ি) রাঁধা হচ্ছে। এই ছাগনাড়ি রাঁধতে গেলে নাড়িভুঁড়ি হিং আর তেঁতুল দিয়ে নির্মল জলে ধুয়ে নিয়ে ঘিয়েভাজা করে সেই যে মসলার মিশ্রণ ‘বেসবার’...সেইটা দিয়ে পাক করে এলাচ-লং-কর্পূর-মরিচের বাগাড় দিতে হবে। মাংসের পদের ভারী বাহারি সব নাম, ‘নুরমহলী জেরবিরিয়ান’, ‘খয়বরি জেরবিরিয়ান’। ‘পাকরাজেশ্বর’-এর আমলেও তেহারি বা ‘তাহিরী’ ছিল, তবে তাতে নামানোর আগে ঘিয়ে ভাজা মুগডালের বড়ি দেওয়া হতো। মাংসের প্রলেহর পরে আসে শূল্যপাক অর্থাৎ কাবাবের প্রসঙ্গ। ঝিঙে, লাউ, বেগুন, শসা বা কাঁকুড়ের ভেতরটা কুরিয়ে নিয়ে তাতে রান্না করা মাংসের পুর ভরে আস্ত সবজিটাকে শিকে গাঁথা হতো, বাঁশের চটা দিয়ে একটু মুড়ে গনগনে অঙ্গারে ধরে পোড়ানো হতো, পরে গরমমসলাগুঁড়ো মেশানো ঘি মাখিয়ে নামানো হতো। ‘হরীসা’ নামের একটি পদ আছে, সেটাকে হালিমের অদূর-সম্পর্কের আত্মীয় বলা চলে, হালিমের সঙ্গে অবশ্য ‘শোলা’ বা ‘মুজফর শোলা’ পদের মিল আছে।

এ বইয়ের ভূমিকায় শ্রীপান্থ বর্ধমানের বিখ্যাত সীতাভোগ আর মিহিদানা নেই বলেছেন, কিন্তু ‘মুক্তাজাল’ নামের যে মিষ্টি বানানোর কথা আছে, তা খানিকটা বোঁদের মতোই, শুধু চিনির সিরায় ফেলা হয় না, চিনিটা আগেই গোলায় যোগ করে দেওয়া হয়। কোনো মিঠাইয়েই ছানার প্রয়োগ নেই। ক্ষীর, নানান পদের আটা বা বেসনের মিষ্টির কথা রয়েছে। যেমন: ধোয়া চালের আটা, সুজির আটা, জোয়ারের আটা, ধোয়া মাষকলাইয়ের আটা, পানিফলের আটা, যবের মোটা ছাতু, ছোলার বেসন ইত্যাদি। এই তো মিষ্টান্ন—মুগডালে বাতাসা-ঘি-কুমকুম মিলিয়ে জ্বাল দিয়ে ঘি ভেসে উঠলে তৈরি। এমনিতে লুচি, মালপোয়া, পাঁপড়, নিমকি, কচুরি, শক্করপারা, খাজা, প্যারাকী, ক্ষীর বা বাদামের বরফি, এমনকি ময়দার বা পানিফলের আটার জিলাপি (কুণ্ডলী) এসব বানাবার প্রণালি আছে, আছে মোতিচুর, মদনামৃতী (মদন আমিরতি) আর বালুসাহী/বালুশাই, সরভাজা আর ভাপা দই। মোহনভোগ আছে আদার, বাদামের, দুধের, ছোলার আর মিষ্টিকুমড়ার, চারমগজ দিয়ে বানানো ‘শোভন মোহনভোগ’। এই ‘শোভন মোহনভোগ’-ই পরে ‘পাকরাজেশ্বর’-এর উত্তরসূরি গ্রন্থ ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’-এ গিয়ে ‘সোহন মোহনভোগ’ (সোহান হালুয়া?) হলো কী? যা সম্বন্ধে লেখা আছে প্রতিদিন সকালে আধপোয়া করে খেলে বীর্যবৃদ্ধি ও রতিশক্তি বর্ধিত হয়? এই রতিশক্তি বর্ধনের বিষয়ে কি বাঙালি কি ইংরেজ, প্রায় সব পুরোনো রান্নার বইয়েই কমবেশি উল্লেখ আছে।

‘পাকরাজেশ্বর’-এ মিষ্টিপদের ভেতর আরও আছে রসে ফেলে বড়া তৈরির পন্থা, যেমন: এক সের দইয়ে কুমড়ো সেদ্ধ করে তাতে মাষকলাই ডালবাটা মিশিয়ে মন্ড বানিয়ে ঘিয়ে ভেজে রসে ফেলা বড়া কুষ্মাণ্ড বটকা। শুধু দই আর সুজি দিয়েও এই বড়া তৈরি হতে পারে, হতে পারে শুধুই মাষকলাইয়ের ডাল দিয়ে। ডিমের মিষ্টি আছে একরকম, খানিকটা ফ্লোটিং আইল্যান্ডের মতন, হাঁসের ডিম মিছরির রসে এমন করে ফেটাতে হবে যেন পানিতে ভাসে, পরে মৃগনাভি-গোলাপজল ইত্যাদি দিয়ে পরিবেশন করতে হবে। এ বইয়ে আরও আছে সেকালের গুড়ের পিঠা, আছে চিড়ার পিঠা, মিষ্টি আলুর পিঠা, নারকেলের পুর দেওয়া মুগডালের পুলি, সরুচাকলি (ঘিয়ে ভাজা মাষকলাই ডালের রুটি), আর আছে নির্জলা দুধে মিছরি দিয়ে রাঁধা ফিরনি-পায়েস। ক্ষীরের নাড়ু, আমের রসে বাঁধা নাড়ু, মাষডালের নাড়ু, চালের গুঁড়ির নাড়ু তো আছেই, আছে লাড্ডু, আছে নানান পদের রুটি বানানোর বিধি। খামিরে দই মেলালে সেটা ‘দধিরোটিকা’, আটার অর্ধেক তিল মেলালে সেটা ‘তিলী রুটি’, দুধের রুটি ‘দুগ্ধরোটিকা’, বাদামের ‘বাদামি রোটিকা’, ছোলার বেসনের ‘বেসনিরোটিকা’, পেস্তার লাচ্চা পরোটার মতো ‘স্তবকীরোটিকা’, কিংবা মুগডালের ‘মুদ্গীরোটি’, উজবেকিস্তানের ‘উজবুকি রোটি’, কাঁচা ছোলাপেষা দিয়ে ‘হরিদ্বর্ণ মিষ্টরোটি’, ডালিমের রসে ‘দাড়িমি রোটি’ আর আছে ‘ফিরঙ্গরোটি’ বা যাকে বলে ‘পাঁওরোটি’ (পাউরুটি)। ‘মিষ্টরোটি’ নামের একটি রুটি বানানোর কৌশল আছে, এক সের শ্বেতযবের আটায় এক সের বাদামবাটা আর ডিমের সাদা অংশ মিলিয়ে খামির গড়ে নিতে হবে। আধপোয়া করে এক এক ডেলায় অষ্টভূজের মতো রুটি গড়ে তাওয়ায় মৃদু আঁচে সেকতে হবে, এতে দেবে পেস্তাকুচি-মৃগনাভি-গোলাপজল, রুটি লালচে হয়ে এলে রুটির ওপর দিতে হবে কুমকুম মেশা ননি, পরে সোনা-রুপার তবকে মুড়ে এই রুটি পরিবেশিত হবে। আহা, রাজবাড়ির রান্না বলে কথা! এই মিষ্টিপদের কথা পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল ব্রিটিশ বাংলাদেশি নাদিয়া হুসেনের কথা, যিনি বছর চারেক আগে ‘ব্রিটিশ বেক-অফ’ জয় করে অতঃপর বলেছিলেন, বাঙালির কুইজিনে কোনো ডেজার্টের কনসেপ্টই নেই।

‘পাকরাজেশ্বর’-এর শেষ দিকের একটি অধ্যায় ‘মিষ্টশাক’ বা মোরব্বা, খাবারদাবারের বইয়ে খাদ্য সংরক্ষণ এবং সংরক্ষিত খাদ্যের নমুনা থাকবেই। অতএব আম-আনারস-কামরাঙা-আমলকী-হরীতকীর মোরব্বা তো বটেই, আছে আদার মোরব্বা, এমনকি থোড়ের মোরব্বা। পরের অধ্যায় ‘সন্ধানিকা’ অর্থাৎ আচার, আমের আচার থেকে শুরু করে লেবু-আদা-ঝুনা নারকেল-আঙুর হয়ে ওল আর লাউয়ের আচার অবধি আছে। আচারে তেঁতুলপাতা-রাইসর্ষে-সর্ষের তেল-আখের রসের ‘ছিরকা’-লেবুর রস-কালিজিরা ইত্যাদি দেওয়ার কথা আছে। তবে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে খাদ্য সংরক্ষণের কী কী প্রক্রিয়া বহাল ছিল, তা এই বই পড়ে ঠিক জানা যায় না। কেন? রাজবাড়িতে নগদে রাঁধত আর উদ্বৃত্ত ফেলে দিত? এবেলারটা ওবেলায় আর চলবে না বলে? হয়তো। ‘পাকরাজেশ্বর’-এ চাটনির বিবরণ একটিই, সেটি পুদিনার (পুদিনা শাক) চাটনি। পানীয়র অধ্যায়ে আছে ‘অম্লিকা’, অর্থাৎ মিছরি আর তেঁতুলে মেশানো পানীয়। আছে পাকা ডালিম আর টক ডালিমের শরবত, লেবুর আর কমলালেবুর শরবত, আর আছে সেব (আপেল) থেঁতো করে এর সঙ্গে শ্বেতচন্দনের শরবত।

এসব রন্ধনপ্রণালির সুলুক-সন্ধান দিয়ে ‘পাকরাজেশ্বর’ শেষ হয়, একই মলাটের ভেতর ‘জীর্ণমঞ্জরী’ শুরু হয়, সেকালের টোটকা শাস্ত্র। যেমন: নারকেল বেশি খেয়ে হজমের গন্ডগোল হলে ভাতে তার উপশম, বেশি আম খেয়ে শরীর খারাপ করলে পলাশের মূল খেতে হবে। মাংস বেশি খেলে কাঞ্জির জল পথ্যস্বরূপ, পান খেতে গিয়ে চুনে মুখ পুড়লেও সেই কাঞ্জির জলই ভরসা অথবা খানিকটা তেল। মালপোয়া তথা ভাজা পিঠা বেশি খেয়ে পেট আইঢাই করতে পারে, সঙ্গে রাখা চাই সেদ্ধ পিঠা। বেশি মাছ-মাংস খেয়ে অসুখ করলে শুক্তো খেলে ভালো, বেশি মাছ খেয়ে হজমের গন্ডগোল হলে আবার সেঁকা-পোড়া মাংস খেলে শরীর ভালো হবে। শাক হজম না হলে সাদা সর্ষেতে উপশম, ওল হজম করতে গুড় খাওয়া চাই। জলবাহিত রোগে খাবার জলে সোনা কিংবা রুপা তপ্ত করে সাতবার ডুবালে জলের দোষ ক্ষয় হবে ইত্যাদি। জীর্ণমঞ্জরী শেষ হয়েছে এই পরামর্শ দিয়ে যে—কানের ভেতর পোকা ঢুকলে কান ভরে তিলের তেল দিলে ভালো হয়ে যায়, আর খাওয়ার সময় গলা-বুকে ব্যথা করলে পরের গ্রাসটুকু আদার রস মেখে খেলেই হবে। আর এই যে সেকালের কথা, এসব পড়ে যদি চিরতরে হারিয়ে যাওয়া কালের ব্যথা বুকে বাজে? কিসে তার উপশম?

মিসেস বিটনের প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো বইয়ে বারবার ফিরে যান বিদেশি পাচক, খাদ্য সংরক্ষণবিদ ও ঐতিহাসিকেরা। আশা করতে ইচ্ছে হয়, ‘পাকরাজেশ্বর’ বা ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’-এর মতো করে বাংলায় যত শতবর্ষী রান্নার বই আছে, লাইফস্টাইলের কেতাব আছে, সেগুলো নিয়েও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তেমন হবে, সমাদরের দৃষ্টি, ভালোবাসার দৃষ্টি। এই বইগুলো জানায় আমরা উন্মূল নই, কখনো ছিলাম না, পুরোনো চিহ্ন (যা ক্ষতিকর নয়) তা সমাজে থাকলে সমাজের লাভ, রাষ্ট্রেরও, সভ্যতারও।