মহামারির চিত্রকলা
>
১৯১৮ সাল। স্প্যানিশ ফ্লুর তাণ্ডব চলছে পুরোদমে। এই বছরই বিশ্বের দুই বিখ্যাত চিত্রকর রং চাপালেন ক্যানভাসে। তাঁদের আঁকা সেই ছবিগুলোতে চোখ ফেরালে আজও পাওয়া যায় মহামারির করুণ বেদনা। করোনা মহামারির এই সময়ে জানা যাক এই ছবিগুলোর পেছনের গল্প
এগোন শিলের দুটি ছবি
বিকৃত মানবদেহের প্রতিকৃতি তুলে ধরার জন্য বিখ্যাত অস্ট্রিয়ার চিত্রকর এগোন শিলে। কোনো একটি বিশেষ শিল্পধারায় এ শিল্পীর আঁকা ছবিকে ফেলা যায় না। একেবারে বিমূর্ত ছবি তা নয়, আবার পুরোপুরি যে ফিগারেটিভ ইলাস্ট্রেশন, তা-ও নয়। নিজস্ব একটি ধারা তিনি চিত্রকলায় তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। মাত্র ২৮ বছরের জীবনে নিজস্ব সেই ধারার জন্য খুবই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
এগোন শিলের একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম হচ্ছে ‘পরিবার’, যেখানে তিনি এঁকেছেন নিজের পরিবারের প্রতিকৃতি। এই ছবিতেও মানবদেহের অসম্পূর্ণতা ফুটে উঠেছে। তবে এর সঙ্গে খুবই বেদনাময় এক বাস্তবতাও জড়িত।
এ ছবিতে নিজের পরিবারের তিন সদস্যের ছবি এঁকেছেন এগোন এবং তাঁর অন্য অনেক ছবির মতোই নগ্ন অবস্থার প্রতিকৃতি হচ্ছে এ ছবি। ছবির তিনজনের সেই পরিবারে এগোন, তাঁর স্ত্রী এডিথ ছাড়াও আরও আছে মায়ের সামনে হামাগুড়ি দিয়ে বসে থাকা এক শিশু। ১৯১৮ সালে ছবিটি যখন আঁকা হয়, এডিথ তখন অন্তঃসত্ত্বা। সামনের শিশুটির জন্ম তখনো হয়নি, মা-বাবা তার আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলেন। শিল্পীর অবশ্য ছবিটি নিয়ে আরও কিছু কাজ করার ইচ্ছা ছিল, যা তিনি করে যেতে পারেননি। সেদিক থেকে দেখলে এ ছবি অসমাপ্ত। এডিথ সেখানে একদিকে তাকিয়ে থাকলেও সবচেয়ে পেছনে কিছুটা উঁচুতে বসে থাকা এগোন সরাসরি তাকিয়ে আছেন দর্শকের দিকে। তবে দুজনের চোখই বিষণ্নতায় ভরা।
সেই একই বছরের শরৎকালে এগোন আর এডিথ মাত্র অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এডিথ মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে তাঁর একটি স্কেচ এঁকেছিলেন এগোন শিলে। পরিষ্কার মুখাবয়বে শ্রান্তি আর বেদনার ছাপ দুচোখে। এর ঠিক এক দিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন এডিথ। আর তিন দিন পর এগোনও মহামারির শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তাই শিল্পীর আঁকা পরিবারের সেই শিশুসন্তানটি আর জন্ম নেওয়ার সুযোগ পায়নি।
এডওয়ার্ড মুঙ্কের দুটি ছবি
এগোন শিলের মতো ততটা দুর্ভাগা ছিলেন না নরওয়ের চিত্রকর এডওয়ার্ড মুঙ্ক, যদিও স্প্যানিশ ফ্লুর হামলায় প্রায় কুপোকাত হয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছিল তাঁর। সেই অসহায় অবস্থা এবং এর থেকে উদ্ধার পাওয়া—দুই অবস্থার প্রতিফলনই তিনি তুলে ধরেছেন নিজের আঁকা দুটি ছবিতে। প্রথমটির নাম মুঙ্ক দিয়েছেন ‘স্প্যানিশ ফ্লু-আক্রান্ত অবস্থার আত্মপ্রতিকৃতি’ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘স্প্যানিশ ফ্লুর পরের আত্মপ্রতিকৃতি’। এখানে খাটের পাশে কম্বল জড়ানো অবস্থায় তাঁকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। অজানা আশঙ্কায় চোখ দুটি যেন কোটরে ঢুকে আছে। এই ছবির রংও বোধ করি কিছুটা দুঃখভারাতুর।
দ্বিতীয় ছবিতে সুস্থ হয়ে উঠলেও এখানে দেখা মেলে বিষণ্নতায় আক্রান্ত এক মুঙ্কের, যেখানে তিনি সরাসরি তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। চোখের চারদিকে অসুস্থতা ছাপ ফেলে গেলেও রঙের দ্যুতি পুরো ছবিতে যেন আবারও ফিরে এসেছে।
এই চিত্রকর্মগুলো আমাদের যেমন শতবর্ষ আগের অতিমারিকে মনে করিয়ে দেয়, তেমনি বর্তমান করোনাকালে ছবিগুলো নতুনভাবে প্রাসঙ্গিকও হয়ে ওঠে।