এ কথা বলাই যায়, বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের আধুনিক ছাপচিত্র ইতিমধ্যে দীর্ঘ সময় পার করে নিজস্ব একটি ধারায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। তা ইউরোপের মতো সুপ্রাচীন না হলেও এর অন্তত দুই শতাব্দীকালের চর্চার ইতিহাস রয়েছে। তবে সূচনাপর্বের কথা বলতে গেলে প্রথম দিকে তা পুস্তক অলংকরণের অনুষঙ্গ হিসেবেই কাজ করেছে।
ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজরা চারুকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল, তাতে ছাপচিত্রের শিক্ষা দেওয়া হতো। ইউরোপে মধ্যযুগের পরে ছাপাই ছবির এক দারুণ জাগরণ ঘটেছিল। আলব্রেখট ড্যুরার, রেমব্রান্ট, গোইয়া প্রমুখ শিল্পী ছাপচিত্রকে এক উচ্চাঙ্গের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন সেই সময়।
তবে ছাপাই ছবিতে ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’ কিছুটা বিলম্বেই ঘটেছিল। এর একটা বড় কেন্দ্র ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বাড়ান্দার বিচিত্রা স্টুডিও। সেখানে প্রেস স্থাপন করেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। ‘সোশ্যাল আইরনি’, একধরনের সামাজিক অভিঘাত তুলে ধরেছিলেন এই ছাপাই ছবির সমাহারে।
আর ঠাকুরবাড়ির আবহেই বেড়ে উঠেছিলেন নন্দলাল ও মুকুল দেরা। রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় বিলাত-আমেরিকা থেকে ছাপাই ছবির পাঠ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন মুকুল দে। দেশে ফিরে নিযুক্ত হলেন কলকাতা সরকারি আর্ট কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ হিসেবে।
মুকুল দে ছাপাই ছবির অনেক বড় নাম। তাঁরই স্নেহধন্য রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, হরেন দাস ও সফিউদ্দিন আহমেদ। হরেন দাস আর সফিউদ্দিন ছাপচিত্রের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এসব বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা। অবিভক্ত ভারত। শিল্পের প্রধান কেন্দ্র তখন কলকাতায়। ১৯৩০-৪০-এর দশকের কলকাতা ছাপাই ছবির এক উজ্জ্বল সময় চাক্ষুস করেছে। একদিকে চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোরের সমাজবাস্তবতার ছাপ ছবি, অন্যদিকে সফিউদ্দিন, হরেন দাসের রোমান্টিক ধাঁচের নিসর্গ, প্রকৃতি ও মানবগাথা। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন সফিউদ্দিন আহমেদ। এখানে ছাপচিত্রের বড় একটি কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা।
কয়েক দিন আগে গ্যালারি কায়াতে শুরু হয়েছে ছাপাই ছবির এক অভূতপূর্ব প্রদর্শনী। এখানে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের তেপ্পান্নটি ছবি। বায়ান্ন গলির তেপ্পান্ন বাজারের সেই মিথের শহর ঢাকায় তেপ্পান্নটি ছাপচিত্রের প্রদর্শনী। নিঃসন্দেহে একটি ভিন্ন মাজেজা তৈরি করে। বস্তুত এই সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনাও। গ্যালারি কায়া এক চৌহদ্দির ভেতরে ভারত ও বাংলাদেশের সব প্রতিথযশা ছাপচিত্রীকে জড়ো করতে পেরেছে। এই সমাহারে যেমন আছেন ভারতের মকবুল ফিদা হুসেন, হরেন দাস, সোমনাথ হোড়, কে জি সুব্রামানিয়াম, অমিতাভ ব্যানার্জি, গণেশ হালুই, সনত কর, দিপক ব্যানার্জি, লালু প্রসাদ সাঁহু, সুহাস রায়, সুনীল দাস, মনু পারেখ, অতুল দোদিয়া প্রমুখ শিল্পী; আবার বাংলাদেশের অংশেও অনেক স্বনামধন্য শিল্পীর কাজ স্থান পেয়েছে। যেমন সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর, মনিরুল ইসলাম, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, আবুল বারক আলভী, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, রতন মজুমদার।
অর্থাৎ দুই দেশের সমকালীন ছাপাই ছবির মূল রূপকারেরা সবাই আছেন এখানে। এই চিত্রমালায় যেমন পাওয়া যায় দ্রোহকালের বয়ান ও মানুষ-প্রকৃতি; আবার আছে রূপ-অরূপের সন্ধান। সব দৃশ্যমানতা অতিক্রম করে যেনবা অসীমের লক্ষ্য ভেদ করতে চেয়েছেন কোনো কোনো শিল্পী। কেউ আবার দৃশ্যমানতা অপেক্ষা হেঁটেছেন রূপময়তার দিকে।
দুই দেশের এ প্রদর্শনী একটি সেতুবন্ধও বটে, আবার তুলনামূলক আলোচনার অবকাশও তৈরি করে। শিল্পের ভাষা আন্তর্জাতিক হলেও স্থানিক ও কালিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। স্থান-কালভেদে এর তারতম্য ঘটে। সেই সূত্রে বলা যায়, ভারতের শিল্পীরা অনেক বেশি অবয়বধর্মী। যেমন হুসেন, সুব্রামনিয়ামরা সব সময় গল্পের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছেন। তবে আমাদের দেশের শিল্পীরা—মোহম্মদ কিবরিয়া, সফিউদ্দিন, মনিরুলরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাত্রা করেছেন নিরাকার-নিরাবয়ব অনন্তের পথে। সীমার মাঝে করেছেন অসীমের সন্ধান।
বর্তমান প্রদর্শনীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ছাপাই ছবির নিজস্ব ভাষার অনুসন্ধান এবং এই মাধ্যমের নান্দনিকতার আস্বাদ গ্রহণ। চিত্রকলার প্রত্যেক মাধ্যমের নিজস্ব ভাষা থাকে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে ছাপচিত্রের মূল নান্দনিকতা নিহিত আছে তার রেখাধর্মিতার মাঝেই। সেতারের মিহি সুরের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন প্রবেশ করি এক অনির্বচনীয় জগতে, একইভাবে ছাপাই ছবির রেখার বিস্তারের মধ্য দিয়ে এক অনিন্দ নান্দনিক ভুবনে আমাদের প্রবেশ করিয়ে দেয়। ক্রমশ মোহগ্রস্ত করে আমাদের।
২১ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হবে ৫ অক্টোবর। প্রদর্শনী আর শিল্পীরা হচ্ছেন নিরঞ্জন প্রধান, আদিতা বসাক, বিমল কুণ্ডু, মনোজ দত্ত, প্রদীপ মৈত্র, ওয়াকিলুর রহমান, অতিন বসাক, রশীদ আমিন, শ্রীকান্ত পাল, আনিসুজ্জামান, নগরবাসী বর্মণ, জয়ন্ত লস্কর, শেখ মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান, রুহুল আমিন তারেক, মো. আরিফুল ইসলাম, মো. আশরাফুল আলম, কামরুল খান প্রমুখ।