বেঁচে থাকা একটি কঠিন শর্ত
গত মে মাসের শেষ দিন থেকে অফিস চলছে। সরকারি প্রজ্ঞাপন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সুচারুরূপে কর্মসম্পাদন বেশ দুরূহ। করোনাকালে সব অবস্থানের এবং বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অফিস-উপস্থিতি নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। তারপরও কঠিনের মধ্যে সহজকে খুঁজে নিতে হয়। জীবনের জন্যই জীবনধারণের বিষয়টি পায় সর্বোচ্চ অধিকার। সে পরিপ্রেক্ষিতেই কাজের গুরুত্ব বুঝে এগোতে হচ্ছে। অফিসে যাওয়া-আসা নিয়ে নিকটজনের বাধানিষেধ থাকলেও কর্তব্য ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে সব। খবর যা পাই আর টেলিভিশন-ফেসবুক যতটা চাউর করে, তার সবটাই ভীতিকর। কিন্তু ভয়কে তো জয় করতে হবে। হাত ধোয়া বেড়ে গেছে, সময়-অসময়ের তোয়াক্কা না করে নাকমুখ ঢেকে রাখছে মাস্ক। ঘরে-বাইরের এই আতঙ্কের মধ্যে আবার সাদা-কালোর লড়াই যুক্তরাষ্ট্র ছাপিয়ে আমাদের দেহেও উষ্ণ নিশ্বাস ফেলছে। জর্জ ফ্লয়েড আজ দুনিয়ার কাছে রক্তপিপাসুর বিচার চায়। কিন্তু তা পাওয়ার মতো পরিস্থিতি কি পৃথিবীর কোনো দিন ছিল কিংবা এখনো আছে? না, ছিল না। আর হয়তো হবেও না ভবিষ্যতে। তাহলে কিসের সভ্যতার বড়াই? আর কার জন্যই-বা মঙ্গলচিন্তা? এক কাজ করলে হয় না, মানুষের অভিধান থেকে রং তুলে দিলেই তো হয়! আর নিদেনপক্ষে যদি রঙের তামাশা দেখতেই হয়, তবে কেবল লাল থাকুক। লালে কোনো বিবাদ নেই—কালোর রক্ত লাল, আবার সাদার রক্তও লাল। এক মৃত্যু অসংখ্য মৃত্যুর আঁতুড়ঘর।
ওষুধ ফুরিয়ে গেলে তা সংগ্রহের জন্য সব রকম বাধা সরিয়ে দিতেই হয়। এরপর যদি তার সঙ্গে জুড়ে যায় ইনসুলিনের মতো বিষয়। তালিকামতো আমার ও আমার স্ত্রী যোরার এক মাসের ব্যাগ প্রস্তুত হলে কার্ডে দাম মেটাই। ওদিকে রেফ্রিজারেটরের ঠান্ডা থেকেও ব্যবহারকারীর নিস্তার নেই। ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নাকি ভাইরাসের জন্য বড় সুখের আশ্রয়। আপেল-মাল্টা-পেয়ারা-তরমুজ অক্ষত দেহে দুর্গ পাহারা দিচ্ছে। যে ‘বধিবে’, সে তো আদা-লবঙ্গ-দারুচিনি-তেজপাতা দিয়ে সিলেটের বাগানের পাতা প্রস্তুতে ব্যস্ত। তারপর আছে বাষ্প গ্রহণের লৌকিক অভিযান।
দাঁত বেয়াড়া হলে জান ফানা ফানা হয়ে যায়। করোনা ঢোকার শেষ বেলায় দাঁতের মেরামতে নেমেছিলাম, কিন্তু পুরোপুরি পেরে ওঠার আগেই দন্তচিকিৎসক তাঁর কপাটে খিল তুলে দিলেন। ফলাফল, একটি ভাঙা দাঁতের আর্তচিৎকারে দিশেহারা হওয়ার জোগাড়। এখন সব খোলার দলে এসে প্যাসিফিক ডেন্টালও তার বাহু উন্মুক্ত করল এবং কালবিলম্ব না করে আমিও চিকিৎসকের চিত-কেদারায় পিঠ নামিয়ে হাঁ করলাম।
বিকেলের রোদে এখন ঝাঁজ অনেক বাড়তি। তাতে আম পাকে, জাম পাকে; লিচু পাকে গাল নামিয়ে। বাজার ম-ম জ্যৈষ্ঠসন্ধ্যায় হিড়িক লেগে গেছে ফেসবুক লাইভের। ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি-লন্ডন-নিউইয়র্ক-টরন্টো-টোকিও-দুবাই-কুয়ালালামপুর গলা খুলে গাইতে লেগেছে। করোনা ও কবিতা মাখামাখি হয়ে ওড়াচ্ছে স্যানিটাইজার। সংগীত ও গলাবাজির তোড় এক প্রস্থ মাস্কের পক্ষে সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
দুই.
যেন বাঁচার ইজারা রক্ষার জন্য নিত্যদিন নানা প্রকরণে লড়ে যেতে হচ্ছে। অযত্ন-অবহেলায়ও বংশবৃদ্ধি ঘটছে আগাছার, আর প্রবল পরিচর্যার পরও জাত বৃক্ষটি ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। প্রকৃতি মেতেছে এক নতুন অভিযাত্রায়। মনুষ্যকুল তার একমাত্র লক্ষ্যস্থল এবং তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার মধ্যেই যেন তার সর্বসাফল্য নিহিত। এ হেন পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯-এর অভিযানের কিনারা পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার।
৭ জুন ছিল ছয় দফা দিবস। ১৯৬৬ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা উত্থাপন করেন। করোনার কারণে দিনটির সামগ্রিক আয়োজন সীমাবদ্ধ থাকে কেবল ডিজিটাল উপস্থাপনায়।
অন্যদিকে ৭ জুন সন্ধ্যায় যোরার ভাই, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে আমার সহপাঠী এ টি এম সোলায়মানের মৃত্যুসংবাদ আসে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল। মৃত্যুর এক দিন আগে পরীক্ষায় তার শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। করোনায় মৃত্যু একটি পরিবারকে নতুন সংশয় ও সংকটের মুখে নিপতিত করে। ভুল-বোঝাবুঝি টান মারে সম্পর্কের সুতোয়। আমরা কি করোনার হাতের পুতুল হতে যাচ্ছি?
চলে গেলেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী নীলুফার বানু। ১০ বছর ধরে লড়াই করছিলেন কর্কট রোগের সঙ্গে।
১২ তারিখ দুপুর গড়াতে সংবাদ এল নজরুল-গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম আর নেই। ১৩ তারিখে চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা-রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।
২০ জুন আবারও দুঃসংবাদ ধেয়ে এল। করোনায় সংক্রমিত হয়ে চলে গেলেন কামাল লোহানী। ভাষাসংগ্রামী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব—নানা পরিচয়ে তাঁর তুলনা কেবল তিনিই। পাকিস্তানি বিরুদ্ধ পরিবেশে বাঙালি সংস্কৃতি লালন ও বিকাশে আজীবন সাম্যবাদী, অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটির লড়াই কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়।
প্রায় একই সময়ে চলে গেলেন অনুবাদক-গবেষক জাফর আলমও। প্রগতিশীল উর্দু সাহিত্যের অনুবাদের মাধ্যমে তিনি আমাদের সাহিত্যভুবনকে সমৃদ্ধ করেছেন। জাফর আলমের মৃত্যু অবশ্য করোনায় নয়, তাঁর মৃত্যু হয়েছে বার্ধক্যজনিত। কিন্তু তবু চলে যাওয়া মানেই তো শূন্যতা। সেই শূন্যতা দীর্ঘ হচ্ছে, মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।
তিন.
চৈত্রে শুরু হয়েছিল তাণ্ডব, এখন আষাঢ়ে যেন তার তেজ শতগুণ বেড়ে তছনছ করে দিচ্ছে সব। কারও রেহাই মিলছে না এই দানবের হাত থেকে। চিকিৎসক-নার্স-স্বেচ্ছাসেবক থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসক-সাংসদ-মন্ত্রী কেউ বুঝি মুহূর্তের জন্য নিশ্চিন্ত নন। আর সাধারণ মানুষ তো ক্রমান্বয়ে সহ্যসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। ভয় ও মৃত্যুর যৌথ আক্রমণে দিনরাত্রি একাকার। বেঁচে থাকা একটি কঠিন শর্ত।
জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্বে জয়-পরাজয়ই নির্ধারণ করবে আমাদের ভবিষ্যৎ।